এক ম্যাচে ৩১ গোল খেতে যেমন লাগে, জানালেন সেই গোলকিপার
‘আমি খেলা শেষ হওয়া পর্যন্ত আবেগ ধরে রাখার চেষ্টা করছিলাম।’
ভদ্র ভাষার মোড়কে নিকি সালাপুর অনুভূতিটা এমনই। দুই-চার কিংবা ছয়-সাত গোল হজমও কখনো কখনো গায়ে লাগে না। কিন্তু এক ম্যাচে ৩১ গোল হজম তো আর চাট্টিখানি কথা নয়! সবকিছু ধসে পড়ার মতো অনুভূতি হওয়ার কথা। নিকি সালাপু সে ব্যাপারটাই এভাবে বলেছেন ভদ্র ভাষায়। আসলে কেমন লেগেছিল, সেটাও অবশ্য গোপন রাখেননি। সালাপু সেদিন গোলপোস্টে দাঁড়িয়ে চোখের জল লুকিয়েছেন। সতীর্থরা যেন দেখতে না পান!
বার্সেলোনা গোলকিপার মার্ক-আন্দ্রে টের স্টেগেনের একটি উদ্ধৃতি এ ক্ষেত্রে মনে করা যায়, ‘লোকে জানে না, গোলকিপার হওয়া কত কঠিন।’ সালাপু সেদিন সেটিই টের পেয়েছিলেন হাড়ে হাড়ে। প্রতিপক্ষের শক্তির সামনে কুলিয়ে উঠতে না পেরে একের পর এক গোল হজম করেছেন। ধরণী দ্বিধা হও, আমি মুখ লুকাই—এমন অনুভূতি আর কি!
তারিখটা ১১ এপ্রিল ২০০১। সেদিন ২০০২ বিশ্বকাপ বাছাইয়ে ওশেনিয়া অঞ্চলের ম্যাচে অস্ট্রেলিয়ার মুখোমুখি হয়েছিল আমেরিকান সামোয়া। কফস হারবারে অনুষ্ঠিত ম্যাচে আমেরিকান সামোয়া হেরেছিল ৩১-০ গোলে। আন্তর্জাতিক ফুটবলে এটাই সবচেয়ে বড় ব্যবধানে হারের রেকর্ড এখনো। এতক্ষণে বুঝে যাওয়ার কথা, সেই ম্যাচে আমেরিকান সামোয়ার গোলকিপার ছিলেন সালাপু। লোকে এখনো নাকি তাঁকে ম্যাচটি নিয়ে জিজ্ঞেস করে। বিবিসির ‘স্পোর্টিং উইটনেস’ পডকাস্টে সেই ম্যাচ নিয়েই কথা বলেছেন সালাপু।
অস্ট্রেলিয়ার বিপক্ষে ম্যাচটির জন্য খুব দ্রুত দল গড়তে হয়েছিল আমেরিকান সামোয়াকে। বেশির ভাগই ছিলেন কিশোর বয়সী। আমেরিকান সামোয়ার ফুটবল ফেডারেশন (এফএফএএস) ফিফায় অর্ন্তভুক্তি পেয়েছিল ম্যাচটি খেলার মাত্র তিন বছর আগে। সে সময় ১ কোটি ৯০ লাখ অধিবাসীর অস্ট্রেলিয়ার বিপক্ষে মাত্র ৫৮ হাজার জনসংখ্যার আমেরিকান সামোয়া এমনিতেই পুঁচকে ছিল। আর ২০০২ বিশ্বকাপ বাছাইয়ের আগে ফিফা জানিয়ে দেয়, শুধু আমেরিকান পাসপোর্টধারীরাই প্রশান্ত মহাসাগরের দেশটির জাতীয় দলের প্রতিনিধিত্ব করতে পারবেন। প্রাথমিকভাবে ঘোষিত ২০ জনের স্কোয়াডে যোগ্য খেলোয়াড় বাছতে দল উজাড়, টিকেছিলেন শুধু সালাপু। তাঁর ভাষায়, ‘মাত্র দুই সপ্তাহের মধ্যে যে কাউকে খুঁজে বের করতে হতো। আমরা হাইস্কুলের ছেলেদের বাছাই করেছিলাম।’
সালাপুর এ কথার ব্যাখ্যা দেবে পরিসংখ্যান। আমেরিকান সামোয়ার দলে ১৫ বছর বয়সী খেলোয়াড় ছিলেন তিনজন। দলের খেলোয়াড়দের গড় বয়স ছিল ১৮ বছর। সালাপু সেই দলে সবচেয়ে অভিজ্ঞ; তাঁর বয়সই ছিল মাত্র ২০ বছর।
বিশ্বকাপ বাছাইয়ের মতো টুর্নামেন্টে এমন দল নিয়ে যা হওয়ার কথা, তা–ই হয়েছিল। প্রথম রাউন্ডে ফিজির কাছে আমেরিকান সামোয়ার হারের ব্যবধান ১৩-০। পরের ম্যাচে সামোয়ার কাছে হার ৮-০ গোলে। তৃতীয় ম্যাচে হারের ব্যবধান তো ছাড়িয়ে গেল সবকিছুকে—৩১-০! ওই ৩ ম্যাচে ৫২ গোল খাওয়ার পর টোঙ্গার কাছে ৫-০ গোলের হার আমেরিকান সামোয়ার কাছে জয়ের সমান হওয়ার কথা!
খুব কাছে গিয়েও ১৯৯৮ বিশ্বকাপের চূড়ান্ত পর্বে উঠতে ব্যর্থ হওয়া অস্ট্রেলিয়া ২০০২ বিশ্বকাপে জায়গা পেতে মুখিয়ে ছিল। নিজেদের প্রমাণে জিদ কাজ করছিল অস্ট্রেলীয়দের মনে। আমেরিকান সামোয়ার আগে অস্ট্রেলীয়দের সেই জিদের অনলে পুড়েছিল টোঙ্গাও। পলিনেশিয়ান দেশটিকে ২২-০ গোলে গুঁড়িয়ে আমেরিকান সামোয়ার মুখোমুখি হয়েছিল অস্ট্রেলিয়া। সালাপু জানিয়েছেন, তাঁর প্রাথমিক লক্ষ্য ছিল কোনোভাবেই ‘২২-০ ব্যবধানের হার অতিক্রম করা যাবে না’।
গোলবন্যার ‘ফটক’ খুলেছিল ম্যাচের ৮ মিনিটে। অস্ট্রেলিয়ার ২২ বছর বয়সী স্ট্রাইকার আর্চি থম্পসন একাই করেছিলেন ১৩ গোল। ৮ গোল করেন ডেভিড জিদ্রিলিক। সালাপু জানিয়েছেন, পুরো ম্যাচে তিনি সতীর্থদের ‘সামনে এগোতে’ বলেছেন। কারণ, তাঁর সতীর্থরা বেশির ভাগ সময়েই রক্ষণভাগে জড়সড় হয়েছিলেন। এ কারণে বল দেখতে খুব সমস্যা হচ্ছিল সালাপুর। ৮৬ মিনিটে অস্ট্রেলিয়ার পোস্টে একবারই আক্রমণ করতে পেরেছিল আমেরিকান সামোয়া। অস্ট্রেলিয়ার গোলকিপার মাইকেল পেটকোভিচের ম্যাচে সেটাই একমাত্র সেভ।
সালাপু মনে করেন, অস্ট্রেলিয়া যেভাবে খেলেছে, সেটি অখেলোয়াড়সুলভ। তাঁর প্রশ্ন, ‘(দুই দলের মধ্যে) পার্থক্য গড়তে আপনার কত গোল প্রয়োজন?’ সালাপু জানিয়েছেন, তিনি অস্ট্রেলিয়ার কোচ হলে দল ২০ গোল করার পর খেলোয়াড়দের ‘ম্যাচ শেষ হওয়ার আগপর্যন্ত বলের দখল ধরে রেখে খেলতে’ বলতেন।
হারের সেই স্মৃতি মনে সইয়ে নিতে সালাপুর প্রায় ১০ বছর লেগেছে। এ সময়ের ব্যবধানে আমেরিকান সামোয়া টানা ৩৮ ম্যাচ হেরেছে ২১৭ গোল ব্যবধানে। ফিফা র্যাঙ্কিংয়ে নেমেছে ২০৪তম স্থানেও (বর্তমানে ১৮৯)।
২০১০ সালে ডাচ বংশোদ্ভূত কোচ টমাস রনজেনকে কোচ করে আনে আমেরিকান সামোয়া। পরিস্থিতি এরপর ধীরে ধীরে পাল্টাতে থাকে। ২০১৪ বিশ্বকাপ বাছাইয়ের ম্যাচে ২০১১ সালের ২৩ নভেম্বর টোঙ্গার মুখোমুখি হয় আমেরিকান সামোয়া।
সালাপু জানিয়েছেন, সে ম্যাচে ‘আমাদের পুরো দল জয়ের ব্যাপারে আত্মবিশ্বাসী ছিল’। শেষ বাঁশি বাজার পর পূরণ হলো সেই প্রত্যাশাও। টোঙ্গাকে ২-১ গোলে হারায় আমেরিকান সামোয়া—ফিফা স্বীকৃত ম্যাচে সেটাই প্রথম জয় দলটির। সালাপুকে সেদিনও আবেগ সংবরণ করতে হয়েছিল। তাঁর ভাষায়, ‘খুবই ভালো লাগছিল। বারবার মনকে প্রবোধ দিয়েছি, ম্যাচে মনোযোগ ধরে রাখতে আবেগ সামলে রাখতে হবে।’
কিন্তু চাইলেই কি আর সব সময় আবেগের স্রোতে লাগাম পরানো যায়? সালাপুর ভাষায়, ‘২০০১ সালে অস্ট্রেলিয়ার কাছে সেই হারের পর ফুটবল ম্যাচে সেবারই প্রথম কেঁদেছি।’
রনজেনের অধীন আমেরিকান সামোয়ার সেই জয় চিত্রিত হয়েছে রুপালি পর্দায়ও। নিউজিল্যান্ডের পরিচালক তাইকা ওয়াইতিতির পরিচালনায় নির্মিত ‘নেক্সট গোল উইনস’ সিনেমা মুক্তি পেয়েছে গত বছর। আমেরিকান সামোয়ার সেই প্রথম জয়টি চিত্রিত হয়েছে এ সিনেমায়, যেখানে কোচের ভূমিকায় জার্মান অভিনেতা মাইকেল ফাসবেন্ডার।
ভালো কথা, সালাপু কিন্তু এখনো খেলছেন আমেরিকান সামোয়ার হয়ে। তাঁর ছেলে ডিলানও দেশটির অনূর্ধ্ব-১৭ দলের মিডফিল্ডার।