ক্রুস–রয়েসের যিনিই জিতুন, হার তো ফুটবলের
ডর্টমুন্ড থেকে গ্রেইফসওয়াল্ডের দূরত্ব প্রায় ৬০০ কিলোমিটার। এই দুই শহরের কাছাকাছি সময়ে জন্ম তাঁদের দুজনের। বয়সের ব্যবধান মাত্র এক বছরের। পেশাদার ফুটবলে দুজনের আগমনও কাছাকাছি সময়ে। জাতীয় দলেও দুজনের অভিষেক সেই প্রায় এক বছরের ব্যবধানেই। এমনকি ক্যারিয়ারের শুরু থেকেই দুজনকে বিবেচনা করা হচ্ছিল নিজেদের প্রজন্মের অন্যতম সেরা প্রতিভা হিসেবে। কিন্তু ২০১৪ সালের পর বেড়ে যায় দুজনের দুরত্ব। গত প্রায় ১০ বছর ধরে দুজনের বাস অবশ্য ১,৮৪০ কিলোমিটার দূরত্বের দুটি শহরে।
একজনের ডর্টমুন্ডে এবং অন্যজনের মাদ্রিদে। স্থানিক দুরত্বের মতো এর মধ্যে বেড়ে গেছে দুজনের অর্জনের ব্যবধানও। রিয়াল মাদ্রিদের হয়ে টনি ক্রুসের অর্জনের ঝুলি যখন পূর্ণ হচ্ছিল, তখন বরুসিয়া ডর্টমুন্ডের হয়ে মার্কো রয়সের একেকটি মৌসুম কাটছিল হতাশায়। তবে প্রায় দুই হাজার কিলোমিটারের সেই দূরত্ব অতিক্রম করে আজ রাতে দুজন এসে ফের মিলবেন একই বিন্দুতে। যেখানে শেষ হবে ফুটবল ক্যারিয়ারে দুজনের বর্ণাঢ্য অধ্যায়। ফাইনালের আগে দুজনের দূরত্ব ঘুচে গেলেও, ফাইনাল শেষে সেটি আবার বাড়বে। একজন থাকবেন উদ্যাপনের চূড়ায়, আর অন্যজন হতাশার তলানিতে।
অতীত ইতিহাস আর ভাগ্যের কররেখা গুনে দেখলে শেষ হাসিটা ক্রুসেরই হাসার কথা। দুজনের ট্রফি ক্যাবিনেটও বলছে সে কথা। কিন্তু নিরেপক্ষ জায়গা থেকে বিবেচনা করলে রয়েসের যে একটা ট্রফি প্রাপ্য, সেটা হয়তো তাঁর চিরশত্রুরাও স্বীকার করে নেবেন।
পাশাপাশি এটাও সত্য যে শুধু ট্রফি দিয়ে রয়েসকে মাপাটা হবে বোকামি। গত এক যুগ ধরে হলুদ-কালো জার্সিতে নিজেকে ট্রফি ক্যাবিনেটের ঊর্ধ্বে নিয়ে গেছেন এই জার্মান ফুটবলার। অন্তত সিগনাল ইদুনা পার্কে তো বটেই। প্রতি ম্যাচে ইদুনা পার্কের গ্যালারিতে হলুদ সমুদ্রের যে ঢেউ ওঠে, তার প্রতিটি তরঙ্গে মিশে আছেন রয়েস।
ফুটবলকে যাঁরা চাওয়া–পাওয়া আর প্রাপ্তির টালিখাতার বাইরে বিবেচনা করেন, রয়েস যে তাঁদেরই একজন। ক্যারিয়ারের সেরা ছন্দে থাকার সময়ই ফুটবল পরাশক্তিদের ডাক এসেছিল, অর্থ এবং সাফল্য সবটাই আসতে পারত করতলে। কিন্তু সন্তের মতো সব কিছু থেকে মুখ ফিরিয়ে রেখেছিলেন হলুদ দেয়ালটির দিকে।
কিন্তু সন্তেরও তো একদিন মোক্ষ কিংবা নির্বাণ লাভ হয়। নিজের অস্তিত্বকে বিলীন করে হলেও সেই চূড়ান্ত লক্ষ্যে পৌঁছান তাঁরা। রয়েসের জন্য তবে বিধানটা কী? তিনি চাইলে প্রশ্নটা তুলতেই পারেন, ফুটবলে নিজেকে উজাড় করে দেওয়ার বিনিময়টা তবে কেমন? এগার বছর আগে ক্রুসদের নিয়ে গড়া বায়ার্ন মিউনিখের কাছে চ্যাম্পিয়নস লিগ ফাইনাল হেরেছিল এই ওয়েম্বলিতে। এরপর গত মৌসুমে শেষ দিনের অবিশ্বাস্য নাটকীয়তায় সেই বায়ার্নের কাছে হাতছাড়া হলো বুন্দেসলিগার শিরোপা। গত ১২ বছরের ক্যারিয়ারে ডর্টমুন্ডের হয়ে রয়েসের অর্জন বলতে কেবল দুটি জার্মান কাপ এবং তিনটি সুপার কাপ জয়।
ক্যারিয়ারের ব্যাপ্তি এবং গুরুত্ব বিবেচনায় বড্ড সাদামাটা অর্জন। এমনকি জাতীয় দলের জার্সিতেও মিলেছে হতাশা। ২০১৪ বিশ্বকাপের আগ মুহূর্তে চোটে পড়ে ছিটকে গেলেন দারুণ ছন্দে থাকা রয়েস। জার্মানির চতুর্থ বিশ্বকাপ জয়টা তাঁকে দেখতে হয়েছে দর্শক হিসেবে। রয়েসের এই ক্যারিয়ারকে তুলনা করা যায় কেবল লা মাঞ্চার দন কিহোতোর অভিযানের সঙ্গে। যেখানে দিন শেষ শুধু হতাশা আর গ্লানিই সঙ্গী হয়েছে।
এমন হতাশয় ভরপুর ক্যারিয়ারে কিহোতোর মতো রয়েসও কখনো নিজের দায়িত্ব থেকে পিছপা হননি। যখনই দলের প্রয়োজন হয়েছে সামনে এগিয়ে এসেছেন, হয়েছেন ক্লাবের ঐক্য ও ঐতিহ্যের প্রতীকও। ক্লাবের প্রতি আনুগত্য প্রদর্শনে রয়েসের তুলনা কেবল তিনি নিজেই। ফুটবল যখন ক্রমশ অর্থ ও অর্জনের সমার্থক হয়ে উঠছে, তখনো কর্মনৈতিকতার বিরল এক দৃষ্টান্ত হয়ে আছেন রয়েস। কিন্তু এত কিছুর বিনিময়েও রয়েসের বড় কোনো শিরোপা জিততে না পারাটা প্রকৃতির নির্মম খেয়াল ছাড়া আর কি!
রয়েস নিজে অবশ্য বিষয়টাকে দেখেন ভিন্নভাবে। উয়েফাকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে তিনি বলেছেন, ‘ডর্টমুন্ড আমার কাছে সব কিছু। ১২ বছর একটি ক্লাবে থেকে যাওয়ার সব সময় ভিন্ন অর্থ বহন করে। আপনি শুধু নাম কিংবা অর্থের জন্য থাকবেন না। আপনাকে স্বস্তি পেতে হবে, ভালো পরিবেশ পেতে হবে এবং দারুণ সতীর্থ পেতে হবে।’
পুরো চিত্রটি অবশ্য বদলে যেতে পারে আজ রাতে। যে ওয়েম্বলি দিয়ে হৃদয়ভাঙার শুরু, সেই মাঠেই আজ দায় শোধ করার সুযোগ ফুটবলের। ফাইনালে রিয়ালের বিপক্ষে ডর্টমুন্ডের একটি জয় রয়েসের ক্যারিয়ার গ্রাফটাকে তলানি থেকে নিয়ে যাবে সপ্তম স্বর্গে। যা একই সঙ্গে ভুলিয়ে কখনো বড় শিরোপা না জেতার সব হতাশাও।
এটি রয়েসের জন্য হবে জন্মদিনের উপহারও। গতকালই যে নিজের ৩৫তম জন্মদিন পালন করেছেন তিনি। পাশাপাশি শেষের এই অর্জনটা রয়েসকে দেবে বাকি জীবনে গল্প করার মতো রসদও। নিজের শেষ ম্যাচে ডর্টমুন্ডের হয়ে ট্রফি জেতার উপলক্ষটা কেমন হতে পারে, সেটি শোনা যাক রয়েসের মুখে, ‘আমাদের লক্ষ্য এখন শিরোপা জেতা। কারণ, শিরোপা জেতার পরদিন এখানকার (ডর্টমুন্ড শহরের) চিত্রটা কেমন হবে, তা আমরা কল্পনাও করতে পারব না।’
ক্রুসের ক্যারিয়ারে চিত্রনাট্যটা অবশ্য ভিন্ন কালিতে লেখা। ২০১৪ সালে বায়ার্ন মিউনিখ থেকে রিয়ালে আসেন এ জার্মান মিডফিল্ডার। মিউনিখ থেকে আসার সময় তাঁর স্যুটকেসে তিনটি বুন্দেসলিগা ট্রফির সঙ্গে ছিল একটি চ্যাম্পিয়নস লিগ এবং একটি বিশ্বকাপ ট্রফিও। ক্রুসের এই ‘চ্যাম্পিয়নস–লাক’ রিয়ালেও ছিল তাঁর ছায়াসঙ্গী হয়ে। গত ১০ বছরে সান্তিয়াগো বার্নাব্যুর ক্লাবটির হয়ে চারটি লা লিগা শিরোপার পাশাপাশি চারটি চ্যম্পিয়নস লিগ শিরোপা জিতেছেন ক্রুস।
শুধু শিরোপা জয়েই নন, মাঠে এক দশক ধরে রিয়ালের অন্যতম সেরা তারকা ছিলেন এ জার্মান ‘স্নাইপার’। রিয়ালের হয়ে লা লিগায় কোনো মৌসুমেই তাঁর সঠিক পাসের হার গড়ে ৯২ শতাংশের নিচে নামেনি। অবিশ্বাস্য পারফরম্যান্সে ম্যাচের পর ম্যাচে রিয়ালের হয়ে মিডফিল্ডে ছড়ি ঘুরিয়েছেন তিনি।
তাঁর একটি ভয়ঙ্কর পাসেই অসংখ্যবার ম্যাচের চিত্র বদলে গেছে। বলা হয়, ‘৪০ পাসে বার্সা যা করে, ক্রুস এক পাসেই তা করতে পারেন।’ এ কথা বিশ্বাস না হলেও বায়ার্ন মিউনিখের বিপক্ষে সেমিফাইনালের প্রথম লেগের ম্যাচটাই আরেকবার দেখা যাক। সেদিন চার ডিফেন্ডারের কাছ থেকে গার্ড অব অনার আদায় করে যে পাসটি ভিনিসিয়ুসের উদ্দেশ্যে বাড়িয়েছিলেন ক্রুস, তা বায়ার্ন ডিফেন্ডারদের দুঃস্বপ্নে আরও অনেক দিন ফিরে আসবে। অথচ সেদিন ক্রুসের এই পাসটির আগ পর্যন্ত রিয়াল ছিল বড্ড সাদামাটা এক দল।
কিন্তু সব ভালো কিছুই নাকি কখনো না কখনো শেষ হতে হয়। সে নিয়ম মেনেই আজ বর্ণাঢ্য ক্যারিয়ারের ইতি টানবেন ৩৪ বছর বয়সী ফুটবলার। রয়েসের মতো ক্রুসের আনুগত্য নিয়ে প্রশ্ন তোলারও কোনো সুযোগ নেই। তিনি সব সময় চেয়েছেন রিয়ালের খেলোয়াড় হিসেবে অবসরে যেতে, নিজের সেই কথাও রেখেছেন তিনি। রিয়ালের পর আর কোনো দলের জার্সিতে দেখা যাবে না তাঁকে। অথচ তাঁর সামনেও সুযোগ ছিল রিয়ালকে বিদায় জানিয়ে সৌদি আরব বা যুক্তরাষ্ট্রে গিয়ে ফুটবল খেলে টাকা আয় করার।
কিন্তু সেই মোহকে কবর চাপা দিয়ে রিয়াল জার্সিতে নিজেকে মিশিয়ে দিয়ে বিদায় নিতে যাচ্ছেন এ মিডফিল্ড–জেনারেল। তবে যাওয়ার আগে আজ আরও একবার সুযোগ আছে শিরোপা দিয়ে বিদায়টা রাঙানোর। ভিনিসিয়ুস–কামাভিঙ্গা–রদ্রিগোরা ঘোষণা দিয়ে রেখেছেন ক্রুসের জন্য নিজেদের উজাড় করে দেওয়ার। ক্রুস নিজেও চাইবেন না নিজের বিদায়টাকে মন খারাপের চাদরে মুড়িয়ে দিতে। তাই যতক্ষণ মাঠে থাকবেন, চেষ্টা করবেন শেষবারের মতো আরেকটি ডিফেন্সছেড়া পাসে কিংবা নিশানা তাক করা ক্রসে ম্যাচের গতিপথ বদলে দিতে।
শেষ পর্যন্ত আজ ক্রুস–রয়েসের যে–ই জিতুন, জয়টা হবে ফুটবলেরই। পাশাপাশি এদের যেই হারুন, হারটা হবে ফুটবলেরই। ফুটবলের জন্য আজকের দিনটা তাই শেষ পর্যন্ত মন খারাপেরই। দুই কিংবদন্তির একজনকে যে খালি হাতেই ফেরাতে হবে তাকে।