আর্জেন্টিনাকে নিয়ে বাংলাদেশের মানুষের উন্মাদনা নিজের চোখে দেখবেন বলে ঢাকায় আসতে চেয়েছিলেন। আসার পর কী দেখলেন এমিলিয়ানো মার্তিনেজ? সেই উন্মাদনার কিছুই না। যা দেখেছেন, তা হলো, সকালে হোটেলের সামনে কিছু সাংবাদিকের ভিড়।
তিনি দেখলেন, কিন্তু সাংবাদিকদের কেউ তাঁকে দেখতে পেলেন না। হোটেলের রুম থেকে সরাসরি আন্ডারগ্রাউন্ড পার্কিংয়ে নেমে গাড়িতে উঠেছেন। সেই গাড়িতে আবার কালো কাচ। পুলিশ ভ্যানের পেছনে ওই গাড়িতে বসে এমিলিয়ানো মার্তিনেজ হোটেল থেকে বেরিয়ে গেলেন ৯টা বাজার কিছুক্ষণ পর। ফটো সাংবাদিকরা ক্যামেরা নিয়ে দৌড়ালেন, টিভি ক্যামেরাম্যানরা ক্যামেরা নিয়ে...পুলিশের বাঁশি বাজছে, পেছনে দৌড়াচ্ছেন তাঁরা। ছবি বা ফুটেজ অবশ্য সেই অর্থে কেউই পেলেন না। কালো কাচের আড়াল থেকে এমিলিয়ানো মার্তিনেজকে যে ভালোমতো দেখাই গেল না।
হোটেল থেকে পরবর্তী গন্তব্য মিনিট পনের দূরত্বের বাড্ডার প্রগতি সরণিতে ডিজিটাল বিজনেস পোর্টাল নেক্সট ভেঞ্চারসের কার্যালয়। ওই প্রতিষ্ঠানের কর্তাব্যক্তিরা মার্তিনেজের অপেক্ষায় ছিলেন, ছিলেন কিছু আমন্ত্রিত অতিথিও। যাদের মধ্যে সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য নাম মাশরাফি বিন মুর্তজা। বাংলাদেশের সাবেক ক্রিকেট অধিনায়ক আর্জেন্টিনা ফুটবল দলের কড়া সমর্থক। মার্তিনেজের সঙ্গে দেখা করতে তাঁর আগ্রহ থাকাটাই স্বাভাবিক। ছেলে–মেয়ের আগ্রহ ছিল তার চেয়েও বেশি। বিশ্বকাপজয়ী গোলকিপারকে কাছ থেকে দেখার সেই ইচ্ছা তাদের পূরণ হয়েছে। যা নিয়ে নিজের ফেসবুক পেজে ইয়া বড় একটা স্ট্যাটাসও দিয়েছেন মাশরাফি।
ওয়েস্টিন হোটেলের সামনে সাংবাদিকদের ভিড়টা এমিলিয়ানো মার্তিনেজের পিছু পিছু প্রগতি সরণিতে নেক্সট ভেঞ্চারস কার্যালয়ের সামনে স্থানান্তরিত হয়েছে। অনেকে লাইভ করছেন, সেই লাইভে কী বলবেন, তা খুঁজে পেতে বেশির ভাগই গলদঘর্ম। মার্তিনেজ এই ভবনের ভেতরে আছেন—এর বাইরে আর তেমন কিছু বলার থাকলে তো! সুউচ্চ সেই ভবনের সামনে সারি বেঁধে পুলিশ দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে পথচারীদের কেউ কেউ থমকে দাঁড়াচ্ছেন। আগে থেকেই দাঁড়িয়ে থাকা কাউকে জিজ্ঞেস করছেন—এখানে কী হচ্ছে? আর্জেন্টিনার গোলকিপার, আর্জেন্টিনার গোলকিপার...এই উত্তরটা কীভাবে যেন মেসি–তে রূপান্তরিত হয়ে গেল। ফুটপাতে একটা রব উঠল, মেসি–মেসি।
আর্জেন্টিনা মানেই মেসি। তবে কাতারে বিশ্বকাপ ফুটবল নিয়ে আর্জেন্টিনার ৩৬ বছরের হাহাকার ঘুচিয়ে দেওয়ায় এমিলিয়ানো মার্তিনেজের অবদানও কম নয়। ফাইনাল টাইব্রেকারে যাওয়ার আগে অতিরিক্ত সময়ের অন্তিম মুহূর্তে মার্তিনেজ ওই সেভটা না করলে তো আর আর্জেন্টিনার বিশ্বকাপ জেতা হয় না। এর আগে নেদারল্যান্ডসের বিপক্ষে কোয়ার্টার ফাইনালের টাইব্রেকারের কথা মনে আছে তো! মার্তিনেজের দুই–দুইটি সেভেই স্বপ্নপূরণের পথে আর্জেন্টিনার আরেকটি ধাপ পেরোনো। বিশ্বকাপ শেষ হয়ে যাওয়ার পরও মেসির চেয়ে বেশি না হলেও সমান আলোচনায় থেকেছেন মার্তিনেজ। সেরা গোলকিপারের পুরস্কার গোল্ডেন গ্লাভ ট্রফি হাতে বিতর্কিত সেই উদযাপনের দৃশ্যটা আপনার এত তাড়াতাড়ি ভুলে যাওয়ার কথা নয়। এ নিয়ে কত কথা!
বিশ্বকাপ এমিলিয়ানো মার্তিনেজকে রীতিমতো রকস্টার বানিয়ে না দিলে শতদ্রু দত্ত হয়তো তাঁকে কলকাতায় আনার পরিকল্পনাই করতেন না। বড় বড় নাম নিয়ে কাজকারবার কলকাতার এই ক্রীড়া উদ্যোক্তার। এর আগে পেলে ও ম্যারাডোনার মতো মহাতারকাকে কলকাতায় এনেছেন। গতকাল রাতে হোটেল লবিতে আড্ডায় কথায় কথায় বলছিলেন, তাঁর নোটবুকে আর তিনটি নাম টোকা আছে। মেসি, রোনালদো আর স্টেফি গ্রাফ। এই তিনজনকে কলকাতায় আনতে পারলেই তৃপ্তি নিয়ে অবসর নিয়ে চলে যাবেন। পেলে–ম্যারাডোনাকে যিনি আনতে পারেন, মেসি–রোনালদো–স্টেফিকে আনা তাঁর জন্য কোনো ব্যাপার হওয়ার কথা নয়। ব্যাপার হলেই বা কী, এটা শতদ্রু দত্তের সমস্যা, তা নিয়ে তিনি ভাবতে থাকুন। আমরা বরং এমিলিয়ানো মার্তিনেজের বিচিত্র বাংলাদেশ সফরে ফিরে যাই।
শতদ্রু দত্তের কাছেই শোনা, কলকাতায় আসা চূড়ান্ত হওয়ার পর এমিলিয়ানো মার্তিনেজই বাংলাদেশ হয়ে যাওয়ার ব্যাপারে আগ্রহ প্রকাশ করেন। কারণটা বহুল বিজ্ঞাপিত। বিশ্বকাপের সময় বাংলাদেশ থেকে আর্জেন্টিনার প্রতি প্রবল সমর্থনের খবর আর্জেন্টিনা দলে পৌঁছে যাওয়া। বিশ্বকাপে না থেকেও বাংলাদেশ বিশ্বকাপে ছিল এ কারণেই। কোচ লিওনেল স্কালোনি যেদিন সংবাদ সম্মেলনে আনুষ্ঠানিকভাবে বাংলাদেশকে ধন্যবাদ জানালেন, একাধিক বিদেশি সাংবাদিককে বাংলাদেশের এই আর্জেন্টিনাপ্রীতির ইতিহাস ও কারণ বুঝিয়ে বলতে হয়েছিল। বিশ্বকাপের জয়ের পরও তো বাংলাদেশকে নিয়ে আর্জেন্টিনায় কম কিছু হয়নি। শুধু ফুটবল সমর্থনের সূত্র ধরে আরেকটা দেশে দূতাবাস খুলে ফেলেছে কোনো দেশ—এমন কিছু তো ইতিহাসে হয়নি কখনো। এসব দেখে–শুনেই এমিলিয়ানো মার্তিনেজের বাংলাদেশ নিয়ে আগ্রহ। প্রবল কৌতূহলও। কিন্তু সেই কৌতূহলের কিছুই কি মিটল? সাধারণ আর্জেন্টিনা সমর্থকদের সঙ্গে তো তাঁর দেখাই হলো না।
আজ সকালে ওয়েস্টিন হোটেলের কফি শপে এক তরুণের দেখা পেলাম। পরনে মেসির জার্সিই বলে দিচ্ছিল তাঁর পরিচয়। এমিলিয়ানো মার্তিনেজ হোটেল থেকে বেরিয়ে যাওয়ার পরও ওই তরুণ ওখানেই বসে। মার্তিনেজের দেখা পেলে তাঁর সঙ্গে ছবি তুলবেন বলে সাতসকালে হোটেলে এসেছেন। মার্তিনেজ যে হোটেল থেকে বেরিয়ে গেছেন, এটা তখনো জানেনই না। যখন জানলেন, মুখটা এমন করুণ দেখাল, যেন এই মাত্র কোনো নিকটাত্মীয়ের মৃত্যুসংবাদ পেয়েছেন।
এমন হাজারো ভক্ত মার্তিনেজকে এক নজর দেখার জন্য গুচ্ছের টাকা খরচ করতে রাজি ছিলেন। কিন্তু সেই সুযোগই তো তারা পেলেন না। মার্তিনেজই বা কী পেলেন! হয়তো কিছু টাকা, যেটির পরিমাণও খুব বেশি নয়। যে বাংলাদেশকে দেখতে ঢাকা আসতে চেয়েছিলেন, সেই বাংলাদেশকে তো দেখতেই পেলেন না।
ঢাকায় নেমেছেন কাকভোরে। তারপরও কিছু সাংবাদিক সেখানে অপেক্ষায় ছিলেন। কিন্তু মার্তিনেজের গাড়িটাই শুধু দেখতে পেয়েছেন তাঁরা। কালো কাচের আড়াল থাকায় মার্তিনেজকেও না। মার্তিনেজ প্রায় শূন্য রাস্তা দেখতে দেখতেই হোটেলে এসেছেন।
মার্তিনেজের এই সফরও এমন একটা শূন্যতার অনুভূতি ছাড়া আর কিই–বা দিতে পারল! ভোরে নেমে হোটেলে কিছুক্ষণ ঘুমিয়ে এমন একটা অফিসে গেলেন, যেটির নাম বাংলাদেশের বেশির ভাগ মানুষ আগে শোনেইনি। সেখান থেকে প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে দেখা করে সোজা বিমানবন্দর। নির্বাচিত কিছু মানুষ ছাড়া ঢাকায় এমিলিয়ানো মার্তিনেজের এই সফরের কোনো স্মৃতিই তাই থাকবে না। আমারই যেমন মার্তিনেজের ১১ ঘন্টার এই ঝটিকা সফরের কথা উঠলে মনে পড়বে শুধু একটা দৃশ্যই—কালো কাচের আড়ালে ঢাকা একটা চলমান গাড়ি।