ম্যান সিটি–লিভারপুল দ্বৈরথেই কি শিরোপা নির্ধারণ
ইংলিশ প্রিমিয়ার লিগে সবচেয়ে মর্যাদাপূর্ণ দ্বৈরথ কোনটি? বেশির ভাগই হয়তো বলবেন লিভারপুল–ম্যানচেস্টার ইউনাইটেড লড়াইয়ের কথা। চিরপ্রতিদ্বন্দ্বী এই দুই দলের দ্বৈরথ ফুটবলের আগুনে রূপকথার অংশ। এই দ্বৈরথ শুধু মাঠের খেলাতেই নয়, মাঠের বাইরেও অনেক দূর পর্যন্ত বিস্তৃত। তবে সাম্প্রতিক সময়ে মাঠের লড়াই বিবেচনায় নিলে ইউনাইটেড–লিভারপুল ম্যাচ এখন শুধুই ‘অল রেড’দের একপেশে জয়ের গল্প।
প্রিমিয়ার লিগে সর্বশেষ ৭ ম্যাচের মাত্র ১টিতে জিতেছে ইউনাইটেড। আর সর্বশেষ ম্যাচে লিভারপুলের কাছে ৭–০ গোল খেয়ে বিধ্বস্ত হয় ইউনাইটেড। তাই লিভারপুল–ইউনাইটেড ম্যাচের উত্তাপ এখন শুধুই কাগজে–কলমে। মাঠের দ্বৈরথে জায়গাটা নিয়েছে এখন ম্যানচেস্টার সিটি–লিভারপুলের ম্যাচ। কয়েক মৌসুম ধরে প্রিমিয়ার লিগের অন্যতম আকর্ষণ এ দুই দলের লড়াই।
এমনকি অনেক সময় তাদের দুটি ম্যাচই হয়ে উঠেছে শিরোপা নির্ধারক। এবারও এ দুই দল যেভাবে মৌসুম শুরু করেছে, তাদের দুটি ম্যাচই হয়তো নির্ধারণ করতে দিতে পারে প্রিমিয়ার লিগ শিরোপার ভবিষ্যৎ। এই দ্বৈরথ অবশ্য যতটা দুই দলের, কৌশলগত দিক থেকে ততটাই দুই কোচের—পেপ গার্দিওলা ও ইয়ুর্গেন ক্লপ। কোচিং–দর্শনে দুজনের মধ্যে খুব একটা মিল না থাকলেও মাঠের লড়াইয়ে যেন ‘বিনা যুদ্ধে নাহি দিব সূচ্যগ্র মেদিনী’। দুজনের এই হার না মানা মনোভাব দুই দলের লড়াইকে করে তুলেছে আরও বেশি রোমাঞ্চকর।
২০২১ সালে ক্লপের সঙ্গে নিজের দ্বৈরথ নিয়ে গার্দিওলা বলেছিলেন, ‘সে (ক্লপ) আমাকে আরও ভালো ম্যানেজার হিসেবে গড়ে উঠতে সাহায্য করেছে।’ একইভাবে বিভিন্ন সময় ক্লপের মুখ থেকে শোনা গেছে গার্দিওলার জন্য প্রশংসা বাক্য। গত বছর ক্লপ বলেছিলেন, ‘সে (গার্দিওলা) বিশ্বের সেরা কোচ। সে সেটা সব সময় প্রমাণ করেছে। তারা যা করছে, সেটা বিশেষ কিছু। এটা সত্যিই বিশেষ এবং আমি তাকে সম্মান করি।’
মাঠের বাইরে একে অপরকে যতই সম্মান দেখাক। মাঠে লড়াইয়ে দুজনই বারবার একে অপরের জন্য হুমকি হয়ে উঠেছেন। ২০১৮–১৯ মৌসুমে ৯৭ পয়েন্ট পেয়েও মাত্র ১ পয়েন্টের জন্য সিটির কাছে শিরোপা হারিয়েছে লিভারপুল। একইভাবে ২০২১–২২ মৌসুমেও সেই এক পয়েন্টের ব্যবধানে শিরোপা হাতছাড়া করেছিল অলরেডরা। গার্দিওলার সিটি অপ্রতিরোধ্য হয়ে না উঠলে অন্তত দুটি শিরোপা জিততেই পারত লিভারপুল, যা দলটির সাফল্যকে নিয়ে যেতে পারত অন্য উচ্চতায়। একইভাবে লিভারপুল বাধা না হলে টানা ৬ বার লিগ জিতে শিরোপা জেতার ডাবল হ্যাটট্রিক করতে পারত সিটি। সেটি হলে সিটির অর্জনের গল্পটা নিশ্চয় আরেকটু সমৃদ্ধ হতো।
এবার চলতি মৌসুমেও শিরোপার লড়াই সামনে রেখে মুখোমুখি হতে যাচ্ছে এ দুই দল। দুই দলের বর্তমান অবস্থা ও পয়েন্ট তালিকার দিকে তাকালে মুখোমুখি হওয়ার জন্য এর চেয়ে গুরুত্বপূর্ণ সময় সম্ভবত আর হয় না। ১২ ম্যাচে ৯ জয়, ১ ড্র ও ২ হারে ২৮ পয়েন্ট নিয়ে শীর্ষে আছে সিটি। সমান ম্যাচে ৮ জয় ৩ ড্র এবং ১ হার নিয়ে তালিকার দুইয়ে আছে লিভারপুল।
কে জানে, এ মৌসুমেও হয়তো এই দুই দলের লড়াইয়েই নির্ধারিত হয়ে যেতে পারে শিরোপার ভাগ্যও। তবে আজ লড়াইটা সিটির মাঠে বলে এই ম্যাচে কিছুটা হলেও এগিয়ে থেকে মাঠে নামবে বর্তমান চ্যাম্পিয়নরা। গত মৌসুমে নিজেদের মাঠে লিভারপুল ১–০ গোলে জিতলেও সিটির মাঠে গিয়ে হেরেছিল ৪–১ গোলে।
এ ম্যাচের আগে আরও একটি তথ্য সিটিকে উজ্জীবিত করে তুলতে পারে। লিভারপুল সিটিকে তাদের মাঠে সর্বশেষ হারিয়েছিল ৮ বছর আগে ২০১৫ সালে। ম্যাচের আগে এই পরিসংখ্যান গার্দিওলা নিশ্চয় শিষ্যদের স্মরণ করিয়ে দেবেন, যা ইতিহাদে এবারের লড়াইয়েও নিশ্চিতভাবে অনুপ্রাণিত করবে গার্দিওলার দলকে।
এসব পরিসংখ্যানের পরও লিভারপুলকে স্বপ্ন দেখাতে পারে গার্দিওলা বনাম ক্লপের পরিসংখ্যান। প্রিমিয়ার লিগে গার্দিওলার সিটি অপ্রতিরোধ্য হলেও ক্লপের বিরুদ্ধে তুলনামূলকভাবে নড়বড়ে গার্দিওলারই দেখা মেলে প্রায়। এখন পর্যন্ত সব মিলিয়ে দুই কোচের দেখা হয়েছে ২৮ বার। যেখানে ক্লপের ১২ জয়ের বিপরীতে গার্দিওলার জয় ১১টিতে (প্রিমিয়ার লিগে অবশ্য গার্দিওলা এগিয়ে আছেন তাঁর ৫ জয়ের বিপরীতে ক্লপের জয় ৪টিতে)। তবে সামগ্রিক পরিসংখ্যান সমৃদ্ধ করতে গত জানুয়ারিতে ক্লপের কাছ থেকেই শেখার কথা বলেছেন গার্দিওলা। তিনি বলেছিলেন, ‘লিভারপুলকে দেখে আমি অনেক কিছু শিখেছি।’
ক্লপ যখন বরুসিয়া ডর্টমুন্ডে ছিলেন, তখন থেকেই তাঁর মুখোমুখি হয়ে আসছেন গার্দিওলা। বায়ার্ন মিউনিখের দায়িত্ব নেওয়ার পর ক্লপের ডর্টমুন্ডের কাছে প্রথম ম্যাচেই ৪–২ গোলে হেরেছিলেন গার্দিওলা। বুন্দেসলিগায় মূলত বুলেট গতির কাউন্টার অ্যাটাকে গার্দিওলাকে বারবার বিপদে ফেলেছেন ক্লপ। এই কৌশলের বিপরীতে পেরে উঠতে গার্দিওলাকে এখনো হিমশিম খেতে দেখা যায়। যে কারণে লিভারপুলের বিপক্ষে ম্যাচকে অনেকটা আয়নার মতো করে ব্যবহার করেন গার্দিওলা। অ্যানফিল্ডের খেলা থেকে শিক্ষা নিয়ে নিজের রক্ষণ–কৌশলেও কিছু পরিবর্তন এনেছেন গার্দিওলা, যা সিটিকে সামগ্রিকভাবে দারুণ উপকারই করেছে।
অন্যদিকে গার্দিওলার কৌশলও ক্লপকে নিজের পরিকল্পনা বাস্তবায়নে বারবার বিপদে ফেলেছে। বেশির ভাগ সময়ই বড় ম্যাচে কৌশলগত কিছু পরিবর্তন এনে চমকে দেন গার্দিওলা। পাশাপাশি সিটি খেলোয়াড়দের সমন্বয় ও পাসিং ফুটবলের কারণে নিজেদের সহজাত খেলাটা ঠিকঠাক খেলার ব্যাপারে বাধাগ্রস্ত হয় লিভারপুল। আজও হয়তো তেমন কোনো চমক নিয়ে হাজির হতে চাইবেন গার্দিওলা।
তবে দুই কোচের পাশাপাশি খেলোয়াড়দের লড়াইও আলাদা গুরুত্ব পাচ্ছে। এ মৌসুমে দারুণ ছন্দে আছেন লিভারপুলের মোহাম্মদ সালাহ। সিটি আক্রমণাত্মক ফুটবলে বেশি মনোযোগ দিলে সে সুযোগ কাজে লাগাতে মরিয়া হয়ে উঠতে পারেন সালাহ। তবে ছন্দে থাকা সালাহকে আটকাতে সেন্টারব্যাকদের ফুলব্যাক হিসেবে খেলানোর কৌশলেই স্থির থাকতে পারেন গার্দিওলা।
ওয়ান অন ওয়ানে এই বিষয়গুলোয় পূর্ণাঙ্গ ডিফেন্ডারদের ওপরই বেশি ভরসা করছেন গার্দিওলা। অন্যদিকে লিভারপুলের জন্য সবচেয়ে ভয়ের নাম আর্লিং হলান্ড। গত মৌসুমে অ্যানফিল্ডে একরকম বোতলবন্দী হয়ে ছিলেন হলান্ড। এবার লিভারপুল ডিফেন্সের জাল ছিঁড়তে নিশ্চয় মরিয়া হয়েই মাঠে নামবেন এই নরওয়েজীয় তারকা, যা কিনা ভার্জিল ফন ডাইকের সঙ্গে তাঁর দ্বৈরথকে আরও রোমাঞ্চকর করে তুলতে পারে।
সব মিলিয়ে দুই দলের চমক, ফরমেশন কিংবা কৌশল যেমনই হোক, আজ জয়ের জন্যই মাঠে নামবে দুই দল। এই ম্যাচ জিতলে পয়েন্ট তালিকার পাশাপাশি আত্মবিশ্বাসের পালেও লাগবে বাড়তি হাওয়া। মৌসুমের এমন পরিস্থিতিতে যা জয়ী দলটিকে এগিয়ে দেবে অনেক দূর।