উৎপল শুভ্রর লেখা
শান্তিতে ঘুমান, ফুটবলের রাজা
গত বছর এই দিনেই ফুটবল-বিশ্বকে শোকে ডুবিয়ে চলে গিয়েছিলেন পেলে। আর ফুটবল-বিশ্ব মানে তো পুরো বিশ্বই। তর্কযোগ্যভাবে সর্বকালের সেরা ফুটবলারের প্রথম মৃত্যুবার্ষিকীতে তাঁকে নিয়ে উৎপল শুভ্রর লেখাটা আবার প্রকাশ করা হলো।
একদিন মানুষের মুখে মুখে ফিরবে বলেই কি অত বড় নামটা এমন ছোট্ট আর সহজ হয়ে গিয়েছিল! হয়ে গিয়েছিল ঘটনাচক্রেই। বিখ্যাত আবিষ্কারক টমাস এডিসনের নামে মা–বাবা নাম রেখেছিলেন এডসন আরান্তেস দো নাসিমেন্তো। সেটাই হয়ে গেল পেলে। আসলে ছিল বিলে। ছোটদের খেলায় দারুণ গোলকিপিং করায় বন্ধুরা সে সময় ব্রাজিলে বিখ্যাত এক গোলকিপার ‘বিলে’র নামে ডাকা শুরু করলেন এডসনকে। মূলত বন্ধুকে খ্যাপাতেই। মুখে মুখে সেই বিলে হয়ে গেল পেলে।
এডসন আরান্তেস দো নাসিমেন্তো কীভাবে ভাববেন, তাঁর চরম অপছন্দের সেই ‘পেলে’ নামটাই একদিন এমন বিখ্যাত হয়ে যাবে! এতটাই যে ওই নামটা শোনেনি, পৃথিবীতে এমন কোনো মানুষ খুঁজে পাওয়া কঠিন হবে। বিখ্যাত শুধুই ফুটবল খেলে। তা ফুটবলটা এমনভাবে আর কেউ খেলেছেন নাকি! ৮২ বছর বয়সে এই মর্ত্যধাম থেকে চলে যাওয়ার পর পেলেকে নিয়ে যত প্রশস্তি শুনছেন, তার মূল কারণও ওটাই। একমাত্র ফুটবলার হিসেবে তিনটি বিশ্বকাপ জিতেছেন, গোল করেছেন হাজারের বেশি—এসবও অবশ্যই কারণ। তবে পেলে নামে মানুষ যে এমন পাগল হয়ে যেত, যুদ্ধ থেমে যেত তাঁর খেলা দেখতে, এর আসল কারণ তো তাঁর অবিশ্বাস্য সৃষ্টিশীলতা। মাঠে কোনো বিশেষ একটা পরিস্থিতিতে একজন ফুটবলার সম্ভাব্য যা করতে পারেন বলে সবাই ভাবতেন, বেশির ভাগ সময়ই পেলে করতেন তার বাইরের কিছু। বাকি জীবন যা দর্শকের চোখে লেগে থাকত।
বড় ফুটবলারের কিছু গুণ তো কমনই। তারপরও একেকজনের একেকটা শক্তির জায়গা থাকে। দুর্বলতাও। কারও ডান পা ভালো তো কারও বাঁ পা। কেউ খুব ভালো ড্রিবলার তো কারও হেডওয়ার্ক দুর্দান্ত। কেউ ভালো স্কোরার, কেউবা খেলাটা তৈরি করে দেন। বিরল, খুবই বিরল কিছু ফুটবলারের এর সবকিছুই থাকে। কোনোটা বেশি, কোনোটা কম। পেলে সেই বিরলদের মধ্যেও বিরলতম, যাঁর কমবেশি কিছু নেই।
দুর্বলতা বলে যে কিছু ছিল না। শুধু দুই পা আর মাথাই নয়, ফুটবলটা খেলতেন পুরো শরীর দিয়েই। ছটফটে ওই চর্মগোলকটা যেন কোনো এক জাদুমন্ত্রবলে তাঁর বশীভূত হয়ে থাকত। তা গ্রেট ফুটবলারদের আরও অনেকের সম্পর্কেই তো বলা যায় এমন। পেলের বাড়তি যা ছিল, তা ওই কল্পনাশক্তি।
ফুটবল মাঠে এমন সব কাণ্ড করেছেন, পরে ভিডিওতে যা দেখে পেলে নিজেই অবাক হয়ে বলেছেন, সেকেন্ডের ভগ্নাংশের মধ্যে আমি সিদ্ধান্তটা কেমন করে নিয়েছিলাম! বিচিত্র উদ্ভাবনী ক্ষমতা এবং মাঠে তা প্রয়োগের সাহসের কারণেই পেলে পেলে হয়েছিলেন। সেসব আগে থেকেই ভেবেচিন্তে নেওয়া সিদ্ধান্ত নয়, তাৎক্ষণিকভাবে মাঠে নেওয়া। ১৯৭০ বিশ্বকাপজয়ী ব্রাজিলিয়ান অধিনায়ক কার্লোস আলবার্তো তো এক লাইনেই মূর্ত করে তুলেছিলেন পেলে-মহিমা, ‘পেলে মানেই হলো ইমপ্রোভাইজেশন।’
সব সময় যে সফল হয়েছেন, তা নয়। কিন্তু বিচিত্র ভাবনার প্রদর্শনীতেই দর্শক পাগল হয়ে যেত। না হলে পেলের উদ্ভাবনী চিন্তার সবচেয়ে বড় যে দুটি উদাহরণ, তার কোনোটিই তো গোলে রূপ পায়নি। দুটিই ১৯৭০ বিশ্বকাপে। প্রথমটি চেকোস্লোভাকিয়ার বিপক্ষে ম্যাচে। চেক গোলরক্ষক ভিক্টরের গোললাইন ছেড়ে একটু সামনে এসে দাঁড়িয়ে থাকার অভ্যাস ছিল। পেলে তা খেয়াল করে নিজেদের সীমানায় ৬৫ গজ দূর থেকে যে শটটি নিলেন, সেটি যে অল্পের জন্য গোল হলো না, তার হয়তো একটিই কারণ। মানুষ যে তাহলে তাঁকে আসলেই অতিমানবীয় কিছু ভেবে নিত! তারপরও পেলের চিন্তার দ্রুততা, অসম্ভবকে সম্ভব মনে করার দুঃসাহস মাঠের বাকি খেলোয়াড়দের বিমূঢ় করে দিয়েছিল।
অন্যটি আরও অভিনব। উরুগুয়ের বিপক্ষে কোয়ার্টার ফাইনালে পেলের ওই মুভকে ‘বিচিত্র চিন্তার দুঃসাহস’, ‘অসম্ভবের প্রতি আনন্দময় অভিযান’, ‘মানুষের সৃজনশীলতার অন্যতম শ্রেষ্ঠ প্রকাশ’—এত সব বলেও বিশেষজ্ঞরা তৃপ্তি পাননি। বাঁ দিক থেকে একটা আড়াআড়ি থ্রু বল এসেছিল। উরুগুইয়ান গোলরক্ষক মাজেরকুয়েজ, বল এবং পেলে একই সরলরেখায়। এবার পেলে কী করতে পারেন! যা করলেন, তা কারও কল্পনাতেও ছিল না। ডামি খেলে বলটা যেদিকে যাচ্ছিল, সেদিকেই যেতে দিয়ে পেলে সোজা দৌড়ে গেলেন। গোলরক্ষক ভারসাম্য হারিয়ে বাতাস খামচে ধরলেন। আর পেলে দৌড়ে গিয়ে গোলরক্ষকের পেছনে বলটা পায়ে নিলেন। একজন ডিফেন্ডার প্রথম পোস্টে চলে এসেছেন দেখে কোমরের অবিশ্বাস্য মোচড়ে বল ঘুরিয়ে দিলেন দ্বিতীয় পোস্টের দিকে। এক ইঞ্চির জন্য পোস্টের পাশ দিয়ে বলটা গড়িয়ে চলে গেল বাইরে। মাজেরকুয়েজ পরে বলেছিলেন, খেলোয়াড়ি জীবনে এমন অভিজ্ঞতার সঙ্গে আর পরিচয় হয়নি তাঁর। এতটাই হতভম্ব হয়ে পড়েছিলেন যে কিছুক্ষণের জন্য সংজ্ঞা হারিয়ে ফেলার দশাও নাকি হয়েছিল।
মাজেরকুয়েজের কথাটা পেলের জন্য বড় প্রশস্তি। এমন প্রশস্তি কতই–না হয়েছে। ববি চার্লটন একবার বলেছিলেন, ফুটবলের হয়তো সৃষ্টিই হয়েছিল এই জাদুকরি খেলোয়াড়ের জন্য। আরও ভালো বলেছিলেন ১৯৭০ বিশ্বকাপ ফাইনালে ব্রাজিলের প্রতিপক্ষ ইতালির ডিফেন্ডার তারসিজিও বার্গোমিচ, ‘আমি নিজেকে বলছিলাম, “সে–ও তো আমার মতো রক্তমাংসেরই মানুষ।” আমি ভুল বুঝেছিলাম।’
সেই বিশ্বকাপের সময়ই আইটিভি ওয়ার্ল্ড কাপ প্যানেলের দুই আলোচকের কথোপকথনের একটা অংশ তো ক্ল্যাসিক হয়ে আছে।
ম্যালকম অ্যালিসন, ‘তুমি কীভাবে পেলে বানান করো?’ প্যাট ক্রেনাল্ড, ‘সহজ। জি-ও-ডি।’
খেলোয়াড়ি জীবনজুড়েই মানুষকে এমন বিস্ময়ের অনুভূতিতে আচ্ছন্ন করে রেখেছেন পেলে। যত দিন খেলেছেন, দর্শকমনে আনন্দ ছড়িয়ে দেওয়াটাকেই মনে করেছেন কর্তব্য। ফুটবল তো তাঁর কাছে ছিল আনন্দের সবচেয়ে নিষ্কলুষ এক বাহন—দ্য বিউটিফুল গেম। ‘জোগো বনিতো’ শব্দযুগল এমন বিখ্যাতও তো তাঁরই জন্য। কথাটা প্রথম ব্যবহারও করেছেন পেলেই। তাৎক্ষণিক আনন্দ দেওয়াই শুধু নয়, খেলাটিতে তাঁর প্রভাব আরও সুদূরপ্রসারী। পেলে না এলে ফুটবল এত জনপ্রিয়তা পেয়ে এমন গণমানুষের খেলা হয়ে উঠতে পারত কি না, সন্দেহ হয়। ফুটবলকে আনন্দের বাহন করে তোলার সেই কাজও করেছেন চরম অবক্ষয়ের এক যুগে। ষাটের দশকে ফুটবল মাঠে যখন নির্বিচার মারধরের চর্চা, পেছন থেকে ট্যাকল করা আইনসিদ্ধ, সেই সময়ে ফুল ফুটিয়ে গেছেন পেলে। এখনকার মতো সুরক্ষা পেলে না জানি আরও কত কী করতেন!
যা করেছেন, সেটাই তো এখনো বিস্ময় জাগায়। পরের প্রজন্মের গ্রেট ফুটবলারদের যেসব বিশেষত্ব, তার সবই তিনি করে গেছেন সেই কতকাল আগে। ইউটিউবে সার্চ দিলেই যা পাওয়া যায়। ফুটবল তাঁকে পেলে বানিয়েছে। জীবনভরে সেই ঋণ শোধ করার চেষ্টা করে গেছেন। নিজেকে দেখতেন ফুটবলের দূত হিসেবে। বিশ্বকাপের সময় মৃত্যুশয্যায় শুয়ে থেকেও নেইমার-রোনালদো-মেসিদের উদ্দেশে দেওয়া বার্তাগুলো থেকেই যা আরও পরিষ্কার বোঝা যায়। হাজারতম গোল করার পর তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়ায় শিশু-কিশোরদের শিক্ষা নিয়ে কথা বলেছেন। তা শুধু লোকদেখানো ছিল না, সুন্দর ফুটবলের মতো সুন্দর একটা সমাজ, সুন্দর একটা পৃথিবীও দেখতে চেয়েছেন সারা জীবন।
সেই জীবন এর চেয়ে সার্থকও বোধ হয় আর হতে পারত না। শান্তিতে ঘুমান, ফুটবলের রাজা!