চূড়ায় মেসি, ম্যারাডোনার সঙ্গে কেম্পেস–ভালদানোরাও ইতিহাস, হিগুয়েইনের ঠাঁই কোথায়?
তিনটি মুহূর্ত, তিনটি ছবি—নতমস্তক লিওনেল মেসি। ৫ ফুট ৭ ইঞ্চি উচ্চতার বড্ড ক্লান্ত আর শ্রান্ত শরীরটা কোনোমতে টেনে নিয়ে যাচ্ছেন ড্রেসিংরুমে। প্রথম মুহূর্তটা ২০১৪ বিশ্বকাপের ফাইনালে জার্মানির কাছে হেরে যাওয়ার পর। পরের দুটি ছবি ২০১৫ ও ২০১৬ সালের কোপা আমেরিকার ফাইনালের। দুটি ফাইনালেই চিলির কাছে হেরেছে আর্জেন্টিনা।
মুহূর্ত তিনটি হলেও ছবি একটাই—মেসির হতাশাক্লিষ্ট মুখ, যেন সব হারানো এক বীর যোদ্ধার যুদ্ধের ময়দান থেকে প্রস্থানের দৃশ্য! আর্জেন্টিনার জার্সিতে মেসির এমন ছবি দেখতে পাওয়ার দায় অনেকেই গঞ্জালো হিগুয়েইনকে দেন। ২০১৪ বিশ্বকাপের পর ২০১৫ ও ২০১৬ সালের কোপা আমেরিকার ফাইনালেও সহজ সুযোগ পেয়েও গোল করতে ব্যর্থ হয়েছেন হিগুয়েইন।
আর্জেন্টিনার সমর্থক আর মেসির ভক্তদের কথা একটাই—গোলকিপারকে একা পেয়ে অথবা ফাঁকায় বল পেয়ে হিগুয়েইন যদি বাইরে না মারতেন, তাহলে মেসির অমন অন্ধকার মুখ দেখতে হতো না! চায়ের আড্ডায়, অফিস অঞ্চলের জটলায় বা সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের পাতায় পাতায় হিগুয়েইনকে এ নিয়ে কত অপবাদই না দেওয়া হয়েছে, এখনো দেওয়া হয়।
হিগুয়েইন জাতীয় দলকে বিদায় বলে দিয়েছেন। ইউরোপের তীব্র প্রতিদ্বন্দ্বিতাময় ফুটবল থেকেও তিনি এখন অনেক দূরে। খেলছেন যুক্তরাষ্ট্রের মেজর লিগ সকারে। কিন্তু সুদূর মার্কিন মুলুকে গিয়েও কি মুক্তি আছে! সেখানেও আর্জেন্টিনা দলে ব্যর্থতা নিয়ে তাঁকে প্রশ্ন শুনতে হয়।
এমন একটির প্রশ্নের উত্তরে গত পরশু হিগুয়েইন বলেছেন, আর্জেন্টিনার জন্য তিনি জীবন দিয়ে দিয়েছেন। কখনো কখনো আরও বেশি কিছু করেছেন। হিগুয়েইন এই ‘জীবন দেওয়া’ বলতে দলের জন্য অবদান রাখাকেই বুঝিয়েছেন। তা হিগুয়েইনের এই ‘জীবনদান’কে যদি গোলের আয়নায় দেখা হয়, তাহলে তিনি কতটা সফল? এ প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে আর্জেন্টিনার সর্বোচ্চ গোলদাতার তালিকা আর কখন কবে কে গুরুত্বপূর্ণ গোল করেছেন, সময়ের ডানায় চড়ে সেগুলোও একটু দেখে আসা যাক।
বাংলাদেশ সময় আজ ভোরে হন্ডুরাসের বিপক্ষে আর্জেন্টিনার ৩-০ ব্যবধানের জয়ে জোড়া গোল করেছেন লিওনেল মেসি। গ্যাব্রিয়েল বাতিস্তুতাকে পেছনে ফেলে অনেক দিন আগেই আর্জেন্টিনার সর্বোচ্চ গোলদাতা এই দুই গোলে আরও ওপরে নিয়ে গেছেন নিজেকে। আর্জেন্টিনার জার্সিতে তাঁর গোলসংখ্যা এখন ৮৮। ক্রিস্টিয়ানো রোনালদো ১১৭ গোল নিয়ে আন্তর্জাতিক ফুটবলে সর্বোচ্চ গোলের মালিক।
আর্জেন্টিনার দ্বিতীয় সর্বোচ্চ গোলদাতা বাতিস্তুতার গোল ৫৫টি। এরপর আছেন সের্হিও আগুয়েরো (৪১) ও হার্নান ক্রেসপো (৩৫)। তালিকার পঞ্চম স্থানে থাকা হিগুয়েইনের গোল ৩১টি। এদিক থেকে তিনি ডিয়েগো ম্যারাডোনার ওপরে! ২৯ গোল নিয়ে ম্যারাডোনা আছেন তালিকার ষষ্ঠ স্থানে।
ম্যারাডোনার গোলের কথা চলে এলে আসবে আরেকটি বিষয়—দলের হয়ে ঠিক সময়ে গুরুত্বপূর্ণ গোল কে কয়টা করতে পেরেছেন। ১৯৮৬ বিশ্বকাপজয়ী আর্জেন্টিনা দলের অধিনায়ক ছিলেন ম্যারাডোনা। ইংল্যান্ডের বিপক্ষে সেই বিশ্বকাপের কোয়ার্টার ফাইনালে আর্জেন্টিনার ২-১ ব্যবধানের জয়ে দুটি গোলই তাঁর। সেই দুই গোলের প্রথমটি বিখ্যাত ‘হ্যান্ড অব গড’ গোল হিসেবে পরিচিত। আর দ্বিতীয়টিকে অনেকে বলেন ‘গোল অব দ্য সেঞ্চুরি’।
১৯৮৬ বিশ্বকাপের সেমিফাইনালে বেলজিয়ামের বিপক্ষেও জোড়া গোল করেছেন ম্যারাডোনা, আর্জেন্টিনা জিতেছে ২-০ গোলে। ফাইনালে ম্যারাডোনা গোল করতে পারেননি। পশ্চিম জার্মানির বিপক্ষে ৩-২ ব্যবধানের জয়ে যে তিনজন গোল করেছেন, গোলদাতা হিসেবে তাঁদের খুব একটা মনে রাখার কথা নয় আর্জেন্টিনার। প্রথম গোলটি হোসে লুইস ব্রাউনের, পরের দুটি হোর্হে ভালদানো ও হোর্হে বুরুচাগার।
এই তিনজনের কেউই আর্জেন্টিনার সর্বোচ্চ গোলদাতার তালিকার সেরা দশে নেই। আর্জেন্টিনার হয়ে ৩৬ ম্যাচ খেলে সেন্টার-ব্যাক ব্রাউনের ওই একটিই গোল। ভালদানো ও বুরুচাগা ফরোয়ার্ড ছিলেন। কিন্তু আর্জেন্টিনার হয়ে ভালদানোর গোল ২৩ ম্যাচে মাত্র ৭টি, আর বুরুচাগার ৫৭ ম্যাচে ১৩। এত কম গোল করেও তাঁরা আর্জেন্টিনার ফুটবল ইতিহাসে স্মরণীয় হয়ে আছেন বিশ্বকাপ ফাইনালে গোল করেছেন বলে।
মারিও কেম্পেসের গল্পটাও একই রকম। ছিয়াশির আগে আর্জেন্টিনা বিশ্বকাপ জিতেছে ১৯৭৮ সালে। আর্জেন্টিনার হয়ে কেম্পেসের ৪৩ ম্যাচে ২০ গোলের ৬টিই সেই বিশ্বকাপে, যার দুটি আবার ফাইনালে, নেদারল্যান্ডসের বিপক্ষে অতিরিক্ত সময়ে গড়ানো ম্যাচে ৩-১ গোলের জয়ে।
আর্জেন্টিনার সর্বোচ্চ গোলদাতা আর গুরুত্বপূর্ণ মুহূর্তে গোল করা খেলোয়াড়দের গল্প তো সংক্ষেপে জানা হলো। এবার বলুন দেখি, চূড়ায় থাকা মেসি আর গুরুত্বপূর্ণ সময়ে গোল করা ম্যারাডোনা-ভালদানো-কেম্পেসদের বিচারে হিগুয়েইনের ‘জীবনদান’ কোথায় ঠাঁই পাবে!