ট্রফিসহ ঘুমের এই ছবি তুলতে বহুত দম লাগে, তেজ লাগে
ছবিগুলো দেখেই কেমন শান্তি লাগে। একটি প্রশ্নও জাগে। তবে তার উত্তরও মধুর।
সাফ নারী চ্যাম্পিয়নশিপে গতকাল ফাইনাল শুরু হয়েছে বাংলাদেশ সময় সন্ধ্যা পৌনে ৭টায়। দুই অর্ধের মাঝে বিরতি এবং অন্যান্য আনুষ্ঠানিকতা মিলিয়ে ম্যাচটি শেষ হয়েছে রাত ৯টার পর। ফল তো আপনার জানাই। নেপালকে ২–১ গোলে হারিয়ে টানা দ্বিতীয়বার চ্যাম্পিয়ন হয়েছে বাংলাদেশ। ম্যাচ শেষ হওয়ার প্রায় আড়াই ঘণ্টা পর একটি ছবি ভাইরাল হয় সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে। কোন সে ছবি, সেটাও নিশ্চয়ই বুঝতে পারছেন।
বাংলাদেশ দলের কয়েকজন খেলোয়াড় বিছানায় ট্রফিসহ ঘুমানোর ছবি পোস্ট করেছেন সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে তাঁদের নিজ নিজ অ্যাকাউন্টে। শুরুটা করেন ফরোয়ার্ড মাতসুশিমা সুমাইয়া। রাত ১১টা ২২ মিনিটে তাঁর ভেরিফাইড ফেসবুক অ্যাকাউন্টে ট্রফিসহ ঘুমানোর ছবিটি পোস্ট করা হয়। খোঁজখবর না নিয়েও নিশ্চিন্তে বলে দেওয়া যায়, সুমাইয়া তখন সম্ভবত ঘুমাননি। চ্যাম্পিয়ন হওয়ার মাত্র আড়াই ঘণ্টার মধ্যে ঘুমানো অসম্ভব। আর ফাইনাল শেষে দলের উইঙ্গার সানজিদা আক্তার সংবাদমাধ্যমকে বলেছেন, হোটেলে ফিরে তাঁরা উদ্যাপন করবেন। সেই উদ্যাপন যে ঘুম নয়, তা বুঝতে মনোবিজ্ঞানী না হলেও চলে। সবচেয়ে বড় কথা, এমন একটা অর্জনের পর তখন ঘুমানোর সময় নয়। দুই চোখের পাতাই তো এক হওয়ার কথা নয়!
তাহলে ধরে নেওয়া যায়, সুমাইয়া ঘুমের অভিনয় করে ছবিটি তুলেছেন এবং অবশ্যই সেটি উদ্যাপনেরই অংশ। পৃথিবীতে এই ধারা নতুন নয়। জয়ের পর ট্রফিসহ বিছানায় ঘুমানোর এই রেওয়াজ বেশ পুরোনো। তবে ধারাটি জনপ্রিয় হয়েছে লিওনেল মেসির কল্যাণে। ২০২২ সালে কাতার বিশ্বকাপ জয়ের পর হোটেল কক্ষের বিছানায় ট্রফিসহ ঘুমানোর ছবি সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে পোস্ট করেছিলেন আর্জেন্টাইন কিংবদন্তি। তারপর থেকে ব্যাপারটা যেন অলিখিত নিয়মে পরিণত হয়েছে! সমর্থকদেরও এমন সব ছবি দেখে বুকে সুখের ব্যথা বাজে।
কেউ কেউ আবার মজা করে বলতেও পারেন, ট্রফি তো একটি। যেহেতু এতগুলো ছবি পোস্ট হয়েছে, তাহলে নিশ্চয়ই ট্রফি নিয়ে কাড়াকাড়ি পড়েছিল! কে কার আগে ট্রফিসহ ঘুমানোর ছবি তুলে পোস্ট করবেন, তা নিয়ে খানিকটা খুনসুটিও হয়তো হয়েছে। সুমাইয়া, মারিয়া মান্দা, শাহেদা আক্তার, শামসুন্নাহার সিনিয়র, রুপনা চাকমা কিংবা সানজিদা আক্তারদের এসব দেখতে দেখতে মনে এই প্রশ্নও জাগতে পারে। পাশাপাশি চোখ দুটোও কেমন জুড়িয়ে আসে। এমন ছবি যে বাংলাদেশের ক্রীড়াঙ্গনে খুব বেশি নেই। গত ২৮ আগস্ট সাফ অনূর্ধ্ব-২০ টুর্নামেন্টে চ্যাম্পিয়ন হওয়ার পর দলীয় ও ব্যক্তিগত ট্রফি নিয়ে বিছানায় ঘুমানোর ছবি নিজের ফেসবুক পেজে পোস্ট করেছিলেন বাংলাদেশ দলের ফরোয়ার্ড মিরাজুল ইসলাম। তবে ট্রফিসহ ঘুমোনোর যে ছবিটি এর আগে বাংলাদেশের ক্রীড়াঙ্গনে সবচেয়ে আলোচিত, সেটি বাংলাদেশ ক্রিকেট দলের অধিনায়ক নাজমুল হোসেনের।
বাংলাদেশ ফুটবলের জন্য জাদুকরি রাত। অভিনন্দন।নাজমুল হোসেন, বাংলাদেশ অধিনায়ক
পাকিস্তানকে তাদের মাটিতে টেস্ট সিরিজে ২–০ ব্যবধানে ধবলধোলাইয়ের পর গত ৪ আগস্ট ট্রফিসহ ঘুমোনোর ছবি পোস্ট করেছিলেন নাজমুল। বেশ প্রশংসিতও হয়েছিল ছবিটি। কারও কারও চোখে আবার একটু বাড়াবাড়িও মনে হয়েছে। হোক না পাকিস্তানের বিপক্ষে প্রথম সিরিজ জয়, তবু তো দ্বিপক্ষীয় সিরিজ। কিন্তু বাংলাদেশের ক্রিকেটে সাফল্য বিচারে ছবিটি দেখে সমালোচনার চেয়ে আনন্দই বেশি লাগার কথা। যদিও সময় বড় নিষ্ঠুর। যেমন ধরুন, সুমাইয়া ছবিটি পোস্ট করার পর অনেকেই তা শেয়ার করে নাজমুলকে মেনশন করেছেন। কেউ কেউ বোঝাতে চেয়েছেন, কোন ট্রফি নিয়ে এমন ছবি পোস্ট করতে হয় সেটা নারী দলের কাছ থেকে শেখার সুযোগ আছে। পাকিস্তানে সিরিজ জয়ের পর থেকে বাংলাদেশ ক্রিকেট দলের পারফরম্যান্স যেহেতু মোটেও ভালো নয় (৬ ম্যাচের ৬টিতেই হার, চলামান চট্টগ্রাম টেস্টেও হারের শঙ্কায়), তাই কারও কারও কাছে এমন কথা বাড়াবাড়ি মনে নাও হতে পারে।
তাই বলে নাজমুল নিজের দায়িত্ব ভুলে যানননি। জাতীয় দল বিচারে দেশের ক্রীড়াঙ্গনে এটা অন্যতম বড় সাফল্য। তবে শিরোপা ধরে রাখার বিচারে সবচেয়ে বড়। শিরোপা জয়ের চেয়ে ধরে রাখার কাজটা আরও কঠিন, সেটাও আবার আন্তর্জাতিক টুর্নামেন্টের ফাইনালে স্বাগতিক দলকে হারিয়ে! মেয়েরা সেই চ্যালেঞ্জও উতরে দক্ষিণ এশিয়ার নারী ফুটবলে শ্রেষ্ঠত্বের মুকুট ধরে রাখার পর ফেসবুকে সাবিনা খাতুনের দলকে অভিনন্দন জানিয়েছেন নাজমুল, ‘বাংলাদেশ ফুটবলের জন্য জাদুকরি রাত। অভিনন্দন।’ তামিম ইকবালের পোস্ট, ‘বাংলাদেশের খেলাধুলা ও বাংলাদেশের ফুটবলের জন্য অসাধারণ মুহূর্ত। মেয়েদের অনেক বড় অভিনন্দন।’ লিটন দাস পোস্ট করেছেন ছবি ও ইমোজি। মাশরাফি বিন মর্তুজা লিখেছেন, ‘আগেরবার ছিল স্বপ্ন পূরণের অনির্বচনীয় আনন্দ, এবার প্রত্যাশা পূরণের উত্তুঙ্গ উচ্ছ্বাস। ওরা অদম্য, ওরা অপ্রতিরোধ্য, ওরা বাংলাদেশের মুখ...। অভিনন্দন বাংলার মেয়েদের।’
মাশরাফির একটি লাইন নিতেই হয়—‘ওরা বাংলাদেশের মুখ।’ আন্তর্জাতিক ক্রীড়াঙ্গন বিচারে এই মুহূর্তে একদম নির্ভেজাল সত্যি কথা। বাংলাদেশের ছেলেদের ক্রিকেট দল এখনো কোনো আন্তর্জাতিক টুর্নামেন্ট জিততে পারেনি। মেয়েদের ক্রিকেট দল ২০১৮ সালে জিতেছিল এশিয়া কাপ। কিন্তু আন্তর্জাতিক টুর্নামেন্টে চ্যাম্পিয়ন হয়ে পরের টুর্নামেন্টেই জাতীয় দলের শিরোপা ধরে রাখার স্বাদটা এর আগে কখনো পায়নি বাংলাদেশ। গতকাল রাতে সেই পরম স্বাদ জিবে মাখতে মাখতে মনে একটি ভাবনারও উদ্রেক হতে পারে, গত চার–পাঁচ বছরে দলীয় খেলাধুলায় সবচেয়ে উন্নতি করেছে তো মেয়েদের এই ফুটবল দলটাই!
তাই ট্রফিসহ বিছানায় ঘুমের অভিনয় কিংবা ঘুম অথবা ধেই ধেই করে নাচ—মেয়েরা যাই করুক না কেন, তাতে যেমন গর্ব লাগে, শান্তি শান্তি একটা ভাব জাগে, তেমনি আবেগে অন্যরকম এক অনুভূতিও জাগতে পারে। মেয়েদের ট্রফিসহ ঘুমানোর ছবিগুলো আরেকবার দেখুন। এক অতি মনোহর দৃশ্যের সঙ্গে কি মিল খুঁজে পান? মা যেমন পরম মমতায় সদ্যজাতকে পাশে রেখে ঘুমায়, ছবিগুলোও কি তেমন নয়! ব্যক্তিজীবনের লড়াইয়ে বেশির ভাগ দিনই হেরে জিবে তেতো স্বাদ নিয়ে বাড়ি ফেরার পর এমন ছবি দেখে কি মনে হয় না, এই সাফল্য আমারও!
যদি মনে হয় সেটুকু প্রেরণা। মনে না হলেও অসুবিধা নেই। খেলাধুলার কাজই হলো, হরেকরকম প্রেরণা নিয়ে প্রতি মুহূর্তে আপনার মনের দরজায় ‘নক’ করা। এই মেয়েদের শেকড় খুঁজে দেখুন, যে দূর্লঙ্ঘ্য পথ পাড়ি দিয়ে তাঁরা বাংলাদেশকে নিয়ে গেছেন এতটা উঁচুতে, সেজন্য তেজ লাগে, দম লাগে! সেই তেজ ও দমের জোরে সাফল্য ছিনিয়ে আনার পর একটু বিশ্রাম তো নিতে হয়। ঘুমের চেয়ে বড় বিশ্রাম আর কী হতে পারে! আর সেই ঘুমে শান্তির পরশ মাখতে মা যেমন সন্তানকে পাশে রাখেন, তেমনি ওই ট্রফিটাও শোভা পেয়েছে সুমাইয়া–শামসুন্নাহারদের পাশে। মায়ের কাছে সন্তান যেমন সবচেয়ে আকাঙ্ক্ষিত, সুমাইয়াদের কাছে তেমনি ট্রফিটাও। নেপালে যাওয়ার আগে এই ট্রফিটা জয় ছাড়া আর কোনো ভাবনা তো ছিল না!
আসলে এমন ভাবনা কিংবা জয়ের উদগ্র বাসনাই মানুষকে বড় করে তোলে। কিছু বড় মানুষের গল্প বলা যাক। ১৯৭৮ ইউরোপিয়ান কাপ (চ্যাম্পিয়নস লিগ) জয়ের পর ট্রফিটি বিছানায় রেখে দিয়েছিলেন লিভারপুল কিংবদন্তি কেনি ডালগ্লিশ। তার পাঁচ বছর আগে ১৯৭৩ সালে সান্ডারল্যান্ডের হয়ে এফএ কাপ জয়ের পর ট্রফি বিছানায় রেখে সংবাদপত্র পড়ার ছবি তুলেছিলেন ক্লাব কিংবদন্তি ববি কার। বায়ার্ন মিউনিখের ‘দ্য বুল’খ্যাত সাবেক মিডফিল্ডার ফ্রাঞ্জ রথ ১৯৬৭ সালে অধুনালুপ্ত ইউরোপিয়ান কাপ উইনার্স কাপ জয়ের পর ট্রফিটি চোখের আড়াল করতে চাননি। তাই ট্রফিটি নিয়েই চলে গিয়েছিলেন বিছানায়।
সাতবার গ্র্যান্ড স্লামজয়ী সুইডেনের টেনিস কিংবদন্তি ম্যাটস ভিল্যান্ডার আবার এককাঠি সরেস। তিনি নিজের শোবার কক্ষকেই বানিয়ে ফেলেছিলেন ট্রফি রাখার কামরা! টেনিস কিংবদন্তি সেরেনা উইলিয়ামস ২০০৫ অস্ট্রেলিয়ান ওপেন জয়ের পর বিছানায় ট্রফি রেখে ছবি তুলেছেন। বার্সেলোনা তারকা রবার্ট লেভানডফস্কি বায়ার্ন মিউনিখে থাকতে ২০২০ সালে চ্যাম্পিয়নস লিগ জয়ের পর ট্রফি নিয়ে ছবি তুলেছিলেন বিছানায়।
তেমনই বিছানায় ট্রফিসহ আমাদের মেয়েদের ঘুমানোর এসব ছবি চাইলে বাঁধাই করে রাখতে পারেন মনের মুকুরে। জীবনে পিছিয়ে পড়তে পড়তে যখন দেয়ালে পিঠ ঠেকে যাবে, তখন টনিকের কাজ করতে পারে এমন ছবি। কিংবা ছবিগুলো দেখিয়ে পরবর্তী প্রজন্মকে এই মেয়েদের গল্প শুনিয়ে বলতে পারেন কবি দেবব্রত সিংহের ‘তেজ’ কবিতার সেই লাইনটি—
‘খাড়া পাহাড়ে উঠা যে কী জিনিস/বহুত দম লাগে, বহুত তেজ লাগে।’