২৬তম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীর আয়োজন দেখতে ক্লিক করুন
মূল সাইট দেখতে ক্লিক করুন

টটেনহাম ‘চ্যাম্পিয়ন’ গোলে, বাকিরা সাফল্যে

টটেনহামের খেলোয়াড়েরা গোল করলেও শিরোপা জিততে পারছেন নাছবি: টুইটার

বিশ্বের সবচেয়ে জনপ্রিয় ও প্রতিদ্বন্দ্বিতাপূর্ণ ঘরোয়া ক্রীড়া আসরের প্রসঙ্গ এলে সবাই একবাক্যে ইংলিশ প্রিমিয়ার লিগের নামই বলবেন। সবচেয়ে বেশি পরাশক্তি ক্লাব এ লিগেই খেলে থাকে। ক্লাবগুলোর নামও উচ্চারিত হয় সবার মুখে মুখে।

সেই ১৮৮৮ সালে চালু হওয়া ইংল্যান্ডের শীর্ষ স্তরের আসরটির নাম ১৮৯২ সালে দেওয়া হয় ১ম বিভাগ ফুটবল লিগ। ঠিক ১০০ বছর পর ১৯৯২ সালে নতুন আদল দিয়ে এর নামকরণ করা হয় প্রিমিয়ার লিগ। দীর্ঘ ১৩৫ বছরে কত ঘটনা, হাজার হাজার বিশেষ মুহূর্ত আর গোলের সাক্ষী হয়েছে ইংল্যান্ডের সর্বোচ্চ স্তরের ফুটবল।

এখন যদি প্রশ্ন করা হয়, ইংল্যান্ডের এই শীর্ষ ফুটবল লিগে সবচেয়ে বেশিবার সর্বোচ্চ গোলদাতা হয়েছেন কোন ক্লাবের খেলোয়াড়েরা; তাহলে নিশ্চয় একটুখানি থমকে গিয়ে ভাবতে শুরু করবেন। অনেকে হয়তো এত কিছু না ভেবে সরাসরি ম্যানচেস্টার ইউনাইটেড, লিভারপুল কিংবা আর্সেনালের নাম বলে দেবেন। সাফল্যের দিক থেকে এরাই যে আছে শীর্ষ তিনে। এই তিন ক্লাবের ফুটবলাররাই সবচেয়ে বেশিবার সর্বোচ্চ গোলদাতার পুরস্কার জিতেছেন, এমন ভাবনাই তো স্বাভাবিক!

কিন্তু পরিসংখ্যান বলছে ভিন্ন কথা। ইংল্যান্ডের শীর্ষ ফুটবল লিগে সবচেয়ে বেশি ১৩ বার সর্বোচ্চ গোলদাতা হয়েছেন টটেনহাম হটস্পারের খেলোয়াড়েরা। সর্বশেষ সাত আসরেও টটেনহামের দাপট। চারবারই শীর্ষ গোলদাতা হয়েছেন এ ক্লাবের খেলোয়াড়েরা। ১২ বার করে সর্বোচ্চ গোলদাতার ক্লাব হিসেবে যৌথভাবে তালিকার দুইয়ে এভারটন ও আর্সেনাল। পরের দুটি স্থান লিভারপুল (১১) ও দ্বিতীয় স্তরে নেমে যাওয়া সান্ডারল্যান্ডের (৮)। সবচেয়ে বেশিবার সর্বোচ্চ গোলদাতার তালিকায় শীর্ষ সাতেও নাম নেই সফলতম ক্লাব ইউনাইটেড কিংবা ‘বিগ সিক্স’-এর বাকি দুই দল চেলসি ও ম্যানচেস্টার সিটির। ভাবা যায়!

গ্রাফিকস: প্রথম আলো

প্রিমিয়ার লিগের এ মৌসুমে ৩০ গোল নিয়ে শীর্ষে আছেন আর্লিং হলান্ড। ম্যানচেস্টার সিটির হয়ে অভিষেক মৌসুমেই দুর্বার গতিতে ছুটে চলা হলান্ডের হাতেই যে সর্বোচ্চ গোলদাতার পুরস্কার উঠছে, সেটা নিয়ে বাজি ধরাই যায়। আগের ১৩৪ বছরে ৩২ ক্লাবের ১৩৯ ফুটবলার এ পুরস্কার জিতেছেন। সন্দেহাতীতভাবে সবচেয়ে বেশি ৯০ জন ইংলিশ ফুটবলার। প্রথম বিদেশি হিসেবে ১৯৫১-৫২ মৌসুমে শীর্ষ গোলদাতার পুরস্কার জিতেছেন চিলির জর্জ রোব্লেদো। ব্রিটেনের অংশ হওয়ায় স্কটল্যান্ড, উত্তর আয়ারল্যান্ড ও ওয়েলসের ফুটবলারদের দেশি হিসেবেই বিবেচনা করা হয়।

যে ক্লাবের ফুটবলাররা শীর্ষ গোলদাতা হয়েছেন, সাধারণত তাঁরাই পয়েন্ট তালিকার শীর্ষ তিনে থেকে লিগ শেষ করেছেন। এখানে ব্যতিক্রম শুধু কভেন্ট্রি সিটি ও স্টোকস সিটি। ক্লাব দুটির ফুটবলাররা একবার করে শীর্ষ গোলদাতা হলেও তাঁরা যথাক্রমে ১১ ও ১০–এ থেকে লিগ শেষ করেছেন।

তবে ইংল্যান্ডের শীর্ষ ফুটবল লিগে সবচেয়ে আশ্চর্য ব্যতিক্রম বোধ হয় টটেনহামই। এভারটনকে হটিয়ে সম্প্রতি ‘বিগ সিক্স’-এর একটি হয়ে উঠলেও প্রিমিয়ার লিগ জামানায় কখনো ট্রফি ছুঁয়ে দেখা হয়নি তাদের। ১৮৮২ সালে প্রতিষ্ঠিত উত্তর লন্ডনের ক্লাবটি সর্বোচ্চ পর্যায়ে শিরোপাই জিতেছে সাকল্যে দুবার—সেই ১৯৫০-৫১ ও ১৯৬০-৬১ মৌসুমে। এত দিনে ওই ট্রফি দুটিতে ধুলার আস্তরণ জমেছে কি না, কে জানে! অথচ চ্যাম্পিয়ন হওয়া মৌসুম দুটিতে টটেনহামের কেউ সর্বোচ্চ গোলদাতা হতে পারেননি। ১৯৫০-৫১ মৌসুমে সর্বোচ্চ ৩০ গোল করেছিলেন ব্ল্যাকপুলের স্ট্যানলি মর্টেনসেন, ১৯৬০-৬১ মৌসুমে চেলসির জিমি গ্রিভস। কিংবদন্তি গ্রিভস পরে যোগ দেন টটেনহামে। ক্লাবটিতে ৯ মৌসুম খেলে চার-চারবার হয়েছেন শীর্ষ গোলদাতা। কিন্তু দলকে শিরোপা এনে দিতে পারেননি।

গ্রাফিকস: প্রথম আলো

হ্যারি কেইন যেন গ্রিভসেরই নতুন সংস্করণ। টটেনহামের সঙ্গে ১৯ বছরের সম্পর্ক তাঁর। প্রিমিয়ার লিগে খেলেছেন ২০০৯ সাল থেকে। ক্লাবের অনেক প্রথমের সঙ্গে জড়িয়ে আছে ২৯ বছর বয়সী তারকার নাম। লিগে এক ক্লাবের হয়ে সর্বোচ্চ গোল, টটেনহাম ইতিহাসের সর্বোচ্চ গোলদাতা, ক্লাবটির হয়ে ৩০০ ম্যাচ খেলার মাইলফলক, টানা ৮ মৌসুম ক্লাবের সর্বোচ্চ গোলদাতা, লন্ডন ডার্বিতে সর্বোচ্চ গোলের মালিক এই স্ট্রাইকার। তবে ব্যক্তিগত অর্জনের পাল্লা ভারী হলেও দলীয় অর্জনে শুধুই শূন্যতা। গত মৌসুমেও কেইনের সতীর্থ সন হিউং-মিন সর্বোচ্চ গোলদাতার পুরস্কার জিতেছেন। তবে টটেনহাম লিগ শেষ করেছে চারে থেকে। এবারও লিগ জয়ের কোনো সম্ভাবনা নেই।

এখন প্রশ্ন উঠতে পারে, ইংলিশ লিগ ইতিহাসে সবচেয়ে বেশিবার সর্বোচ্চ গোলদাতার ক্লাব হয়েও ৬২ বছরে শিরোপা-খরা কেন ঘোচাতে পারছে না টটেনহাম? ইতিহাস ঘেঁটে দেখা গেল, টটনেহাম ঐতিহ্যগতভাবে তারকা ফরোয়ার্ড বা স্ট্রাইকার কিনতে অভ্যস্ত। মাঝমাঠ ও রক্ষণভাগের পেছনে তেমন টাকা ঢালেনি।

ববি স্মিথ (১), জিমি গ্রিভস (৪), স্টিভ আর্চিবাল্ড (১), ক্লাইভ অ্যালেন (১), গ্যারি লিনেকার (১), টেডি শেরিংহাম (১), হ্যারি কেইন (৩) ও সন হিউং-মিন (১)—এই ৮ জন লিগে ১৩ বার শীর্ষ গোলদাতা হলেও টটেনহামকে চ্যাম্পিয়ন বানাতে পারেননি। তাঁদের কেউ ফরোয়ার্ড, কেউ জাত স্ট্রাইকার। টটেনহামের ফরোয়ার্ড-প্রীতি দেখে স্যার অ্যালেক্স ফার্গুসনের ‘অমর’ উক্তির কাছে ফিরে যাওয়াই যায়, ‘আক্রমণভাগ আপনাকে ম্যাচ জেতাবে, রক্ষণভাগ জেতাবে শিরোপা।’ আক্ষরিক অর্থেই গ্রিভস, লিনেকার, কেইনরা টটেনহামকে শুধু ম্যাচই জিতিয়েছেন, লিগ শিরোপা জেতাতে পারেননি।

৬২ বছর টটেনহামের লিগ শিরোপা জিততে না পারার পেছনে ফরোয়ার্ডদের ওপর অতিনির্ভরতাও কারণ। বেশির ভাগ মৌসুমেই দলটির গোলের উৎস হয়ে থেকেছেন একজন ফরোয়ার্ড। কোচদের পরিকল্পনাও তাঁকে ঘিরেই আবর্তিত হয়েছে। কিন্তু ম্যানচেস্টার ইউনাইটেড, লিভারপুল কিংবা আর্সেনালের সাফল্যের পেছনে দলীয় অবদানই মুখ্য ভূমিকা রেখেছে।

এতে নির্দিষ্ট একজনের ওপর থেকে চাপ অনেকাংশে কমে গিয়েছে। টটেনহামের ক্ষেত্রে যেমন এক খেলোয়াড় দিয়েই ৩০টি গোল করানো হয়েছে, ইউনাইটেড বা লিভারপুলের হয়তো ২ জন ১৫টি করে অথবা ৩ জন ১০টি করে গোল করে সেটা পুষিয়ে দিয়েছেন। এ কারণে টটেনহামের খেলোয়াড়েরা সবচেয়ে বেশিবার সর্বোচ্চ গোলদাতার পুরস্কার জিতলেও সর্বাধিক লিগ জিতেছে অন্য ক্লাবগুলো।

ম্যানচেস্টার সিটির কথাই ধরুন না। সর্বশেষ পাঁচ মৌসুমের চারবারই লিগ শিরোপা জিতেছে পেপ গার্দিওলার দল। এর পেছনে বড় কারণ দলটিতে বেশ কয়েকজন ফরোয়ার্ডের সরব উপস্থিতি। সের্হিও আগুয়েরো, রাহিম স্টার্লিং, গ্যাব্রিয়েল জেসুস, রিয়াদ মাহরেজরা প্রায় সমানভাবে অবদান রেখেছেন। তবে এবার সিটির আক্রমণভাগ আর্লিং হলান্ডকে ঘিরেই বেশি আবর্তিত হচ্ছে। তাদের ম্যাচ মানেই যেন হলান্ডের গোল। এতে গোলদাতার তালিকায় হলান্ড নিজেকে সবার নাগালের বাইরে নিয়ে গেছেন ঠিকই, কিন্তু দলকে পয়েন্ট তালিকার শীর্ষে তুলতে পারেননি।

এবারের প্রিমিয়ার লিগে শীর্ষে আছে আর্সেনাল। এ মুহূর্তে গানারদের পয়েন্ট ৭৩। তাদের চেয়ে ৬ পয়েন্ট কম নিয়ে দুইয়ে ম্যান সিটি। ১৯ বছর পর লিগ শিরোপা জয়ের বড় সম্ভাবনা জাগালেও সর্বোচ্চ গোলদাতার তালিকায় শীর্ষ তিনে আর্সেনালের কেউ নেই। তবে তিনজন খেলোয়াড় অন্তত ১০টি করে গোল করেছেন; যার যোগফল হলান্ডের চেয়ে ৬টি বেশি। হলান্ডের মতো ‘একাই একশ’ না হয়ে ‘সবে মিলি করি কাজ’ সূত্রেই সাফল্যের দোরগোড়ায় মিকেল আরতেতার দল।

এ থেকেই ধারণা পাওয়া যায়, সবচেয়ে বেশি গোলদাতার ক্লাব হওয়া মুখ্য নয়, শিরোপা জেতাই বড় কথা। টটেহনাম যদি কথাটার মমার্থ বুঝত!