বেনজেমার জয় হাল না ছাড়া মানুষেরও জয়
দুই দিন আগে নানা বিতর্কের মধ্যে বাংলাদেশে গান গেয়ে গেছেন কবির সুমন। করিম বেনজেমা প্রথমবারের মতো ব্যালন ডি’অর জেতার পর থেকেই সুমনের একটি গানের লাইন বারবার মনে পড়ছে, ‘হাল ছেড়ো না বন্ধু, বরং কণ্ঠ ছাড়ো জোরে।’
এই মুহূর্তে গানের এই লাইনটির সার্থকতা বেনজেমা ছাড়া আর কেইবা ভালো বোঝাতে পারবেন! হাল না ছাড়া মানুষের প্রতীকও তাঁর চেয়ে ভালো, আর কে হতে পারবেন?
বেনজেমার হাল না ছাড়ার গল্প বলার আগে একটি ছবির গল্প বলা যাক। সেই ছবিটির কথা আপনাদেরও নিশ্চয় মনে আছে। পুরস্কার হাতে সামনের সারিতে দাঁড়িয়ে আছেন ক্রিস্টিয়ানো রোনালদো, টনি ক্রুস ও সের্হিও রামোস। একটু পেছনে দাঁড়িয়ে হাসি মুখে তালি দিয়ে যাচ্ছেন বেনজেমা। সেই হাসিটি কি ভালোভাবে লক্ষ্য করেছেন? গভীর অর্থটা ধরতে চেয়েছেন?
হাসিরও অনেক রকম অর্থ হয়। বেনজেমার সেই হাসিরও ছিল। আড়াল করা হাহাকার। আর ছিল বিশালাকার গ্রহের আড়ালে উপগ্রহ হয়ে থাকার বেদনা। অথচ নক্ষত্রের মতো আলো বিলোনোর ক্ষমতা তাঁরও আছে। ৩৪ বসন্ত পেরিয়ে গতকাল প্যারিসে ব্যালন ডি’অরের ঝলমলে রাতে সত্যিই নক্ষত্র হয়ে আবির্ভূত হলেন বেনজেমা।
বেনজেমার গল্প অনেকভাবে লেখার সম্ভাবনা ছিল। এখনও লেখা সম্ভব। ৫ বছর জাতীয় দলে বাতিলের খাতায় পড়ে ছিলেন। এত এত তারকার ভিড়ে তাঁর অভাবও কেউ বোধ করেনি। সেই দলটিই যখন ৪ বছর আগে বিশ্বকাপ জেতে, বেনজেমাকে তখন আর কে-ই-বা মনে রাখবে!
ক্লাবের পথচলাও মসৃণ নয়। একটু আগে যে গ্রহের রূপক দেওয়া হলো তার নামটা ক্রিস্টিয়ানো রোনালদো। রিয়াল মাদ্রিদ যদি ছায়াপথ হয়, তবে রোনালদো সেই ছায়াপথের অন্যতম আলোকিত গ্রহ। রোনালদোর সময়ে বেনজেমা রিয়ালে স্রেফ একটি উপগ্রহের মতো, কখনো কখনো তাও নন। কিন্তু ওই যে, হাল ছাড়েননি। অপেক্ষা করেছেন নিজের সময়ের জন্য। সবুরে সত্যিই মেওয়া ফলে!
ব্যালন ডি’অর জয় বেনজেমার শৈশব স্বপ্ন। ট্রফি হাতেও বলেছিলেন এ কথা। চার বছর আগে এমন কিছু বললে হেসেই উড়িয়ে দেওয়া হতো।
রোনালদো-মদরিচদের ভিড়ে গড়পড়তা মানের একজন স্ট্রাইকারের বেশি যে বিবেচিত হতেন না বেনজেমা। কিন্তু এই ফরাসি তারকা লাগাম হাতে শাসন করেছেন সময়ের দৈত্যকে। যে বয়সে তার সমসাময়িকরা ক্যারিয়ারের গোধূলিলগ্নে, সে বেলায় এসে ‘কিং করিম’-এর পায়ে যেন উষার আলো! এই বেনজেমাকে চাইলে ওয়াইনের সঙ্গেও তুলনা করা যায়। সময়ের সঙ্গে যাঁর খেলা দেখার স্বাদ বাড়ছে।
গত মৌসুমে নিজের ক্যারিয়ারের সেরা সময়টা পার করেছেন বেনজেমা। এমন না যে এর আগে সাফল্য পাননি। লা লিগার শিরোপা কিংবা চ্যাম্পিয়নস লিগ আগেও জিতেছেন। ইউরোপীয় শ্রেষ্ঠত্বের মুকুট এর আগে জিতেছেন ৪ বার। তবে কোনোবারই তা এমন বেনজেমাময় ছিল না। আগের অর্জনগুলোয় সতীর্থদের জন্য কেবল হাত তালি দিয়েই কেটেছে তাঁর।
বেনজেমা এবার আর সেটা হতে দেননি। সামনে থেকে রিয়ালকে সাফল্য এনে দেওয়া এবং নিজেকে অন্য উচ্চতায় নিয়ে যাওয়ার পুরস্কারটা নিয়েছেন নিজের গুরু ও আদর্শ জিনেদিন জিদানের হাত থেকে। পুরস্কার হাতে নিয়ে মনে করিয়ে দিয়েছেন হাল না ছাড়ার গল্প, ‘এটা আমাকে গর্বিত করেছে। আমি কখনো হাল ছাড়িনি। আমার জীবনে দুজন আদর্শ জিদান এবং রোনালদো। আমার মধ্যে সব সময় এ স্বপ্ন ছিল যে, সবকিছু সম্ভব। জীবনে এমন সময় এসেছে, যখন আমি ফ্রান্স দলে ছিলাম না। তবে আমি কঠিন পরিশ্রম করেছি এবং কখনো হাল ছাড়িনি।’
শৈশবে অভিবাসী পরিবারের সন্তান বেনজেমা সন্ত্রাসী দলের সঙ্গে জড়িয়ে গেলে হার না মানার এই গল্পটা হয়তো শুরুই হতো না। তবে এরপরও বিরুদ্ধতা তার পা আগলে ধরেছে বারবার। স্কুলে অন্য বাচ্চাদের সঙ্গে ঠিকঠাক মিশতে পারতেন না। বৈষম্যের শিকারও হয়েছেন। ওজনের জন্যও শুনতে হয়েছে সতীর্থদের কটূক্তি।
তাই বলে হাল ছাড়েননি। খাওয়ার অভ্যাস বদলেছেন, নিজেকে বদলেছেন। এরপর ফুটবল নামক বস্তুটা পায়ে আসতে নিজেকে উজাড় করে দিয়েছেন সবুজ গালিচায়। সেটিও যে সব সময় গালিচা ছিল তাও নয়, কাঁটাও ছিল।
৮ বছর বয়সে স্থানীয় ক্লাব তেরালিওনের হয়ে ফুটবলের পথে যাত্রা শুরু করেছিলেন। ধাপে ধাপে এগিয়েছেন। এরপর যান লিওঁতে। শুরুতে বলবয়ের কাজও করেছেন। মাঠে নিজেকে মেলে ধরলেও, মাঠের বাইরে অন্তর্মুখী স্বভাবের জন্য সমালোচিত হন। প্রথমবার যখন বেনজেমা লিঁওর মূল দলের খেলোয়াড়দের সঙ্গে দেখা করেন তখন সবাই তাঁকে নিয়ে মজা করছিল। বেনজেমা তখন বলেছিলেন, ‘আমাকে নিয়ে হাসাহাসি করো না। মনে রেখ, এক সময় আমি বল বয় ছিলাম। এখন তোমাদের সঙ্গে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করতে এসেছি, ১০ নম্বর জার্সির জন্য এবং জায়গা নেওয়ার জন্য।’
নিজের প্রতিজ্ঞা রেখেছেন বেনজেমা। সব বঞ্চনার উত্তর সেই চামড়ার গোলকটি দিয়েই শেষ পর্যন্ত দিয়েছেন। প্রতিবন্ধকতা এরপরও কম আসেনি। কিন্তু ওই যে সেই কথাটা—হাল ছাড়েননি কখনোই। পাঁচ বছর জাতীয় দলে জায়গা না পেয়ে হাল ছাড়েননি, রোনালদো- রোনালদো স্লোগানে আড়াল হয়েও হাল ছাড়েননি, গোল করার মূল দায়িত্ব থেকে সরে গিয়ে হাল ছাড়েননি, একের পর এক চোটে হাল ছাড়েননি, বয়স যখন চোখ রাঙাচ্ছে, তখনো হাল ছাড়েননি। লিখেছেন প্রত্যাবর্তনের অসামান্য এক রূপকথা। সে গল্প মেহনতি মানুষের স্বীকৃতি আদায়ের মতোই গৌরবান্বিত।
আর্নেস্ট হেমিংয়ের ‘দ্য ওল্ড ম্যান অ্যান্ড দ্য সি’ গল্পের বুড়ো সান্তিয়াগোর প্রসঙ্গ টেনে বেনজেমার গল্পের ইতি টানা যায়। সান্তিয়াগোর মতো বেনজেমাও উত্তাল সমুদ্রেও লক্ষ্যচ্যুত হননি। বইটির সেই বিখ্যাত লাইনের মতো বুঝিয়েছেন, ‘মানুষ ধ্বংস হতে পারে তবে পরাজিত হয় না।’
বেনজেমাও পরাজিত হননি। হাল ছাড়েননি। বরং হতাশা ও মুষড়ে পড়া পৃথিবীর বুকেই লিখেছেন, খাঁড়া পাহাড় বেয়ে চূড়ায় ওঠার অসামান্য গল্প।