মাঠে খেলছে আবাহনী-মোহামেডান। কিন্তু গ্যালারির দিকে তাকালে মনে হবে, পাড়ার কোনো ম্যাচ হচ্ছে। গ্যালারির দুরবস্থা বিবর্ণ শব্দ দিয়েও ঠিক বোঝানো যাবে না। এমনই বেহাল এখন কুমিল্লার শহীদ ধীরেন্দ্রনাথ দত্ত স্টেডিয়ামের গ্যালারি।
বছর তিনেক আগেও এই স্টেডিয়ামে ঢুকলে ইউরোপের কোনো স্টেডিয়ামের মতো লাগত। যেমন মাঠ, তেমন গ্যালারি। কিন্তু এখন দুটোই ঔজ্জ্বল্য হারিয়ে ফেলেছে। মাঠের মাঝখানে ক্রিকেট পিচ। যেটা স্পষ্ট বোঝা যায়। ক্রিকেট পিচ করা হয়েছিল স্থানীয় ক্রিকেট লিগের খেলার জন্য। ক্রিকেট থেকে আপাতত কয়েক মাসের জন্য এটি ফুটবলের হয়েছে। কিন্তু গ্যালারির অবস্থা দুই-তিন বছর আগের সঙ্গে তুলনায় আকাশ-পাতাল পার্থক্য। আধুনিক এই যুগে উন্নতির চেয়ে অবনতির পথে হাঁটতেই যেন বাংলাদেশের ফুটবল বেশি ভালোবাসে।
রং উঠে যাওয়ায় গ্যালারির অবস্থা খারাপ, স্যাঁতসেঁতে হয়ে আছে। অযত্নে দিনদিন খারাপ হচ্ছে এর অবস্থা। প্রশ্ন হচ্ছে, একটু রং করে কী গ্যালারির দৈন্যদশা কাটিয়ে ওঠা যেত না? অবশ্যই যেত। কত টাকাই বা দরকার ছিল! কিন্তু সেদিকে যেন দৃষ্টি নেই কারও। কোনোমতে দায়সারাভাবে খেলা শেষ করাই লক্ষ্য। অথচ এই স্টেডিয়ামে মোহামেডানকে নিয়ে বসুন্ধরা কিংস যখন প্রিমিয়ার লিগে তাদের ভেন্যু করেছিল এক বছরের জন্য, সে সময় কিংসের উদ্যোগে পুরো গ্যালারিতে রং করা হয়। একপাশে লাল রং, অন্যপাশে সাদাকালো। গ্যালারির চেহারা পাল্টে যায় তখন।
স্টেডিয়ামে ঢুকলে একটা ভালো লাগা অনুভূতি কাজ করত। কিন্তু এখন সেই অনুভূতির বদলে গেছে, গ্যালারি দেখা মানে চোখের জন্য পীড়াদায়ক একটা ব্যাপার। এর অন্যতম কারণ কিংসের সরে আসা। কিংস তার নিজস্ব ভেন্যু পাওয়ার পর এটি ছেড়ে দিয়েছে। কিংসের পর আবাহনী-মোহামেডান এখানে যৌথভাবে ভেন্যু করে। এক মৌসুম আবাহনী-মোহামেডান ব্যবহার করার পর গত বছর আর ভেন্যু দেয়নি কুমিল্লা জেলা ক্রীড়া সংস্থা। এক মৌসুম পর এবার সেখানে প্রিমিয়ার লিগের ভেন্যু হয়েছে এবং ভেন্যু নিয়েছে আবাহনী-মোহামেডান। কিন্তু এখন গ্যালারি যেন পরিত্যক্ত কোনো বাড়ির সিঁড়ির মতো।
স্টেডিয়ামের বিষয়টি দেখভালের জন্য কয়েকটি অংশীজন আছে। প্রথমত স্টেডিয়ামের সংস্কার, সৌন্দর্যকরণের কাজ জাতীয় ক্রীড়া পরিষদের। কারণ, স্টেডিয়ামের মালিক তারাই। ক্রীড়া পরিষদের হয়ে কাজগুলো করে স্থানীয় জেলা ক্রীড়া সংস্থা। সরকার বদলের পর ভেঙে দেওয়া হয় জেলা ক্রীড়া সংস্থা। ফলে একটা শূন্যতা তৈরি হয়।
স্থাপনাটা কার? জাতীয় ক্রীড়া পরিষদের না? মূল দায়িত্ব তো ক্রীড়া পরিষদের। তবে স্থানীয়রা আমাদের অনুরোধ করেছিল গ্যালারি রং করতে। ভিআইপি অংশটা আমরা করেছি। এখন জাতীয় পরিষদকে বলেন বাকিটা করতে। ক্লাবগুলোর ওপর চাপিয়ে দেওয়া কেন?আবাহনীর ম্যানেজার সত্যজিৎ দাশ রুপু
প্রিমিয়ার লিগে যে দুটি দল এই স্টেডিয়ামে ভেন্যু করছে, তাদেরই এখন দায়িত্ব গ্যালারি ঠিকঠাক করা, এমনটাই বলছেন কুমিল্লার স্থানীয় সংগঠকেরা। কারণ, মাঠ তারাই ব্যবহার করছে। গ্যালারি সংস্কারের দায়িত্ব দুই ঐতিহ্যবাহী ক্লাব এড়াতে পারে না। দায়িত্ব এড়াতে পারে না বাংলাদেশ ফুটবল ফেডারেশনও। কিন্তু বাফুফে, ক্লাব—কারোরই কোনো হেলদোল নেই।
মোহামেডানের ফুটবল সম্পাদক আবু হাসান প্রিন্স দায় ঠেললেন বাফুফের ওপর, ভেন্যু এখন বাফুফের। ইচ্ছা করলে গ্যালারিটা ঠিকঠাক করতে পারত তারা। কিন্তু করে না কেন, এই প্রশ্ন তুলে আবু হাসান যোগ করেন, ‘মাঠ পরিচর্যা বাফুফেই করে। গ্যালারি সংস্কারও তাদের করা উচিত। তারা সবার ওপর দায়িত্ব চাপিয়ে দেয়। এটা ঠিক না। আমরা আমাদের ড্রেসিং রুম ঠিক করেছি, আবাহনীরটা আবাহনী করেছে। ফ্যানট্যান লাগানো হয়েছে, রং করানো হয়েছে, ওয়াশরুম ঠিক করা হয়েছে।’
আবাহনীর ম্যানেজার সত্যজিৎ দাশ রুপুও জানিয়েছে, নিজেদের ব্যবহার করা ড্রেসিং তাঁরা ঠিক করেছেন। ভিআইপি বক্সের একটা অংশ আবাহনী রং করেছে, যেখানে খরচ হয় ২৫ হাজার টাকা। বাকিটা কেন রং করা হলো না? প্রশ্ন করলে রুপু পাল্টা বলেন, ‘স্থাপনাটা কার? জাতীয় ক্রীড়া পরিষদের না? মূল দায়িত্ব তো ক্রীড়া পরিষদের। তবে স্থানীয়রা আমাদের অনুরোধ করেছিল গ্যালারি রং করতে। ভিআইপি অংশটা আমরা করেছি। এখন জাতীয় পরিষদকে বলেন বাকিটা করতে। ক্লাবগুলোর ওপর চাপিয়ে দেওয়া কেন?’
৫ আগস্টের পর কুমিল্লা স্টেডিয়ামের ড্রেসিং রুমে ঢুকে দুর্বৃত্তরা ফ্যান, লাইট সবই নিয়ে গেছে। এখন আবাহনী-মোহামেডানের পক্ষ থেকে নিজ নিজ ড্রেসিং রুমে আবারও লাগানো হয়েছে।
টিকিট বিক্রি থেকে আয় নেয় না দুই ক্লাব। স্থানীয় ব্যক্তিরাই সেটা নেয় বলে জানিয়েছেন সংশ্লিষ্টরা। ফলে গ্যালারি রং স্থানীয়দেরই করা উচিত মনে করেন রুপু।
বাফুফের পেশাদার লিগ কমিটির সভাপতি ইমরুল হাসানের সঙ্গে যোগাযোগ করলে তিনি ফোন ধরেননি। মিটিংয়ে আছেন বলে খুদে বার্তা পাঠান।
তবে নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক বাফুফের এক কর্মীর ভাষ্য ভিন্ন। তিনি বলেন, কুমিল্লা জেলা প্রশাসকের উপস্থিতিতে ক্লাব, বাফুফে, স্থানীয় প্রতিনিধিসহ সভা হয়েছিল। তখন ঠিক হয়েছিল, গ্যালারিতে রংসহ সবকিছু দুই ক্লাব করবে। দুই দল তাদের ড্রেসিং রুমের সামনে অংশে একটুখানি রং করছে। যেটা পুরো স্টেডিয়ামের আট ভাগের একভাগ। বাকিটা করবে আশ্বাস দিয়েছে, কিন্তু করছে না। তবে মাঠ পরিচর্যার দায়িত্ব নিয়েছে বাফুফে। আর বাফুফে সেটা করছে।
এই মাঠেই জিয়া স্মৃতি ক্রিকেট টুর্নামেন্টের ফাইনাল হয়েছে ২৯ নভেম্বর। সেটার ব্যানারও এখনো ঝুলছে স্টেডিয়ামে। বাফুফে মাঠ বুঝে পেয়েছে ৩০ নভেম্বর। পিচ তুলে কোনোমতে বসুন্ধরা আর ব্রাদার্স ম্যাচ দিয়ে ফেডারেশন কাপ শুরু হয়। বাফুফের এক কর্মীর কথায়, ‘মাঠ না পেলে প্রস্তুত করব কীভাবে। আর আমরা মাঠ যখন বরাদ্দ পাই, তখন স্টেডিয়ামটা জঙ্গল হয়েছিল। এক কোমর ঘাস হয়ে যায়। এগুলো ঠিকঠাক করতে অনেক কাজ করতে হয়েছে।’
এসব নিয়ে জানতে বাফুফের পেশাদার লিগ কমিটির সভাপতি ইমরুল হাসানের সঙ্গে যোগাযোগ করলে তিনি ফোন ধরেননি। মিটিংয়ে আছেন বলে খুদে বার্তা পাঠান।
গতকাল ফেডারেশন কাপে আবাহনী-মোহামেডান ম্যাচ হয়েছে এই স্টেডিয়ামে। ম্যাচ কাভার করতে ঢাকা থেকে গিয়ে প্রেসবক্সে কোনো সুযোগ-সুবিধা পাওয়া যায়নি। ল্যাপটপ রাখার টেবিলের সঙ্গে বৈদ্যুতিক কোনো সংযোগ নেই। নেই ওয়াইফাই। কাজী সালাউদ্দিন বিদায় নিয়েছেন। পরিবর্তনের প্রতিশ্রুতি দিয়ে তাবিথ আউয়ালের নেতৃত্বে নতুন কমিটি এসেছে। কিন্তু পরিবর্তনটা কোথায় হলো?
কুমিল্লার ধীরেন্দ্রনাথ দত্ত স্টেডিয়ামের গ্যালারির দিকে চোখ গেলে মনে হবে এ দেশে জাতীয় ক্রীড়া পরিষদ, ফুটবল ফেডারেশন বা ক্লাব নামে কিছু নেই। সামান্য গ্যালারিতে রং করার দায় নিচ্ছে না কেউ। মাঝখানে গ্যালারি ক্ষয়ে যাচ্ছে দিন দিন। দেখতেও খারাপ লাগছে।