ম্যারাডোনা: কখনো দেবতা, কখনো বিপ্লবী, আবার কখনো জোচ্চোর ও মাদকসেবী
‘যখন তার কাছে বল থাকত না, তখন সে মা দিবসে আদমের চেয়েও নিজেকে একা মনে করত’—ডিয়েগো ম্যারাডোনাকে নিয়ে কথাগুলো বলেছিলেন মেক্সিকান লেখক হুয়ান ভিলোরো।
অনেক বছর আগে বুয়েন্স এইরেসের ধূলিমাখা পথ থেকে যাত্রা শুরু করেছিলেন একজন ডিয়েগো ম্যারাডোনা। খুব সরল কোনো পথ নয়, বরং আঁকাবাঁকা ও চড়াই-উতরাইয়ে ভরা। সেই পথ ধরে ম্যারাডোনা নামের সেই ছেলে কোথায় পৌঁছাতে চেয়েছিলেন, শুরুতে তা হয়তো তিনি নিজেও জানতেন না। তবে তিনি যা জানতেন, সেটা হলো এই চলার পথে যা কিছু আসবে, সবকিছুকেই দৃঢ়তার সঙ্গে বরণ করে নিতে হবে। আর এভাবে নিতে নিতে তিনি হয়ে উঠবেন ইতিহাসের অন্যতম সেরা ফুটবলার।
শুধু ফুটবলার পরিচয়ে ম্যারাডোনাকে আটকে রাখার সুযোগ নেই। কারণ, শেষ পর্যন্ত ফুটবলারের চেয়েও বড় কিছু হয়ে উঠেছিলেন তিনি। হয়ে ওঠেছিলেন ইতিহাসের সবচেয়ে বর্ণিল চরিত্রগুলোর একটি। এমন বর্ণিল চরিত্র যাকে কাঠামোয় ধরে রাখা কঠিন। এত কিছুর সন্নিবেশ কীভাবে একজন মানুষের মধ্যে থাকতে পারে, সে-ও এক পরম আশ্চর্যের বিষয়। তবে যেসব শিল্পী সেই বর্ণিল চরিত্রটিকে সার্থকভাবে তুলে আনতে পেরেছিলেন, সার্বিয়ান চলচ্চিত্র পরিচালক এমির কুস্তোরিকা তাঁদের অন্যতম। হয়তো বন্ধু ছিলেন বলেই এতটা সৎ ও নিখুঁতভাবে ম্যারাডোনাকে পর্দায় হাজির করতে পেরেছিলেন কুস্তোরিকা।
ম্যারাডোনার চারিত্রিক বৈশিষ্ট্যের মতোই এই প্রামাণ্যচিত্র খানিকটা খাপছাড়া ও এলোমেলো। তবে কুস্তোরিকার অন্য কাজগুলো দেখলে বিষয়টা মোটেই অপরিকল্পিত বা উদ্দেশ্যহীন মনে হবে না। অনৈক্যের এই ঐক্য কুস্তোরিকার অন্য চলচ্চিত্রগুলোতে বেশ প্রবল। পাশাপাশি এটিকে ম্যারাডোনার চরিত্রের প্রতীকী প্রকাশ হিসেবেও দেখা যেতে পারে।
এই প্রামাণ্যচিত্র শুরু হয় বুয়েনস এইরেসের একটি কনসার্টের দৃশ্য দিয়ে। এরপর ভয়েস ওভারে শোনা যায় কুস্তোরিকার কণ্ঠ। তিনি বলেন, ‘ডিয়েগো খুব সহজেই আমার প্রথম সিনেমার নায়ক হতে পারত।’ এভাবেই মূলত শুরু হয় প্রামাণ্যচিত্রটি। একই সঙ্গে একজন নায়ক এবং প্রতি নায়কের গল্প। আরও সহজভাবে বললে পরিচালক কুস্তোরিকার একজন বন্ধুর গল্প।
বন্ধু বলেই হয়তো এমন কিছু তিনি তুলে আনতে পেরেছিলেন, যা অন্য কারও পক্ষে সম্ভব হতো না। একজন মানুষ কীভাবে এই মুহূর্তে ঈশ্বর, পরের মুহূর্তে বিপ্লবী এবং তার পরের মুহূর্তে খলনায়ক হয়ে উঠছেন, তা এখানে খুব সুক্ষ্মভাবে নিয়ে এসেছেন কুস্তোরিকা। এই প্রামাণ্যচিত্রের একটি গুরুত্বপূর্ণ দিক ছিল ম্যারাডোনার ওপর আরোপিত দেবত্বের উপস্থাপন। আর্জেন্টিনায় ম্যারাডোনা এতটাই সম্মানিত যে তাঁর নামে রীতিমতো চার্চ বানানো হয়েছে। যেখানে ভক্তরা এসে একজন জীবিত মানুষেরই পূজা করছে। খোদাই করে দিচ্ছে তাঁর অমরত্বকে।
অথচ ম্যারাডোনার জীবনের দিকে ফিরে তাকালে সেখানে শ্রেষ্ঠত্বের পাশাপাশি কদর্যতা আর বিতর্কও ছিল ভরপুর। ম্যারাডোনা তো কোনো ধর্মীয় নেতা ছিলেন না, ছিলেন না কোনো নৈতিকতার আধারও। বরং প্রচলিত সব নৈতিক ধ্যানধারণাকে তিনি তুচ্ছ করতে পেরেছিলেন, নিজের হৃদয়ের ডাক শুনেছিলেন। আর সেই ডাকই হয়তো ম্যারাডোনাকে এমন একটা জায়গায় বসিয়ে দিয়েছে। এসব বিষয় খুব নান্দনিকভাবে উঠে এসেছে কুস্তোরিকার এই প্রামাণ্যচিত্রে।
ম্যারাডোনা হয়তো শেষ পর্যন্ত কোনো দেবতা নন, কিন্তু তিনি যে নিপীড়িত মানুষের কণ্ঠস্বর ছিলেন, তা নিয়ে কোনো সন্দেহ নেই। যে কারণে দেবতাকেই আমরা একটু পর দেখব, ‘স্টপ বুশ’ লেখা টি–শার্ট পরে বক্তব্য দিতে। যে বক্তব্যে বুশকে যিনি সম্বোধন করেন ‘আবর্জনা’ বলে। যেসব বিষয় সেলিব্রিটিরা সচেতনে এড়িয়ে যান, সেসব বিষয় নিয়ে ম্যারাডোনা কথা বলে যান অবলীলায়।
নিজের এই অবস্থানগত কারণেই ম্যারাডোনা বাকিদের চেয়ে একেবারেই আলাদা হয়ে উঠেছেন। হতে পেরেছেন সাধারণের মধ্যে অসাধারণও। আর অসাধারণ চারিত্রিক গুণের কারণেই ফিদেল কাস্ত্রো কিংবা হুগো সাভেজের মতো বিপ্লবীদের বন্ধুও হয়েছেন তিনি। তবে ম্যারাডোনা তাঁর জীবনে যা কিছু করেছেন, সবকিছুর মূলে ছিল ফুটবল এবং ফুটবল মাঠে অমিত প্রতিভার বিচ্ছুরণ। আর সেই প্রতিভার ইপিটোমি বা চূড়ান্ত বিন্দু হচ্ছে ১৯৮৬ বিশ্বকাপে ইংল্যান্ডের বিপক্ষে তাঁর করা দ্বিতীয় গোলটি।
ফুটবল ইতিহাসের মহাকাব্যিক এক গোল। যে গোল মূলত ম্যারাডোনাকে নিয়ে গেছে অন্য উচ্চতায়। সেই সঙ্গে অবশ্য একই আর্জেন্টিনার বিশ্বকাপ জয়ের কথাও বলতে হবে। কিন্তু মাঠে যে মানুষটি বল পায়ে পৃথিবীর শ্রেষ্ঠতম শিল্পী, মাঠ না ছাড়তেই হয়ে উঠেন রক্তমাংসের আগাগোড়া সাধারণ সমস্যায় পরিপূর্ণ একটা সত্তা। এই যে একই মানুষের মধ্যে দ্বৈত সত্তার লড়াই এটিকেই ধরতে চেয়েছেন কুস্তোরিকা।
বলা বাহুল্য, তিনি পেরেছেনও। আর এটিতে কুস্তোরিকা শুধু পর্দার পেছনেই ছিলেন না। তিনি নিজেও এর অন্যতম চরিত্র ছিলেন। পর্দার সামনে তাঁর উপস্থিতি ছাড়া এই প্রামাণ্যচিত্র কখনোই পূর্ণতা পেত না। আর বন্ধুর সামনে ম্যারাডোনা যেন আরও অকপট। কুস্তোরিকার ভাষায় যিনি হয়তো সর্বকালের সেরা ফুটবলার নন, বরং মেক্সিকান বিপ্লব নিয়ে বানানো কোনো সিনেমার চরিত্র।
ম্যারাডোনার বাঁ পায়ে ছিল ফিদেল কাস্ত্রোর ট্যাটু এবং ডান হাতে চে গুয়েভারার ট্যাটু। নিজের বিপ্লবী সত্তাকে হয়তো শরীরে বয়ে নিতে চেয়েছেন তিনি। তবে একজন ফুটবলার ও বিপ্লবীর পাশাপাশি এই গল্প সেই মানুষটিরও যিনি একজন স্বামী, প্রেমিক এবং বাবাও। একই সঙ্গে কোটি মানুষের অনুপ্রেরণার নামও।
ফলে ম্যারাডোনাকে সারাক্ষণই নানা অনুষঙ্গ সামনে রেখে তাল মিলিয়ে চলতে হয়েছে। আর এসব কিছুর শুরুই হয়েছে বুয়েনস এইরেসের একটা ছোট ঘর থেকে। যে ঘর বাদ দিয়ে কখনো পূর্ণতা পেত না এই প্রামাণ্যচিত্রও।
সব মিলিয়ে কুস্তোরিকার ‘ম্যারাডোনা’ এমন একজন মানুষের গল্প, যিনি একের ভেতর লালন করেছেন হাজারো সত্তা। যে সত্তা কখনো দেবতার মর্যাদায় বসেছেন, কখনো হয়ে উঠেছেন বিপ্লবী আবার কখনো একজন জোচ্চোর ও মাদকসেবী। তবে সবকিছুর পর তিনি একজন মানুষ। মানুষের মধ্যে হয়তো একটু বেশি রক্তমাংসের মানুষ। কুস্তোরিকার প্রামাণ্যচিত্রও সেই মানুষটিকে নিয়ে।
ম্যারাডোনা (২০০৮)
পরিচালক: এমির কুস্তোরিকা
ধরন: প্রামাণ্যচিত্র
অভিনয়: ডিয়েগো ম্যারাডোনা, এমির কুস্তোরিকা, লুকাস ফুইকা ও অন্যান্য।
রানিং টাইম: ১ ঘণ্টা ৩০ মিনিট
আইএমডিবি রেটিং: ৬.৭/১০