ফিফা কেন ইসরায়েলকে শাস্তি দেয় না

ইতিহাদ স্টেডিয়ামের বাইরে প্ল্যাকার্ড হাতে এক ফুটবলপ্রেমী। ইসরায়েলের আগ্রাসনের বিরুদ্ধে বিশ্বের অনেক জায়গাতেই একাট্টা হয়েছেন সাধারণ মানুষরয়টার্স
গত ১৮ মার্চ থেকে গাজায় পুনরায় আগ্রাসন শুরু করেছে ইসরায়েলি সামরিক বাহিনী। গাজার স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের তথ্যনুযায়ী, এর পর থেকে ১ হাজার ৩৩০ জনের বেশি মানুষ মারা গেছেন। আর গত ১৭ মাসের বেশি সময় ধরে চলা ইসরায়েলের হামলায় অন্তত ৫০ হাজার ৫২৩ জন ফিলিস্তিনি নিহত হন এবং আহত ১ লাখ ১৪ হাজার ৬৩৮ জন। এই সামরিক হামলা ও ফিলিস্তিনের ভূখণ্ডে ইসরায়েলের কিছু ক্লাবের অবস্থানের কারণে গত বছর মে মাসেই দেশটিকে আন্তর্জাতিক ফুটবলে নিষিদ্ধের দাবি জানিয়েছিল ফিলিস্তিন ফুটবল অ্যাসোসিয়েশন। ফিফা গত অক্টোবরে জানায়, এই বিষয়ে তদন্ত করা হবে। এর আগে ২০১৭ সালেও ইসরায়েলের বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেওয়ার দাবি উঠলে ফিফা জানিয়েছিল ‘রাজনীতি ও ধর্মীয় বিষয়ে নিরপেক্ষ থাকবে।’ যদিও সাধারণের দৃষ্টিভঙ্গি হলো, রাজনৈতিক কারণেই ফিফা ইসরায়েলকে নিষিদ্ধ করে না। এ নিয়ে গত মাসে যুক্তরাজ্যকেন্দ্রিক ওয়েবসাইট ‘মিডল ইস্ট আই’তে ‘ফিফা কেন ইসরায়েলকে শাস্তি দেয় না’—শিরোনামে প্রতিবেদন লেখেন স্কটিশ লেখক, জলবায়ুকর্মী কোল ম্যাককাইল। লেখাটি বাংলায় তুলে ধরা হলো—

১৯৭৬ সালের মার্চ মাস। যুক্তরাষ্ট্রের ইন্ধনে আর্জেন্টিনায় সামরিক জান্তার ক্যুতে উৎখাত হলো ইসাবেল পেরন সরকার। দুই দিন পর ফিফা সভাপতি বললেন, ১৯৭৮ বিশ্বকাপ আয়োজনে আর্জেন্টিনা ‘এখন আগের চেয়েও বেশি প্রস্তুত’।

হোর্হে রাফায়েল ভিদেলার সেই স্বৈরশাসনে প্রায় এক দশক রক্তপাত চলে আর্জেন্টিনায়। ‘নিখোঁজ’ হন প্রায় ৩০ হাজার মানুষ। কিন্তু ফুটবলের নিয়ন্ত্রক সংস্থাটির হর্তাকর্তারা এতে গা করেননি। ১৯৭৮ বিশ্বকাপ শেষে টুর্নামেন্টটির আয়োজকদের অন্যতম আর্জেন্টিনা নৌবাহিনীর ভাইস অ্যাডমিরাল কার্লোস লাকোস্তেকে সহসভাপতি বানায় ফিফা।

চলতি মাসের (মার্চ) শেষ দিকে ২০২৬ বিশ্বকাপ বাছাইপর্ব শুরু করবে (হয়ে গেছে) ইসরায়েল। প্রতিযোগিতাটি থেকে ইসরায়েলকে নিষিদ্ধ করার আহ্বান প্রতিহত করার ধারাবাহিকতা ধরে রেখেছে ফিফা। সাম্রাজ্যবাদের হাতিয়ার হিসেবে দেশটির ফুটবল অ্যাসোসিয়েশনের (আইএফএ) অন্ধকার ইতিহাস আছে।

আরও পড়ুন

ফিলিস্তিন ফুটবল অ্যাসোসিয়েশন (পিএফএ) ১৯৯৮ সালে ফিফার সদস্যপদ পাওয়ার সময় থেকে ইসরায়েলের অবৈধ দখলদারত্ব দেখেও দেখছে না ফিফা, যা আন্তর্জাতিক মানবাধিকার আইনের প্রতি ফিফার প্রতিশ্রুতির সরাসরি লঙ্ঘন। দশকের পর দশক ইসরায়েল ফুটবল অ্যাসোসিয়েশনের (আইএফএ) ইন্ধনে অবৈধভাবে জায়গা দখল করে আছে ফুটবল ক্লাবগুলো, যা পরিষ্কারভাবে ফিফার আইনের পরিপন্থী। যেখানে বলা হয়েছে, ‘সদস্য অ্যাসোসিয়েশন এবং তাদের ক্লাবগুলো আরেকটি সদস্য অ্যাসোসিয়েশনের অঞ্চলে তাদের অনুমতি ছাড়া খেলতে পারবে না।’

ইসরায়েলি সমর্থকদের খুবই নিন্দনীয় আচরণ দীর্ঘদিন ধরে সবার চোখ এড়িয়ে যায়। ৫ বছর আগে বেইতার জেরুজালেমকে ‘ইসরায়েলের সবচেয়ে বর্ণবাদী’ ক্লাব হিসেবে ঘোষণা করে ‘দ্য ইকোনমিস্ট’। এই সংবাদমাধ্যমটি জানিয়েছিল, ক্লাবটির সমর্থকেরা ‘প্রতিপক্ষ দলের আরব খেলোয়াড়দের “সন্ত্রাসী” বলে।’

সুইজারল্যান্ডের জুরিখে ফিফার সদরদপ্তর
রয়টার্স

আইএফএর বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে না পারার ব্যাখ্যায় ২০১৭ সালে ফিফার পক্ষ থেকে বলা হয় ‘রাজনৈতিক ও ধর্মীয় বিষয়ে নিরপেক্ষ অবস্থান’ তাদের। কিন্তু ইউক্রেনে আগ্রাসন শুরুর পর রাশিয়াকে খুব দ্রুত ২০২২ বিশ্বকাপ থেকে বহিষ্কার করা হয়েছিল। ফিফার ‘খেলার জন্য, বিশ্বের জন্য’ স্লোগানটি এ ক্ষেত্রে আংশিকভাবে কার্যকর হয়েছে।
এই লেখায় ফিফাকে মন্তব্য করার আমন্ত্রণ জানানো হয়েছিল এবং সংস্থাটির সঙ্গে যোগাযোগ করা হয়েছিল। কিন্তু লেখাটি প্রকাশের আগপর্যন্ত কোনো প্রতিক্রিয়া পাওয়া যায়নি।

আরও পড়ুন

গাজায় ধ্বংসযজ্ঞ

২০২৩ সালের অক্টোবর থেকে গাজায় ফুটবলীয় অবকাঠামো ধ্বংসপ্রাপ্ত হয়েছে। ইসরায়েলি বাহিনী ৩৫০ জনের বেশি (সর্বশেষ তথ্যানুযায়ী প্রায় ৭০৮ জন অ্যাথলেট) ফুটবলারকে মেরে ফেলেছে। গত বছর জানুয়ারিতে ফিলিস্তিন অলিম্পিক ফুটবল দলের কোচ ও সাবেক প্লে মেকার ৪২ বছর বয়সী হানি আল–মাসদারকে ইসরায়েলি বিমান হামলায় মেরে ফেলা হয়। দুই মাস পর গত রোজার প্রথম দিনে ফিলিস্তিনের ঘরোয়া ফুটবলের ইতিহাসে প্রথম শত গোল করা মোহাম্মদ বারাকাতকে মেরে ফেলা হয় তাঁর পারিবারিক বাসায় বোমা মেরে।

গাজা শহরে ইয়ারমুক স্পোর্টস অ্যারেনা, যেটা একসময় ৯ হাজার আসনের ফুটবল স্টেডিয়াম ছিল, তার কিছুই আর অবশিষ্ট নেই। ইসরায়েলি বাহিনী এ জায়গাটাকে অনেক দিন আটক রাখার জায়গা হিসেবে ব্যবহার করেছে। স্টেডিয়ামটির চারপাশে ট্যাংক চক্কর খেয়েছে আর বহু ফিলিস্তিনি নাগরিককে শুধু অন্তর্বাস পরিয়ে হাঁটু গেড়ে হাত দুটি পেছনে বেঁধে ফেলে রাখা হয়েছে। বাকিদের ঘণ্টার পর ঘণ্টা নির্যাতন করা হয়েছে।

গাজায় এমন ধ্বংসযজ্ঞই চালিয়েছে ইসরাইলি সামরিক বাহিনী
এএফপি

গত বছর মে মাসের মধ্যে এই অ্যারেনায় ধ্বংসপ্রাপ্ত না হওয়া ফুটবল স্টেডিয়ামটি গাজার উত্তরাঞ্চল থেকে পালানো বহু মানুষের আশ্রয়কেন্দ্র হয়ে ওঠে। একই মাসে ফিফা সভাপতি জিয়ান্নি ইনফান্তিনো বলেন, ইসরায়েলি ফুটবলকে নিষিদ্ধ করতে পিএফএ যে আবেদন জানিয়েছে, সে বিষয়ে সিদ্ধান্ত দিতে তিনি স্বাধীন আইনি পরামর্শ নেবেন। ফিফা এখনো এ বিষয়ে কিছু বলেনি।

ইয়ারমুক স্টেডিয়ামে আটক থাকা বন্দীরা তাঁদের ওপর চলা নির্যাতনকে চিলির জাতীয় স্টেডিয়ামে চলা হত্যাযজ্ঞের সঙ্গে তুলনা করেছিলেন। ১৯৭৩ সালে যুক্তরাষ্ট্রের ইন্ধনে ক্যুতে এই স্টেডিয়ামে প্রচুর মানুষকে মেরে ফেলেছিলেন জেনারেল অগাস্ত পিনোশে। দুই মাস পর একই মাঠে সাবেক সোভিয়েত ইউনিয়নের বিপক্ষে ১৯৭৪ বিশ্বকাপ বাছাইয়ের ম্যাচ খেলতে নেমেছিল চিলি। সোভিয়েতরা ‘রক্তের দাগ থাকা মাঠে’ খেলতে চায়নি। কিন্তু ফিফার নির্দেশে মাঠে নামতে হয় এবং ফাঁকা জালে গোল করে বিশ্বকাপে খেলা নিশ্চিত করেছিল চিলি।

ফিফার কর্মকর্তারা ম্যাচের আগে মাঠটি দেখতে গিয়েছিলেন। চিলির সামরিক জান্তা বন্দীদের সেখান থেকে লুকিয়ে ফেলেছিল। গ্যালারিতে থাকা কিছু বন্দীর ভাষ্যমতে, ফিফার কর্মকর্তারা ‘শুধু ঘাস কেমন, সেটা নিয়েই আগ্রহ’ দেখান।

ঔপনিবেশিক যন্ত্র

ফিফা ১৯০৪ সালে ইউরোপিয়ান শক্তির হাতে প্রতিষ্ঠিত। এর পর থেকে পৃথিবীর দক্ষিণের অংশকে পশ্চিমের কাছে অধীনস্থ রাখার যে ঔপনিবেশিক বন্দোবস্ত, তাকে বৈধতা দিয়েছে ফিফা। সাম্য আনার বদলে আন্তর্জাতিক ফুটবল দীর্ঘদিন ধরেই ‘নিয়মপ্রসূত আন্তর্জাতিক সংহতি’র ক্ষেত্রে দ্বন্দ্ব তৈরি করেছে, যা বিশ্বের এক প্রান্তের সম্পদ আরেক প্রান্তে নেওয়ার জন্যই তৈরি করা হয়েছে।

ইউরোকেন্দ্রিকতার কারণে ফিফার ইতিহাসে বিশ্বকাপে একবারই সংঘবদ্ধ বর্জন হয়েছে। ১৯৬৬ বিশ্বকাপ বর্জন করে পুরো আফ্রিকা মহাদেশ। কারণ, প্রতিটি মহাদেশ থেকে বিশ্বকাপে খেলার সুযোগ পাওয়ার ক্ষেত্রে বৈষম্য। ইউরোপ থেকে জায়গা ছিল ১০টি, আফ্রিকা, এশিয়া ও ওশেনিয়া থেকে জায়গা একটি করে।

ফিফা সভাপতি জিয়ান্নি ইনফান্তিনো
এএফপি

মহাদেশজুড়ে ঔপনিবেশিকতাবিরোধী আন্দোলনের জোয়ার কাজে লাগিয়ে বিশ্বকাপ বর্জনের ডাক দিয়েছিলেন ঘানার প্রয়াত নেতা এবং প্রধানমন্ত্রী কওমি নক্রুমা। আফ্রিকান ফুটবল কনফেডারেশনের সব সদস্য সেই বিশ্বকাপের বাছাইপর্ব বর্জন করে, যে কারণে পরে ফিফা জরিমানাও করেছিল। তবে সেই বর্জনের ডাক পরে সফল হয়। চার বছর পর ১৯৭০ বিশ্বকাপে আফ্রিকা মহাদেশ থেকে স্থায়ী জায়গা রাখা হয়।

গাজার ফুটবল–সংশ্লিষ্ট স্থাপনাগুলো ইসরায়েল যেভাবে ধ্বংস করছে, সেটা অবশ্যই এভাবে বুঝতে হবে যে ফিলিস্তিনের প্রতিটি জায়গায় ইসরায়েলি সামরিক বাহিনী যেভাবে যুদ্ধ করছে, তার লক্ষণের সঙ্গে মিল আছে। এই সহিংসতাকে ফিলিস্তিনের মানুষ শক্ত মনোবলে প্রতিরোধ করেছেন। ২০২৪ সালের জানুয়ারিতে মাসদারকে মেরে ফেলার কয়েক দিন পর ফিলিস্তিন জাতীয় দল প্রথমবারের মতো এশিয়ান কাপের চূড়ান্ত পর্বে খেলা নিশ্চিত করে। একটি জাতিকে মুছে ফেলতে ওই বাধাটুকু ফুটবল বিশ্বের সংহতি পাওয়ার দাবিদার।

গত মাসে সেল্টিকের সমর্থকেরা ‘ইসরায়েলকে লাল কার্ড দেখাও’ নামে ফিফার জন্য প্রচারণা শুরু করে। স্পেন, মরক্কো থেকে আয়ারল্যান্ডেও অনেকে সেল্টিক সমর্থকদের সুরে সুর মিলিয়েছেন। ফুটবলের নিয়ন্ত্রক সংস্থা সাম্রাজ্যবাদের পক্ষে অপরাধগুলোকে যখন দশকব্যাপী বৈধতা দিয়ে আসছে, তখন পৃথিবীর আঙিনায় ফিলিস্তিনের পতাকা শোভা যাচ্ছে।

(এই লেখার মতামত লেখকের সম্পূর্ণ নিজস্ব।)