বার্সেলোনার জিয়নকাঠি জাভি
বার্সেলোনার ইতিহাসের অন্যতম দুর্দশার মুহূর্তে ডাগআউট ছিলেন তিনি। শুধু ছিলেনই না, ‘দায়ী ব্যক্তি’ হিসেবে প্রথম কোপটাও পড়েছিল তাঁর কাঁধে। তিন দিন পরই ছাঁটাই হয়েছিলেন কোচের চাকরি থেকে। এই ‘তিনি’ কিকে সেতিয়েন। আর দুর্দশার মুহূর্তটি ২০২০ সালের ১৪ আগস্টে।
সেদিন পর্তুগাল রাজধানীতে চ্যাম্পিয়নস লিগের কোয়ার্টার ফাইনালে বায়ার্ন মিউনিখের কাছে ৮–২ গোলে বিধ্বস্ত হয়েছিল বার্সা। বার্সার ইতিহাসে সেটি ৭৪ বছর পর প্রথম ৮ গোল হজমের নজির, ৬৯ বছর পর ৬ গোল ব্যবধানে প্রথম হার।
সেই সেতিয়েন রোববার রাতে ভিয়ারিয়ালের হয়ে বার্সেলোনার মুখোমুখি হয়েছিলেন। ম্যাচ শেষে সাবেক দলকে নিয়ে সেতিয়েনের পর্যবেক্ষণ ছিল এমন, ‘বার্সেলোনা অনেক বদলে গেছে, এর পেছনে কিছু বিষয় তো আছেই।’ সেই ‘কিছু’টা কী—সে ব্যাখ্যা সেতিয়েন দেননি বা দিতে পারেননি। তবে বদলে যাওয়ার ধরন নিয়ে ধারণা দিয়েছেন কিছুটা, ‘প্রতিপক্ষের রক্ষণে চাপ সৃষ্টি করার ব্যাপারটা বেশ বেড়েছে। বল ছাড়াও বেশ ভালো খেলে।’
বার্সার ‘চাপ’ অনুভব করা ম্যাচটিতে সেতিয়েনের দল হেরেছে ১–০ ব্যবধানে। এমন আহামরি কোনো ব্যবধানের হার নয়। তারপরও বার্সাকে দেখে ভালোমতোই বদল টের পেয়েছেন সেতিয়েন। যে দলটিকে আড়াই বছর আগে ছন্নছাড়া অবস্থায় রেখে গিয়েছিলেন, সেই দলটি এখন রক্ষণ–আক্রমণে অনেক বেশি জমাট, অনেক বেশি ধারাবাহিক। ভিয়ারিয়ালের বিপক্ষে বার্সার জয়টি ছিল লা লিগায় টানা ষষ্ঠ, সব প্রতিযোগিতা মিলিয়ে টানা ১১তম। এবারের মৌসুমে প্রথম ২১ ম্যাচের সাতটিতেই প্রতিপক্ষের জালে মাত্র ১ গোল দিয়ে ৩ পয়েন্ট তুলে নিয়েছে বার্সা।
মাত্র একটি গোল করেই নিজেদের জাল অক্ষত রেখে এত বেশি জয় চলতি শতাব্দীতেই আর পায়নি বার্সেলোনা। শেষবার ১–০ ব্যবধানে সাতটি জয় এসেছিল সেই ১৯৯৬–৯৭ মৌসুমে। খেলতে হয়েছিল ৪২ ম্যাচ; এবার যা ছোঁয়া হয়ে গেল অর্ধেক ম্যাচেই।
জমাট, গোছালো আর ধারাবাহিক এই বার্সেলোনার মূলে কি জাভি হার্নান্দেজ? বার্সেলোনা তাদের ক্লাব ইতিহাসের অন্যতম সেরা মিডফিল্ডারকে কোচ হিসেবে নিয়োগ দেয় ২০২০ সালের নভেম্বরে। সেতিয়েনকে সরিয়ে ক্লাবের আরেক কিংবদন্তি রোনাল্ড কোমানকে দায়িত্ব দেওয়া হয়েছিল। কিন্তু নেদারল্যান্ডসের চাকরি ছেড়ে আসা কোমান বার্সেলোনাকে দুরবস্থা থেকে টেনে তুলতে পারেননি। উল্টো কাতালান ক্লাবটি চ্যাম্পিয়নস লিগ থেকে নেমে যায় ইউরোপায়, লা লিগায় হয় তৃতীয়। এর মধ্যে আর্থিক টানাটানির জেরে ক্লাব ছেড়ে যান লিওনেল মেসিও।
এমন দুর্দিনেই বার্সেলোনার কোচ হন জাভি। ক্লাবের কাছে তখন খেলোয়াড় কেনার মতো পর্যাপ্ত অর্থ নেই, ঋণের পরিমাণ প্রায় ১ বিলিয়ন ইউরো। তবু কীভাবে কীভাবে যেন, ৯ নম্বরে থাকা দলকে নিয়ে লিগ শেষ করেন দুইয়ে থেকে। ইউরোপা লিগে অবশ্য যাত্রা থেমে যায় কোয়ার্টার ফাইনালে।
জাভির হাতে দেখেশুনে খেলোয়াড় বেচাকেনার প্রথম সুযোগ আসে ২০২২ সালের গ্রীষ্মে। ক্যাম্প ন্যুতে সংযোজন ঘটে রবার্ট লেভানডভস্কি, ফ্রাঙ্ক কিসে, জুলস কুন্দে, রাফিনিয়াদের। এর পরের গল্পটা চলছে। কোচের দায়িত্ব নিয়ে প্রথমেই একটা বড়সড় ধাক্কা খেয়েছিলেন জাভি। আবারও চ্যাম্পিয়নস লিগের গ্রুপ পর্ব থেকে বাদ পড়ে বার্সেলোনা। কিন্তু সময় গড়ানোর সঙ্গে সঙ্গে গুছিয়েও উঠেছে জাভির দল। লিগের পয়েন্ট তালিকা বলছে, এ মুহূর্তে বার্সেলোনার ধারেকাছে কেউ নেই। ২১ ম্যাচে ৫৬ পয়েন্ট নিয়ে অবস্থান শীর্ষে। বর্তমান চ্যাম্পিয়ন রিয়াল মাদ্রিদ পিছিয়ে ১১ পয়েন্ট ব্যবধানে।
এর মধ্যে ক্যাম্প ন্যুতে যোগ হয়েছে নতুন ট্রফিও। সৌদি আরবে অনুষ্ঠিত ‘এল ক্লাসিকো’য় রিয়াল মাদ্রিদকে হারিয়ে স্প্যানিশ সুপার কাপ জিতে নিয়েছে বার্সেলোনা। ২০২০–২১ কোপা দেল রের পর বার্সার জেতা প্রথম ট্রফি, যা কিনা মেসিবিহীন বার্সারই চলতি শতাব্দীতে প্রথম শিরোপা!
শিরোপায় বছর শুরুর সেই ছন্দই ধরে রেখেছেন লেভানডভস্কি, পেদ্রি, গাভিরা। সব প্রতিযোগিতা মিলিয়ে বার্সার টানা জয়ের সংখ্যা এখন ১১। টানা ১১ জয়ের কীর্তি গড়েছিলেন পেপ গার্দিওলাও। সেই দলের অংশ থাকা জাভি এখন নিজেও গুরুর পাশে। অন্য একটা কীর্তিতে অবশ্য গুরুকে টপকে গেছেন জাভি। লিগে তাঁর অধীনে খেলা ৪৭ ম্যাচে ১১২ পয়েন্ট পেয়েছে বার্সেলোনা। যেখানে গার্দিওলার প্রথম ৪৭ ম্যাচে বার্সার পয়েন্ট ছিল ১১০।
প্রথম ৪৭ ম্যাচে সবচেয়ে বেশি ১১৫ পয়েন্ট নিয়ে শীর্ষে লুইস এনরিকে। তবে এনরিকে বা গার্দিওলা কিংবা ১১১ পয়েন্ট তোলা আর্নেস্তো ভালভের্দে—সবার চেয়ে একটি জায়গায় এগিয়ে জাভি। তিনজনই নিজেদের দলে মেসিকে পেয়েছিলেন। এনরিকে বাড়তি পেয়েছিলেন নেইমার, সুয়ারেজের মতো সেরা সময়ে থাকা ফরোয়ার্ড আর জাভি–ইনিয়েস্তার মতো সৃষ্টিশীল মিডফিল্ডার। জাভির বার্সেলোনায় মেসির মতো কেউ নেই, কিন্তু তাতে খুব একটা সমস্যাও হচ্ছে না। লা লিগায় প্রথম ২৫ ‘অ্যাওয়ে’ ম্যাচের ২৪টিতেই অপরাজিত থাকা কোচই–বা আর কে আছেন?
উত্তর যদি ‘না’ হয়, তাহলে বার্সার ঘুরে দাঁড়ানোর কারিগর তো জাভি হার্নান্দেজই!