ফুটবলের আরব্য রজনীতে নতুন এক গল্পের অপেক্ষা আজ
আরব্য রজনীতে সম্রাট শাহরিয়ারকে গল্প শোনাতেন শেহেরজাদ। বিচিত্র ধরনের সেই গল্পগুলো খুলে দিত কল্পনা–রাজ্যের অনেক দ্বার। একেকটি গল্প রুদ্ধশ্বাস ও তুমুল উত্তেজনায় ভরপুর। আরব্য রজনী ও শেহেরজাদের সেই গল্পগুলো অবশ্য আমরা পেছনে ফেলে এসেছি। দাওয়ায় বসে গল্প বলার সেই আয়েশি দিনও আর নেই।
কিন্তু এ সময়ে এসে মিম কিংবা জেন-জি প্রজন্মকে যদি নতুন করে আরব্য রজনীর গল্প বলা হয়, তবে কেমন হবে সেই গল্প? কেমন হবে তার চরিত্র ও উপখ্যানগুলো? ফুটবলের রোমাঞ্চকর গল্পগুলো নিশ্চয়ই সেখানে যোগ হবে। আর ফুটবল এলে নিশ্চিতভাবে আসবে ‘এল ক্লাসিকো’ও। রিয়াল মাদ্রিদ ও বার্সেলোনার আগুনে গল্প ছাড়া এই রূপকথা তো অপূর্ণই!
এই একটি ম্যাচেই যে লেখা হয়, আরব্য রজনীর সহস্র রাতের গল্প। যে গল্পে কুশীলব বদলাতে পারে কিন্তু গল্পের মর্যাদা ও উত্তাপ একটুও কমে না। প্রায় শত বছর ধরে ফুটবল বললে মানুষ রিয়াল-বার্সার এই দ্বৈরথগুলোকেই সব সময় ওপরের দিকে রেখেছে। জেদ্দায় আজ রাত একটায় সেই দ্বৈরথেরই আরও একটা পর্ব, স্প্যানিশ সুপার কাপের ফাইনাল।
ম্যাচের সময় হিসাব করলে এল ক্লাসিকোর ইতিহাস ১২৩ বছরের পুরোনো। এই সময়ে অসংখ্য ধ্রুপদি ম্যাচ উপহার দিয়েছে দুই দল। দীর্ঘ পথচলায় উত্তেজনার অবশ্য রকমফের হয়েছে। আধিপত্যের রূপও বদলেছে। কখনো কখনো ধস নেমেছে জনপ্রিয়তাতে। কিন্তু এত কিছুর পরও এল ক্লাসিকো কখনো তার ধ্রুপদি মান হারায়নি।
এল ক্লাসিকোর ইতিহাস ১০০ বছরের বেশি পুরোনো হলেও এর জনপ্রিয়তা ও রোমাঞ্চ চূড়া স্পর্শ করেছে ১৯৫০–এর দশকে। স্পেন সে সময় অর্থনৈতিক ও সামাজিকভাবে ব্যাপক পরিবর্তনের ভেতর দিয়ে যাচ্ছিল। এক হিসাবে দেখা গেছে, ১৯৬৩ থেকে ১৯৭১–এর মধ্যে দেশটির মাথাপিছু আয় দ্বিগুণ হয়ে যায়।
আর এই সামাজিক ও অর্থনৈতিক পরিবর্তনের মধ্যেই ১৯৫৯ সালে প্রথমবারের মতো টেলিভিশনে সম্প্রচার করা হয় রিয়াল–বার্সার এল ক্লাসিকো। এই ম্যাচ ঘিরে সে সময় স্পেনে টেলিভিশন কেনার ধুম পড়ে। এর পর থেকেই মূলত ধ্রুপদি মাত্রা পেতে শুরু করে রিয়াল–বার্সার দ্বৈরথ, যা আজ ফুটবল তো বটেই, ক্রীড়া দুনিয়ার অন্যতম সেরা লড়াইগুলোর একটি।
বিখ্যাত ফুটবল লেখক সিড লো তাঁর ‘ফিয়ার অ্যান্ড লোদিং ইন লা লিগা’ বইয়ে এল ক্লাসিকোকে তুলনা করেছিলেন জীবন ও মৃত্যুর সঙ্গে। আরব্য রজনীর গল্পের সঙ্গে কী এক কাকতালীয় মিল। আরব্য রজনীতে শেহেরজাদ ও মৃত্যুর মাঝে দেয়াল হয়ে দাঁড়িয়ে ছিল গল্পগুলো। এই উপাখ্যানগুলোই অত্যাচারী শাহরিয়ারের হাত থেকে বাঁচিয়ে দিয়েছিল শেহেরজাদকে। একইভাবে প্রতীকী অর্থে জীবন ও মৃত্যুকে ছাপিয়ে যাওয়া এল ক্লাসিকোকে আরও বেশি মাহাত্ম্যপূর্ণ করে তোলে এই দ্বৈরথকে ঘিরে জমা হওয়া গল্পগুলো।
সৌদি আবরে এ নিয়ে টানা তিন মৌসুমে সুপার কাপ ফাইনালে মুখোমুখি হতে যাচ্ছে রিয়াল–বার্সা। এল ক্লাসিকোর এই লড়াইটা বর্তমানে ১-১ ড্র।
সৌদি আবরে এ নিয়ে টানা তিন মৌসুমে সুপার কাপ ফাইনালে মুখোমুখি হতে যাচ্ছে রিয়াল–বার্সা। এল ক্লাসিকোর এই লড়াইটা বর্তমানে ১-১ ড্র। ২০২৩ সালে বার্সেলোনা জেতার পর ২০২৪ সালে জিতেছে রিয়াল মাদ্রিদ। আজ যেকোনো এক দলের এগিয়ে যাওয়ার পালা। রিয়ালের জন্য অবশ্য এই ম্যাচটা আরেকটা দিক থেকে গুরুত্বপূর্ণ। আজ জিতলে সুপার কাপে সর্বোচ্চ ১৪ শিরোপা জেতায় তারা ছুঁয়ে ফেলবে বার্সাকে। আর বার্সার লক্ষ্য থাকবে আজ শিরোপা জিতে ব্যবধানটা আরেকটু বাড়িয়ে নেওয়ার।
আজকের ম্যাচটিতে অবশ্য কাউকেই নিরঙ্কুশ ফেবারিট বলা যাচ্ছে না। সাম্প্রতিক পারফরম্যান্স বা পরিসংখ্যান কোনোটাই আলাদা করে কাউকে এগিয়ে রাখতে পারছে না। মায়োর্কার বিপক্ষে সেমিফাইনালে জেতার পর একই কথা বলেছেন রিয়াল কোচ কার্লো আনচেলত্তিও। তাঁর মতে, সাম্প্রতিক সময়ে এল ক্লাসিকো নিয়ে ভবিষ্যদ্বাণী করা কঠিন হয়ে দাঁড়িয়েছে।
কারণ, এর মধ্যে দুই দলই একে অন্যের কাছে বড় ব্যবধানে হেরেছে সম্প্রতি। সর্বশেষ সুপারকাপের ফাইনালে রিয়াল ৪–১ গোলে উড়িয়ে দিয়েছিল বার্সাকে। আর লা লিগায় চলতি মৌসুমের প্রথম লেগে বার্নাব্যুতে গিয়ে বার্সা জিতেছিল ৪–০ গোলে। এমনকি দুই দলের তারকাদের মুখোমুখি দাঁড় করালেও কারও একাধিপত্যের দেখা মিলবে না।
এরপরও সর্বশেষ ম্যাচটিকে দৃষ্টান্ত হিসেবে নিলে বার্সাকে খানিকটা এগিয়ে রাখতেই হবে। বিশেষ করে বার্নাব্যুতে গিয়ে যেভাবে রিয়ালকে বিধ্বস্ত করে এসেছিল, তা অনেক দিন মনে রাখার মতো। সেদিন রিয়াল কোচ আনচেলত্তিকে রীতিমতো টেকটিক্যাল ‘মাস্টারক্লাস’ দিয়ে এসেছিলেন বার্সেলোনা কোচ হ্যান্সি ফ্লিক।
তর্কযোগ্যভাবে বর্তমান সময়ের সেরা আক্রমণভাগকে হাইলাইন ডিফেন্সের দুঃস্বপ্ন উপহার দিয়েছিলেন ফ্লিক। এমবাপ্পে-ভিনিসিয়ুস–বেলিংহামরা অনেক চেষ্টা করেও ভাঙতে পারেননি ফ্লিকের তৈরি করা অফসাইড ফাঁদ। অক্টোবরের সেই ম্যাচটিতে রিয়ালের আক্রমণভাগের খেলোয়াড়েরা সব মিলিয়ে ১২ বার অফসাইডের ফাঁদে পা দিয়েছিলেন। যেখানে এমবাপ্পে একাই অফসাইডে পা দেন ৮ বার!
বার্সার জন্য ম্যাচটা সেই ধারাবাহিকতা ধরে রাখার হলেও রিয়ালের জন্য প্রতিশোধের। এই প্রতিশোধ শুধু ম্যাচ হারার নয়, অপমানেরও। ঘরের মাঠে নাস্তানাবুদ হওয়ার। সেদিন বড় ঝড়টা গিয়েছিল এমবাপ্পে–ভিনিসিয়ুস–বেলিংহামদের ওপর। আজ বার্সাকে হারিয়ে নিশ্চয় সেদিনের যন্ত্রণা ভুলতে মরিয়া থাকবেন এই তিনজন।
তারকা দ্যুতির কারণেও আজকের ম্যাচে চোখ থাকবে বিশেষভাবে। ট্রান্সফারমার্কেটের হিসাবে, এই ম্যাচের চার বড় তারকা এমবাপ্পে, ভিনিসিয়ুস, ইয়ামাল ও বেলিংহামের সম্মিলিত দাম ৭২ কোটি ডলার, যা কিনা আতলেতিকো মাদ্রিদ, ইন্টার মিলান কিংবা জুভেন্টাসের পুরো স্কোয়াডের চেয়ে বেশি। অবিশ্বাস্য!
সব মিলিয়ে শিরোপা লড়াইয়ের পাশাপাশি নতুন বছরের সুর বেঁধে দেওয়ার জন্যও আজকের ম্যাচটি বেশ গুরুত্বপূর্ণ। চিরপ্রতিদ্বন্দ্বীদের হারিয়ে আত্মবিশ্বাসের চূড়ায় থেকে নতুন বছর শুরু করতে চাইবে দুই দলই। উভয় পক্ষের এই মরিয়া চাওয়াই এই দ্বৈরথের গায়ে নতুন রং চড়াবে। তাতেই হয়তো লেখা হবে ফুটবলের আরব্য রজনীতে নতুন এক গল্প!