মেসি-রোনালদোর মিল-অমিলের গল্প
মানুষের ভাগ্য বৈচিত্র্যময়। আবার মানুষ চাইলে কি না পারে!
ভাগ্যের কথা বলা যাক। লিওনেল মেসি ও ক্রিস্টিয়ানো রোনালদো। কী ভাগ্য নিয়েই না তাঁরা জন্মেছেন! বলতে পারেন, ফুটবলে ব্যক্তিগত দ্বৈরথের অধ্যায়ে শিরোনাম তাঁরাই। কিন্তু এ তো ভাগ্যের ব্যাপার না, এ মেধা ও পরিশ্রমে নিজেদের প্রতিনিয়ত আরও ওপরে তোলার প্রতিদ্বন্দ্বিতা। তবে সেই প্রতিদ্বন্দ্বিতার পর্দা ভেদ করে আরও গভীরে তাকালে দেখা যায়, সৃষ্টিকর্তা তাঁদের মধ্যেও কোথাও না কোথাও মিল রেখেছেন।
হ্যাঁ, দুজনেই ফুটবলার। দীর্ঘদিন খেলেছেন ইউরোপের শীর্ষ লিগে, চ্যাম্পিয়নস লিগ জিতেছেন একাধিকবার, জিতেছেন একাধিক ব্যালন ডি’অর। কিন্তু এসব মিলও মেধা ও পরিশ্রমের মিশেলে গড়া, সৃষ্টিকর্তার সেখানে হাত থাকলেও মানুষের চেষ্টার অবদানই তাতে বেশি স্পষ্ট। খুঁজতে হবে এমন এক মিল, যেখানে তাঁদের কোনো হাত নেই।
মেসি–রোনালদোর জন্মের তারিখে একবার তাকানো যাক। আর্জেন্টাইন কিংবদন্তির জন্ম ২৪ জুন ১৯৮৭। পর্তুগিজ কিংবদন্তির জন্ম ৫ ফেব্রুয়ারি ১৯৮৫। তাঁদের জন্ম তারিখের মধ্যে ৮৬৯ দিনের ব্যবধান। রোনালদোর বড় ছেলে ক্রিস্টিয়ানো জুনিয়রের জন্ম তারিখ ১৭ জুন ২০১০। মেসির বড় ছেলে থিয়াগো মেসির জন্ম তারিখ ২ নভেম্বর ২০১২। দুজনের জন্ম তারিখের ব্যবধানও ৮৬৯ দিনই!
মেসি–রোনালদোকে নিয়ে আলোচনা–সমালোচনা কিংবা তর্ক–বিতর্কে একটি কথা প্রায়ই বলা হয়, সৃষ্টিকর্তা প্রদত্ত প্রতিভা না হলে এমন হয় না। অবশ্যই তা–ই। সবাই সম্ভবত প্রতিভা নিয়েই জন্মায়। পার্থক্য হয় চেষ্টায় এবং উঠে আসার পথে। মেসি–রোনালদোর সেই উঠে আসার পথে তাকিয়েই বলা যায়, মানুষ চাইলে কি না পারে!
আসছে ফেব্রুয়ারিতে চল্লিশ বছর পূর্ণ হবে রোনালদোর। পৃথিবীর বেশির ভাগ মানুষ এই বয়সে কী করেন, কী ভাবেন, আর রোনালদো কি করছেন! সৌদি প্রো লিগে গতকাল রাতে দামাকের বিপক্ষে আল নাসর জিতেছে ২–০ গোলে, দুটি গোলই রোনালদোর। এখনো সেই নোঙর ছেঁড়া দৌড়, গোল করার পর এখনো সেই শিশুর মতো হাসিতে উদ্যাপন, প্রাণশক্তিতে ভরপুর। আর এই প্রাণশক্তিই রোনালদোকে ধীরে ধীরে নিয়ে যাচ্ছে ফুটবলারদের স্বপ্নের এক চূড়ায়। ১০০০ গোলের সেই চূড়ায় পৌঁছাতে রোনালদোর চাই আর মাত্র ৮৫ গোল। তাঁর বয়স, প্রাণশক্তি ও গোলক্ষুধায় তাকিয়ে এই বাকি গোলসংখ্যাকে ‘মাত্র’ই বলতে হচ্ছে এবং তার ফুটবলীয় একটি কারণও আছে, যেটা স্রেফ অবিশ্বাস্য।
জাতীয় দল ও ক্লাব ক্যারিয়ার মিলিয়ে রোনালদোর ৯১৫ গোলের মধ্যে ৪৫২ গোলই বয়স ত্রিশ পার হওয়ার পর। ত্রিশের আগে করা গোলসংখ্যার চেয়ে মাত্র ১২টি গোল কম! এরই মধ্যে গুঞ্জন উঠেছে রোনালদো খেলতে পারেন ২০২৬ বিশ্বকাপেও। চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত এখনো জানা যায়নি। কিন্তু দুর্দান্ত ফিটনেস এবং হাজার গোলের প্রতি টানই তাঁকে নিয়ে যেতে পারে পরবর্তী বিশ্বকাপে। কিংবা ধরে নেওয়া যাক, দুই বছর পর অনুষ্ঠিত হতে যাওয়া বিশ্বকাপের আগেই তাঁর হাজার গোল হয়ে গেল। তখন কি রোনালদো খেলবেন সেই বিশ্বকাপে? আন্দাজে শুধু একটি সম্ভাবনা আঁচ করে নেওয়া যায় এবং তার কেন্দ্রে দাঁড়িয়ে মেসি!
ইউরোপিয়ান ক্লাব ফুটবলে থাকতে মেসি, রোনালদো—দুজনই একাধিকবার বলেছেন, আরও ভালো করার ক্ষেত্রে তাঁরা দুজন একে অপরকে সাহায্য করেছেন। কীভাবে? পাকিস্তান ক্রিকেটের দুই কিংবদন্তি ওয়াসিম আকরাম ও ওয়াকার ইউনিসের উদাহরণ টেনে ব্যাপারটি বোঝানো যায়। ওয়াসিম একবার বলেছিলেন, ‘ও (ওয়াকার) আজ ৫ উইকেট পেলে কাল আমি কেন পাবো না!’ এই প্রতিদ্বন্দ্বিতামূলক মানসিকতাই সব সীমারেখা ছাড়িয়ে তাঁদের এতটা ভালো করার কেন্দ্রবিন্দু, আর সেটাই তাঁদের পৌঁছে দিতে পারে ২০২৬ বিশ্বকাপে।
গত বিশ্বকাপ জয়ের পর থেকেই মেসিকে ২০২৬ বিশ্বকাপেও চাচ্ছে গোটা আর্জেন্টিনা। কিন্তু মেসি এ বিষয়ে দেখেশুনেই এগোচ্ছেন। ক্রিকেটে ব্যাটসম্যান যেভাবে প্রতিটি বল দেখেশুনে খেলেন, মেসিও তেমনি আগেই কোনো প্রতিশ্রুতি না দিয়ে আপাতত প্রতিটি দিন উপভোগ করার কথা বলে যাচ্ছেন। বড় কারণ তো এটাই যে মেসির জীবনে সর্বোচ্চ প্রাপ্তিটা এসে গেছে। বাকি যা কিছু, সবই বোনাস। রোনালদো ওদিকে বিশ্বকাপ জয়ের আশা ছেড়ে আপাতত হাজার গোলের নেশায় ছুটছেন। মেসি বিশ্বকাপ জিততে পারেন, কিন্তু হাজার গোলের দৌড়টা তাঁকে চিরপ্রতিদ্বন্দ্বির আগে শেষ করতেই হবে। তাহলে অন্তত ব্যক্তিগত ক্ষেত্রে এগিয়ে থেকে বুট তুলে রাখা যাবে। আর দুজনের লড়াইটাও তো ব্যক্তিগত, দলীয় নয়।
মেসি গোলের সেই লড়াইয়ে রোনালদোর সঙ্গে ৬৫ গোল ব্যবধানে পিছিয়ে (৮৫০)। ত্রিশ পার করে তাঁর গোলসংখ্যা ২৮৫। কিন্তু এই পরিসংখ্যানে তাকিয়ে রোনালদোর চেয়ে মেসিকে একটু খাটো করে দেখা নেহাত বোকামি। দুজনেই এখন দুই মহাদেশের ফুটবলে বিপ্লব ঘটাতে ব্যস্ত এবং সেই পথে দুজনেই এগিয়েছেন অনেকটা পথ। ইউরোপ জয় করে অন্য মহাদেশও জয়ের এ চেষ্টা কিংবা কারও কারও চোখে জিতে নেওয়াকে আপনি কি বলবেন? সেটাও এই বয়সে? ওই তো, আবারও ওই কথাটাই—মানুষ চাইলে কি না পারে!
এই চাওয়াই মেসি–রোনালদোকে মিলিয়ে দিয়েছে একবিন্দুতে। ঠিক যেভাবে জন্ম তারিখের মধ্যে ব্যবধানেও তাঁরা দুজন এবং তাঁদের দুই বড় সন্তান মিলেছেন এক বিন্দুতে। জন্ম তারিখ এবং দিনের পার্থক্যের এই সংখ্যাটা খাতাকলমে লেখা যায় এবং দেখা যায় বলেই লোকের কাছে এটা হয়তো ‘ফ্যাক্ট’। কিন্তু ওই চাওয়াটা তো দেখা যায় না, শুধু তার প্রতিফলন আমরা দেখছি, অনুভব করছি। বলুন তো, সেই চাওয়াটা কি দুজনের মধ্যে সৃষ্টিকর্তা প্রদত্ত মিল নয়? হতে পারে তা অদৃশ্য কিন্তু মোহনা তো একই।
যে প্রশ্নের কখনো সঠিক উত্তর কেউ দিতে পারবে না, কিংবা উত্তর দেওয়ার পর কোথাও না কোথাও কিছু দ্বিধা অবশিষ্ট থেকে যাবে, সেই প্রশ্নটাই আসলে একটা বোকামি—মেসি ও রোনালদোর মধ্যে কে সেরা? এর উত্তর দিতে গিয়ে আমরা প্রচুর পার্থক্য টেনে আনি দুজনের মধ্যে। অথচ দেখার কথা ছিল মিলগুলো। দেখার কথা ছিল, পৃথিবীর এই দুই বিষ্ময় কীভাবে দিনের পর দিন একই চাওয়ার মোহনায় মিলে মানুষকে অপার আনন্দ দিয়ে যাচ্ছেন!
শুধু মানুষ নয়, সৃষ্টিকর্তাও জানেন, মানুষে মানুষে মিল অন্যদের এমনিতেই সহ্য হয় না। আর ব্যাপারটা দুজন বিশেষ মানুষের মধ্যে হলে তো কথাই নেই। আচ্ছা, এই যে দুজন বিশেষ মানুষের কথা বলা হলো, সেটাও তো একটা মিল, তাই না!