হার্ড রক স্টেডিয়াম, মায়ামি। আর্জেন্টিনা-কলম্বিয়া ম্যাচের ৬৩ মিনিট চলছে। লুইস দিয়াজের কাছ থেকে বল কেড়ে নিতে ছুটছেন তিনি। হঠাৎই পড়ে গেলেন মাটিতে। কয়েক সেকেন্ড খেলা চলল। তারপর সবাই খেয়াল করলেন, তিনি মাটিতে পড়ে আছেন।
লিওনেল মেসি মাটিতে পড়ে আছেন। আর লিওনেল মেসি কখনো অকারণে মাটিতে পড়ে থাকেন না।
চোটটা পেয়েছিলেন প্রথমার্ধে, কলম্বিয়ার সান্তিয়াগো আরিয়াসের চ্যালেঞ্জে। তারপর ওটা নিয়েই খেলে গেছেন। এবার আর পারলেন না। ডান অ্যাঙ্কেল ফুলে ঢোল।
আর্জেন্টিনা দলের ফিজিও ছুটে এলেন। কেমন লাগছে—জিজ্ঞাসা করলেন মেসিকে। ততক্ষণে মেসির পায়ের দিকেও চোখ গেছে তাঁর। বুঝে ফেললেন, এই ম্যাচ আর খেলা হবে না আর্জেন্টাইন অধিনায়কের।
বুঝলেন মেসি নিজেও। উঠে দাঁড়ালেন। ডান পায়ের বুটটা খুলে নিজের হাতে নিলেন। তারপর হাঁটা দিলেন ডাগআউটের দিকে। তাঁর প্রতিটা পদক্ষেপ যেন ছুরির ফলা হয়ে বিঁধছিল হার্ড রক স্টেডিয়ামে আর্জেন্টাইন সমর্থকদের বুকে, আর্জেন্টাইন খেলোয়াড়দের বুকেও হয়তো। সাইডলাইন থেকে বোর্ড উঁচু হলো—‘মেসি আউট’, ‘নিকোলাস গঞ্জালেস ইন’।
ধীরে ধীরে গিয়ে মেসি বসলেন বেঞ্চে। বুটজোড়া ছুড়ে মারলেন মাটিতে। পাশে বসে থাকা লিয়ান্দ্রো পারেদেস শুধু একবার মেসির মাথায় হাত দিয়ে চুলগুলো এলোমেলো করে দিলেন, বললেন না কিছুই। বলার কিছু ছিল না আসলে।
কয়েক সেকেন্ড পর মাঠ থেকে ক্যামেরা আবার ফিরল মেসির মুখে। ফুটবল–বিশ্বের সবচেয়ে পরিচিত মুখ, এ গ্রহের সবচেয়ে চেনা মুখও হয়তো। সেই মুখ আবেগে ছলছল, চোখ টলমল। তারপর হঠাৎই নামল ঢল। লিওনেল মেসি কাঁদছেন। অঝোরে কাঁদছেন। হাত দিয়ে মুখ ঢাকলেন।
কেন? হারের ভয়? তিনি না থাকলে তাঁর সতীর্থরা ম্যাচটা জিততে পারবেন না, এ রকম কোনো ভয় কি? কোপা আমেরিকার ফাইনাল তখনো ০-০। আর্জেন্টিনা যে খুব ভালো খেলছিল, এমন নয়। হারতেই পারত তারা। কে জানে, দলের সবচেয়ে প্রয়োজনের সময় মাঠে না থাকতে পারার হতাশা থেকেই হয়তো সেই কান্না। সপ্তাহ দুয়েক আগে ইউরোতে স্লোভেনিয়ার বিপক্ষে পেনাল্টি মিস করে রোনালদো যেমন কেঁদেছিলেন। বুঝিয়েছিলেন, তাঁরাও অন্য সবার মতোই মানুষ।
কিংবা হয়তো শেষটা এভাবে হচ্ছে ভেবে কাঁদছিলেন মেসি। কোপা মেসি আগেও জিতেছেন। জিতেছেন বিশ্বকাপও। ফুটবল থেকে তাঁর আর পাওয়ার কিছু নেই। এই কোপার ফাইনাল হেরে গেলে তাঁর মাহাত্ম্যে কোনো টান পড়ত না। কিন্তু সবাই চায় শেষটা রঙিন হোক। মেসি তো চাইতেই পারেন।
ক্যারিয়ারের শেষ নিয়ে চূড়ান্ত কিছু তিনি এখনো বলেননি। কিন্তু কোপা যে এটাই শেষ, তা সপ্তাহখানেক আগেই জানিয়ে দিয়েছেন। সেই শেষটা তাঁর কান্না আর আর্জেন্টিনার হারে হলে ‘মধুরেণ সমাপয়েৎ’ বলা যেত না।
অথবা প্রিয় দুই সতীর্থ আনহেল দি মারিয়া ও নিকোলাস ওতামেন্দির শেষটা রঙিন হচ্ছে না ভেবে ছিল মেসির সেই কান্না। আর্জেন্টিনার হয়ে দুজনেরই শেষ ম্যাচ ছিল কোপার এই ফাইনাল। দুজনকে দারুণ এক বিদায়ী উপহার দিতে চান, এটা তো আগেই বলেছেন মেসি। সেটা না হলেও তো একটা অতৃপ্তি থেকে যেত।
মেসির সতীর্থরা যেন পণ করেছিলেন সেটা হতে দেবেন না। সে জন্যই কিনা বিশ্বকাপে হতাশা উপহার দেওয়া লাওতারো মার্তিনেজ হয়ে ওঠেন কোপার ফাইনালের নায়ক। ১১২ মিনিটে গোল করে যিনি সবার আগে ছুটে গেলেন মেসির দিকে। জড়িয়ে ধরে হাসি ফোটালেন অধিনায়কের মুখে। সেই হাসি বাঁধভাঙা উচ্ছ্বাসে রূপ নিল ওই গোলেই আর্জেন্টিনার ম্যাচ জেতার পর।
শেষ বাঁশির পর ডাগআউট থেকে মাঠের দিকে ছুটে আসা মেসির উল্লাস দেখে কে! ফোলা অ্যাঙ্কেলের ব্যথা ভুলে গিয়েই মাঠে নাচলেন গোল হয়ে দাঁড়ানো সতীর্থদের সঙ্গে। তারপর কোপার ট্রফিটা যখন তুলে দেওয়া হলো তাঁর হাতে, সেটা নিয়ে একা এগিয়ে গেলেন না সতীর্থদের দিকে, ডেকে নিলেন বিদায়ী দুই সতীর্থ দি মারিয়া আর ওতামেন্দিকেও।
এই দুজনের পথ ধরে হয়তো মেসিও কদিন পরে তুলে রাখবেন আর্জেন্টিনার জার্সি। ২০২৬ বিশ্বকাপের সময় তাঁর ৩৯তম জন্মদিনের কেক কাটার কথা। তবে তিনি সেই বিশ্বকাপে থাকবেন, সেই সম্ভাবনা এখন পর্যন্ত খুব ক্ষীণ। এ রকম উদ্যাপনের রাত, ট্রফি নিয়ে উল্লাসের রাত হয়তো হার্ড রক স্টেডিয়ামে গতকালই শেষবারের মতো কাটালেন মেসি।
বাঁধভাঙা হাসির আগে তাঁর অঝোর কান্না হয়তো সে কারণেই।