কৃষিকাজ করতে করতেই পেশাদার ফুটবলার বোয়াটেং
ছেলেটির বয়স তখন ১৫। স্কুলের শিক্ষক একদিন তার খেলা দেখে বাবাকে বললেন, ‘আপনার ছেলের প্রতিভা আছে। ওকে ফুটবলে দেন। ও পেশাদার ফুটবলার হতে পারবে।’ শুনে বাবা ছেলেকে বলেন, ‘আপাতত তোমাকে কৃষিকাজে যেতে হবে না। তুমি খেলতে যাও।’
সেই ছেলেটিই বাংলাদেশ প্রিমিয়ার ফুটবল লিগে এই মুহূর্তে সবচেয়ে আলোচিত স্যামুয়েল বোয়াটেং। নামটা প্রথম আলোচনায় আসে ৪ জানুয়ারি। প্রিমিয়ার লিগে ওয়ান্ডারার্সের বিপক্ষে রহমতগঞ্জ মুসিলম ফ্রেন্ডস সোসাইটির ৬-১ গোলের জয়ে সব কটি গোলই ঘানার ২৭ বছর বয়সী স্ট্রাইকারের।
১৭ বছর পর বাংলাদেশ প্রিমিয়ার লিগে ডাবল হ্যাটট্রিক করেছেন কেউ। এই ডাবল হ্যাটট্রিকের কল্যাণে ৭ ম্যাচে ১১ গোল করে এখন গোলদাতার শীর্ষে স্যামুয়েল বোয়াটেং। লিগে তাঁর সব গোলই সর্বশেষ চার ম্যাচে।
বাংলাদেশের প্রথম খেলতে এসেই চোখ কাড়া বোয়াটেং ঘানার দ্বিতীয় বৃহত্তম জেলার এক কৃষক পরিবারের সন্তান। কৃষক বাবাকে সহায়তা করে এসেছেন ছোট থেকেই। জীবনের সেই অজানা অধ্যায়েরর দরজা বোয়াটেং কাল প্রথম আলোর কাছে খুলে দিয়েছেন পুরান ঢাকার এরশাদ কলোনিসংলগ্ন রহমতগঞ্জ মাঠে দলের অনুশীলন শেষে। তখন সন্ধ্যা প্রায় নেমে এসেছে।
কিন্তু সাক্ষাৎকার দিতে চাইছিলেন না বোয়াটেং। যুক্তিও দেন, ‘আমি এক ম্যাচে ৬ গোল করেছি ঠিক আছে। কিন্তু এই ফর্ম তো সব ম্যাচে দেখাতে পারব না। খারাপ দিনও যাবে।’ শেষে কোচ কামাল বাবুর অনুরোধে কথা বলতে রাজি হন।
বোয়াটেং শোনান তাঁর জীবনের গল্প, ‘আমার বাবা অ্যাজাপং বোয়াটেং আজন্ম একজন কৃষক। এখন বয়স ৭৮ বছর। তিনি ঘানার ভাষায় কো কো চাষ করেন, মানে কফি। সেটা বিক্রি করেন স্থানীয় বাজারে। ছোটবেলা থেকেই আমি তাঁকে এই কাজে সহায়তা করি।’ তারপর? গড়গড় করে বলে যান, ‘স্কুল না থাকলে সকাল ৭টায় যেতাম বাবাকে কফি চাষে সহায়তা করতে। তবে বাবার কোনো দোকান নেই। এখনো বাড়িতে থাকলে আমি তাঁকে সহায়তা করি কফি চাষে।’
মা মেরি বোয়াটেং তরিতরকারি কিনে বিক্রি করেন। তাঁর একটা দোকান আছে বাড়ির পাশে। মাকে বেশি সহায়তা করতেন বোয়াটেংয়ের বড় তিন ভাই। আর বোয়াটেং নিজে বেশি সহায়তা করেছেন বাবাকে। এসব নিয়ে গল্পের ফাঁকে মনে করিয়ে দেন, ‘আমি কিন্তু খুব আনন্দের সঙ্গেই কৃষিকাজ করতাম বাবার সঙ্গে। এমন নয় যে আমাকে জোর করে নিতে হয়েছে।’
বেলারুশে একবার ট্রায়াল দিতে গিয়েছিলেন স্যামুয়েল বোয়াটেং। সেখানে সুযোগ হয়নি। পরে রহমতগঞ্জ তাঁর সঙ্গে যোগাযোগ করে বাংলাদেশে নিয়ে আসে।
অনেক লড়াই-সংগ্রাম পেরিয়ে এখন নিজের জীবন, পরিবার নিয়ে গর্বিত বোয়াটেং। জীবনে স্বাচ্ছন্দ্য এসেছে এখন। বড় দুই ভাই চিকিৎসক (একজন পশু চিকিৎসক)। একজন ব্যবসায়ী। বোয়াটেং পেশাদার ফুটবলার। চার ভাই-ই প্রতিষ্ঠিত। এখন আর আর্থিক সংকট নেই সংসারে। পরিবারের পাশে আছেন বোয়াটেং। বড় তিন ভাই আলাদা থাকেন। বোয়াটেং বাবা-মায়ের সঙ্গে। তিনিও বিবাহিত এবং ৫ বছরের একটি শিশুপুত্র আছে তাঁর।
ফুটবলার না হলে আমি কৃষকই হতাম। এই কাজটা করে আমি গর্বিত। কারণ, ওটাই আমাদের মুখে অন্ন দিয়েছে। নিজেকে কৃষক পরিচয় দিতে মোটেও লজ্জিত হই নাস্যামুয়েল বোয়াটেং, রহমতগঞ্জের স্ট্রাইকার
অতীত জীবনের কথা ভাবলে স্মৃতিকাতর হয়ে যান বোয়াটেং, ‘ছোটরা যখন খেলতে যেত আমি তখন বাবাকে কৃষিকাজে সহায়তা করতাম জমিতে। ওই সব দিন আপ্লুত করে। আসলে পরিবারে আর্থিক সংকট ছিল। তবে সেই সময়টাই আমার জীবনে বিরাট অনুপ্রেরণা।’
আন্তস্কুল ম্যাচে ২ ম্যাচে ৭ গোল করে নজর কাড়েন প্রথম। সেরা খেলোয়াড়ও হন ওই প্রতিযোগিতায়। তখন তাঁর এক জোড়া বুটও ছিল না। স্কুলের হয়ে নজর কাড়ার পর স্কুল পরিচালক টাকা দেন বুট কেনার জন্য। এরপর ধাপে ধাপে এগিয়েছেন। ঘানার দ্বিতীয়, প্রথম বিভাগে খেলেছেন। ২০২১ সালে ঘানার প্রিমিয়ারে সুযোগ মেলে। বোয়াটেং এগিয়ে নেন তাঁর গল্প, ‘তখনই আমি প্রথমবার পেশাদার চুক্তি পাই। মাসে ৫০০ ডলার বেতন। সে বছর আমাদের দল আসান্তে কতোকো চ্যাম্পিয়ন হয়। প্রথম ৭ ম্যাচ খেলে চোট পাই। গোল করেছিলাম ৪টি। তিন মৌসুমে ওই ক্লাবের হয়ে লিগে ১৩ গোল করেছি।’
বেলারুশে একবার ট্রায়াল দিতে যান। সেখানে সুযোগ হয়নি। তবে ২০২১-২৩ পর্যন্ত খেলেন ঘানার প্রিমিয়ারের ক্লাব আসান্তে কতোকোতেই। গত বছর কোথাও খেলেননি। কারণ, কোনো ক্লাব নাকি পাচ্ছিলেন না বোয়াটেং। শেষে নাকি ভেড়েন রহমতগঞ্জে।
তবে তা উড়িয়ে দিয়ে বোয়াটেং বলছিলেন, ‘রহমতগঞ্জ আমাকে যোগাযোগ করে এনেছে। এমন না যে আমি এখানে এসে ক্লাব খুঁজেছি (পাশে বসে রহমতগঞ্জের কোচ কামাল বাবু বললেন, ‘কোনো ক্লাবও খোঁজেনি সে। ওকে আমরাই যোগাযোগ করে এনেছি।’)
এনে যে ভুল করেনি রহমতগঞ্জ, তা প্রমাণ করেছেন বোয়াটেং। এখন তাঁর স্বপ্ন বাংলাদেশ লিগে সর্বোচ্চ গোলদাতা হওয়া। তবে বলতে ভোলেন না রহমতগঞ্জের জয়ই আসল তাঁর কাছে। ব্যক্তিগত সাফল্য নয়।
চার ভাই, দুই বোনের মধ্যে বোয়েটেং সবার ছোট। বোয়াটেং তাঁদের পরিবারিক নাম। অর্থ হলো শান্তি। আর স্যামুয়েল নামের অর্থ ইশ্বরের সন্তুষ্টি। এ মৌসুমে ঢাকা মোহামেডানে এক বোয়াটেং খেলছেন। ঘানারই বোয়াটেং ইমেস্ট। ঘানায় অনেক ফুটবলারের নামের আগে-পরে বোয়াটেং আছে।
ঘানার বংশোদ্ভূত দুই বোয়াটেং ভাই জেরোম আর কেভিন বোয়াটেং। একজন জার্মানির হয়ে খেলেছেন, একজন ঘানার হয়ে। তাঁদের সঙ্গে এই বোয়াটেংয়ের কখনো আলাপ হয়নি। তবে তাঁদের দেখেছেন তিনি।
অনেক ঘানাইয়ান ফুটবলারই ইউরোপে খেলেন। যেমন মোহাম্মদ কুদুস ওয়েস্ট হামে, জর্ডান আইয়ু লেস্টার সিটিতে। তাঁদের কারও সঙ্গে আলাপ হয়েছে হয়েছে কি না জানতে চাইলে বলেন, ‘হয়েছে। কুদুস তো আমার বন্ধু। তবে সে এখন অনেক বড় ফুটবলার। কথাবার্তা কমই হয়।’
গল্পে গল্পে আন্ধকার হয়ে আসে। মাঠসংলগ্ন ক্লাবের দিকে পা বাড়ান বোয়াটেং। যাওয়ার আগে বলে যান, ‘ফুটবলার না হলে আমি কৃষকই হতাম। এই কাজটা করে আমি গর্বিত। কারণ, ওটাই আমাদের মুখে অন্ন দিয়েছে। নিজেকে কৃষক পরিচয় দিতে মোটেও লজ্জিত হই না।’
কৃষক জীবনটা তাঁকে অনেক শিখিয়েছে। চ্যালেঞ্জ নিতেই তাঁর বাংলাদেশে আসা। বাংলাদেশের তরুণ ফুটবলারদের কাছে বোয়াটেং হতে পারেন বড় অনুপ্রেরণাই।