ছোটদের বিশ্বকাপে বড় হওয়ার বার্তা দিলেন যাঁরা
সকালের সূর্য নাকি দিনের পূর্বাভাস দেয়। তেমনই পূর্বাভাসের পথ ধরে বেরিয়ে এসেছিলেন ডিয়েগো ম্যারাডোনা, রোনালদিনিও, লিওনেল মেসি, সের্হিও আগুয়েরো ও পল পগবার মতো তারকারা। এই মহাতারকাদের উত্থানের পেছনে যে মঞ্চ নেপথ্য ভূমিকা রেখেছিল, সেটি অনূর্ধ্ব-২০ বিশ্বকাপ।
ছোটদের এই বিশ্বকাপ থেকেই মূলত ম্যারাডোনা-রোনালদিনিও-মেসিদের বড় হওয়া শুরু। এবারও অনূর্ধ্ব-২০ বিশ্বকাপ তেমনই কিছু তারকার আবির্ভাবের বার্তা দিয়েছে, যাঁরা একক নৈপুণ্যে বদলে দিয়েছেন ম্যাচের গতিপথ। এই তরুণ তুর্কিদের সবার দল হয়তো সাফল্য পায়নি, কিন্তু ভবিষ্যতে সফল হওয়ার অনুপ্রেরণাটুকু এখান থেকে ঠিকই নিয়ে গেলেন তাঁরা। তাঁদের কজনকে নিয়েই এ আয়োজন।
মার্কোস লিওনার্দো (ব্রাজিল)
ব্রাজিল কোয়ার্টার ফাইনাল থেকে বাদ পড়লেও ‘ওয়ান্ডার কিড’ মার্কোস লিওনার্দোকে এড়িয়ে যাওয়ার কোনো সুযোগ নেই। বিশ্বকাপে লিওনার্দো ৫ ম্যাচে ৫ গোল করেছেন এবং সঙ্গে একটি অ্যাসিস্টও আছে তাঁর। দলে কোনো নিখুঁত স্ট্রাইকার না থাকলেও ব্রাজিলের আক্রমণভাগকে লিওনার্দো অনেকটা একাই টেনেছেন। ইতালির বিপক্ষে তাঁর পারফরম্যান্সের কথা বিশেষভাবে বলতে হয়। ৩-২ গোলে হারা সেই ম্যাচে দারুণ নৈপুণ্যে আলোচনায় আসেন লিওনার্দো। এমনকি ৩-২ গোলে ইসরায়েলের কাছে অঘটনের শিকার হয়ে হারা ম্যাচেও লিওনার্দো নিজের সর্বোচ্চ চেষ্টা করেছিলেন। কিন্তু শেষ পর্যন্ত দলের বিদায় ঠেকাতে পারেননি। দলকে কাঙ্ক্ষিত সাফল্য এনে দিতে ব্যর্থ হলেও এখনই তাঁকে ভাবা হচ্ছে ব্রাজিলের ফুটবলের ভবিষ্যৎ হিসেবে। বর্তমানে সান্তোসের সঙ্গে চুক্তি আছে তাঁর। গত মৌসুমের পুরোটাতেই ম্যাচ টাইম পেয়েছেন লিওনার্দো। গুঞ্জন আছে, এরই মধ্যে বেশ কিছু ইংলিশ ক্লাব তাঁকে দলে টানার ব্যাপারে আগ্রহ দেখিয়েছে। খুব শিগগির বড় কোনো ক্লাবে তাঁকে দেখা গেলে তা মোটেই অবাক করা ব্যাপার হবে না।
সিজার কাসাদেই (ইতালি)
বিশ্বকাপে চমক দেখানো আরেক বিস্ময়বালকের নাম সিজার কাসাদেই। ২০২২ সালে ইন্টার মিলান থেকে চেলসিতে যোগ দেন এই ইতালিয়ান। ২০২২-২৩ মৌসুমের দ্বিতীয় ভাগে ইএফএল চ্যাম্পিয়নশিপে ধারে খেলেন কাসাদেই। সেখানে তিনি খেলেন রিডিংয়ের হয়ে। ইতালির হয়ে ফাইনালে ওঠার পথে সব কটি ম্যাচে খেলে নিজের প্রতিভার ঝলক দেখিয়েছেন এই তরুণ। এই ম্যাচগুলোতে সব মিলিয়ে গোল করেছেন ৭টি। সঙ্গে আছে একটি অ্যাসিস্টও। ফিফা আয়োজিত ১১ খেলোয়াড় নিয়ে গঠিত দলগুলোর টুর্নামেন্টে ইতালির হয়ে সর্বোচ্চ গোলের রেকর্ড এখন কাসাদেইয়ের। এত দিন ৬ গোলে রেকর্ডটি দখলে রেখেছিলেন ইতালির কিংবদন্তি পাওলো রসি ও সাবেক স্ট্রাইকার সালভাতর শিলাচি। ১৯৮২ বিশ্বকাপে ইতালিকে চ্যাম্পিয়ন করার পথে সর্বোচ্চ ৬ গোল করেছিলেন প্রয়াত রসি। ৮ বছর পর ১৯৯০ বিশ্বকাপে একাই ৬ গোল করে সর্বোচ্চ গোলদাতা হন শিলাচি। কাসাদেইকে চাইলে মাঝমাঠের ডান কিংবা বাঁ—উভয় পাশেই খেলানো যায়। এরই মধ্যে ইতালির কোচ রবার্তো মানচিনির প্রশংসাও পেয়েছেন কাসাদেই। হয়তো তিনি খুব শিগগির জাতীয় দলেও ডাক পেতে পারেন। এ ছাড়া সামনের মৌসুমে তাঁকে হয়তো চেলসিও নিয়মিত খেলাবে। সব মিলিয়ে বিশ্বকাপে আলো ছড়ানোর মধ্যে কাসাদেইয়ের ওপর বিশেষভাবে চোখ থাকবে।
সেবাস্তিয়ান বোসেলি (উরুগুয়ে)
চোখ রাখতে হবে উরুগুয়ের অন্যতম নায়ক সেবাস্তিয়ান বোসেলির দিকেও। অনূর্ধ্ব-২০ বিশ্বকাপের অন্যতম আবিষ্কারও বলা যায় বোসেলিকে। গ্রুপ পর্বে ইংল্যান্ডের কাছে ৩-২ গোলের হার বাদ দিলে গোটা টুর্নামেন্টে আর কোনো ম্যাচে গোল হজম করেনি উরুগুয়ে। ছোটদের এই টুর্নামেন্টে মিডফিল্ডার ও স্ট্রাইকাররা বিশেষভাবে আলোচনায় থাকলেও বোসেলি কিন্তু একেবারে ভিন্ন। তিনি মূলত আলোচনায় এসেছেন ডিফেন্ডার হিসেবে। বোসেলি প্রতি ম্যাচে গড়ে ৩.৫টি ট্যাকেল করেছেন। অ্যারিয়েল ডুয়েলে (বল যখন শূন্যে থাকে) ৮৬ শতাংশ সময় প্রতিপক্ষকে পরাস্ত করেছেন বোসেলি। এ ছাড়া পাসেও বোসেলি বেশ নিখুঁত। বর্তমানে এই সেন্টারব্যাক খেলেন উরুগুয়ের ক্লাব ডেফেনসোর স্পোর্টিং ক্লাবের হয়ে। এই বছরের শেষে তাঁর চুক্তি শেষ হয়ে যাবে। ধারণা করা হচ্ছে, বিশ্বকাপ পারফরম্যান্সের পর তাঁকে নিয়ে আগ্রহী হয়ে উঠবে ইউরোপের দলগুলো।
ফাব্রিসিও দিয়াজ (উরুগুয়ে)
উরুগুয়ে দলের আরেক উদীয়মান তারকা মিডফিল্ডার ফাব্রিসিও দিয়াজ। দিয়াজের নেতৃত্বেই উরুগুয়ে বিশ্বকাপ জিতেছে। বিশ্বকাপ জিততে না জিততেই তাঁর ওপর সুনজর পড়েছে বার্সেলোনার। বিশ্বকাপে অনেকটা লুকানো তাস হিসেবে ব্যবহার করেছে দিয়াজকে। যদিও এর আগে ক্লাব পর্যায়ে তাঁর বলার মতো কোনো পারফরম্যান্স ছিল না। কিন্তু বয়সভিত্তিক শ্রেষ্ঠত্বের লড়াইয়ে রীতিমতো উল্কার গতিতে আবির্ভূত হয়েছেন দিয়াজ। বিশ্বকাপে উরুগুয়ের দারুণ নৈপুণ্যের পেছনে বোসোলির মতো অবদান আছে তাঁরও।
প্রতিভার চমক দেখালেও এখনো পুরোপুরি প্রস্ফুটিত হওয়া বাকি আছে দিয়াজের। বিশ্বকাপের আগে দিয়াজের ঝলক দেখা যায় অনূর্ধ্ব–২০ কনমেবল চ্যাম্পিয়নশিপে। যেখানে ৮ ম্যাচে ৭ গোল করেছিলেন দিয়াজ। আর বিশ্বকাপে মিডফিল্ড-জেনারেলের ভূমিকায় নিজেকে মেলে ধরেছেন দারুণভাবে। মিডফিল্ডে কার্যকর পাস দেওয়ার দিক থেকে বাকিদের চেয়ে এগিয়ে আছেন দিয়াজ। প্রতি ম্যাচে ৪.৭টি গুরুত্বপূর্ণ পাস দিয়েছেন এই মিডফিল্ডার। ওয়ান অন ওয়ান দ্বৈরথেও দিয়াজকে সামলাতে রীতিমতো হিমশিম খেতে হয় প্রতিপক্ষকে। পাশাপাশি গোল করার সুযোগ তৈরিতেও বাকিদের চেয়ে অনেক পরিণত দিয়াজ। এখন জাতীয় দলের পারফরম্যান্স ক্লাবের জার্সিতেও অনুবাদের অপেক্ষা। তবে ভালো কোনো কোচের অধীন পড়লে নিজেকে আরও পরিণত করে লম্বা সময় খেলার সুযোগ আছে দিয়াজের।
সিউং উন লি (দক্ষিণ কোরিয়া)
সেমিফাইনালেই থেমেছে দক্ষিণ কোরিয়ার স্বপ্নের যাত্রা। কিন্তু যাত্রাপথের এই সময়টুকুতেই নিজের ঝলক দেখিয়েছেন সিউং উন লি। টুর্নামেন্টের শুরু থেকেই চমক দেখিয়েছে দক্ষিণ কোরিয়া। গ্রুপ পর্বে ফ্রান্সের ওপরে থেকেই শেষ করেছে তারা। এরপর শক্ত প্রতিদ্বন্দ্বী ইকুয়েডর ও নাইজেরিয়াকেও বিদায় করেছে তারা। এশিয়ান পরাশক্তিদের এই পারফরম্যান্সের পেছনে মূল ভূমিকা ছিল সিউং উন লির। অ্যাটাকিং মিডফিল্ডার হিসেবে খেলে দলের আক্রমণভাগে নিয়মিত অবদান রেখে গেছেন উন লি। ৬ ম্যাচে ২ গোল করার পাশাপাশি ৪টি অ্যাসিস্টও আছে তাঁর। এই পারফরম্যান্স দক্ষিণ কোরিয়া থেকে উঠে আসা ইউরোপিয়ান তারকাদের মধ্যে যুক্ত করতে পারে তাঁর নামও।
অস্কার কোর্তেস (কলম্বিয়া)
বিশ্বকাপের কোয়ার্টার ফাইনালেই থেমেছে কলম্বিয়ার যাত্রা। কিন্তু এটুকুতেই সবার মন জয় করেছেন অস্কার কোর্তেস। বুদ্ধিদীপ্ত কোর্তেস একই সঙ্গে অ্যাটাকিং মিডফিল্ডার ও উইঙ্গার হিসেবে খেলতে পারেন। কোর্তেস ৫ ম্যাচে ৪ গোল করার পাশাপাশি সহায়তা করেছেন ২ গোলে। কলম্বিয়া বিশ্বকাপে যতগুলো সুযোগ তৈরি করেছে, তার বেশির ভাগেরই নেপথ্য নায়ক ছিলেন কোর্টেস। এ মৌসুমে কলম্বিয়ান ক্লাব মিলোনারিওস এফসির হয়ে দারুণ খেলেছেন ১৯ বছর বয়সী এই ফুটবলার। তবে বিশ্বকাপের আগে সেভাবে আলোচনায় না থাকলেও এখন ভবিষ্যতের তারকাদের একজন হিসেবে দেখা হচ্ছে কোর্তেসকে। যদিও ইউরোপের কোনো শীর্ষ ক্লাবে ডাক পেতে আরও কিছুটা পরিশ্রম করতে হতে পারে তাঁকে।