সব রহস্য লুকিয়ে রোনালদোর শরীরে

সম্প্রতি ৪০তম জন্মদিন পালন করেছেন ক্রিস্টিয়ানো রোনালদোইনস্টাগ্রাম

তিনতলা কেক। পুরোটাই আল নাসরের জার্সির রঙে বানানো। দ্বিতীয় তলায় ক্রিস্টিয়ানো রোনালদোর ক্যারিয়ারের টুকরা ছবি। তৃতীয় তলায়ও তাই। স্পোর্টিং লিসবনের সেই কিশোর রোনালদো, ম্যানচেস্টার ইউনাইটেডের তরুণ, রিয়াল মাদ্রিদ ও জুভেন্টাসের পরিণত এবং আল নাসরের ‘বুড়ো’ রোনালদো। বুড়ো? সেটা শুধু বয়সের ভার বিচারে বলা। রোনালদো কি সেই ভার টের পান?

মনে হয় না। তার ইঙ্গিতও দেওয়া হয়েছে তিনতলা কেকটির ছাদের ওপরে। রোনালদোর বাইসাইকেল কিকের ছোট্ট এক ভাস্কর্য বানানো হয়েছে নিপুণ দক্ষতায়। পরনে আল নাসরের জার্সি। রোনালদো সৌদি ক্লাবের জার্সিতে বাইসাইকেল কিকে গোল করেননি এখনো। আল নাসর সম্ভবত সেই আশায় আছে, আর তাই পরশু রোনালদোর জন্মদিনের কেকে ওই ভাস্কর্য। চল্লিশ পূর্ণ করা রোনালদোর কাছ থেকে এখনো ওভাবে গোল দেখার আশা করা হয়। ভাবুন একবার!

৫০ বছর বয়সীও বাইসাইকেল কিকে গোল করতে পারেন। কিন্তু সেটা বড়জোর অপেশাদার ম্যাচে। রোনালদোর ব্যাপারটা আলাদা। তাঁর সমসাময়িক বেশির ভাগই আরও আগে বুট তুলে রেখে নেমে পড়েছেন হয়তো কোচিংয়ে। কিংবা জীবনটা থিতু করেছেন অন্য কোনো কাজে। রোনালদো সেখানে একটি দেশের শীর্ষ লিগে শুধু খেলছেনই না, রীতিমতো দাপিয়ে বেড়াচ্ছেন। সৌদি প্রো লিগে এ মৌসুমে সর্বোচ্চ গোলদাতা। মৌসুমে ২৫ ম্যাচে ২৩ গোল হয়ে গেছে। এই যদি হয় চল্লিশ পেরোনো কারও পারফরম্যান্স, দল তাহলে আশা করবে না কেন!

সেই আশায় পুঁজি একটাই—রোনালদোর শরীর। অন্য ভাষায়, তাঁর অবিশ্বাস্য ফিটনেস। কথায় আছে, ‘শরীরের নাম মহাশয়, যা সওয়াবেন তাই সয়।’ রোনালদো যা সইয়ে সইয়ে শরীরকে যেভাবে তৈরি করেছেন, সেটার সঙ্গে মিকেলাঞ্জেলোর ‘ডেভিড’–এর তুলনা চলে। হাতুড়ি-গাইতি কুঁদে দিনের পর দিন নিপুণ মনোবেশে বানানো ডেভিডের ভাস্কর্যটি যেমন চিরায়ত, ফুটবলে রোনালদোর ফিটনেসও যেন তাই—ভবিষ্যতের খেলোয়াড়দের জন্য উদাহরণ, যাঁরা চল্লিশ পেরিয়েও চুটিয়ে খেলতে চান। সে জন্য কী করতে হবে? তেমন কিছুই না, রোনালদোর মতো প্যাশন থাকলেই চলবে।

আরও পড়ুন

যেমন ধরুন, চল্লিশ পূর্ণ করার আগের রাতেও রোনালদো ইনস্টাগ্রামে শরীর ঠিক করার একটি ছবি পোস্ট করেছেন। মাসল রিকভারি করতে চার হাজার পাউন্ড দামের ক্রায়ো কমপ্রেশন বুট পরে শুয়ে থাকার ছবি। পর্তুগিজ কিংবদন্তির বাসাতেই ক্রায়ো কমপ্রেশনের জন্য আলাদা কক্ষ আছে। যাকগে সে কথা, সবার তো আর রোনালদোর মতো বিত্ত নেই। কিন্তু কথাটা উল্টোও হতে পারে। ফিটনেসে পরিপূর্ণ ওই রকম শরীর বানিয়ে তা ধরে রেখে প্রতিনিয়ত পারফরম্যান্স নিংড়ে বের করতে পেরেছেন বলেই তো ঘরে কাঁড়ি কাঁড়ি টাকা আসছে। ঠিক এ জায়গায় একটি প্রশ্নও জাগে।

রোনালদো আসলে করছেন কী? ধরুন, এখন এই মুহূর্তেও যদি রোনালদো পেশাদার ফুটবল ছাড়েন, তবু তো সর্বকালের সেরাদের কাতারেই থাকবেন। তবু কেন খেলে যাওয়া—অনেকটাই শচীন টেন্ডুলকারের মতো, ২০১১ বিশ্বকাপ জয়ের পরও যেভাবে আরও দুটি বছর খেলেছেন। পার্থক্যটা সম্ভবত মানসিকতায়। টেন্ডুলকার তারপর আর চালিয়ে যেতে চাননি কিংবা পারেননি। রোনালদো ঠিক বয়সের ওই ভার বহনের জায়গা থেকেই অসম্ভবকে সম্ভব করতে চান। তাঁর সতীর্থদের ভাষায়, রোনালদো একটি কথা প্রায়ই বলেন, ‘অসম্ভব বলে কিছু নেই।’ তা, কোন সে অসম্ভব?

জন্মদিনে বিশেষ কেক কাটেন রোনালদো
ইনস্টাগ্রাম

২০২৬ বিশ্বকাপ? সেখানে যে থাকতে চান, তা তো এখনই মোটামুটি পরিষ্কার। লিওনেল মেসির বিষয়ও মাথায় রাখতে হবে। চিরপ্রতিদ্বন্দ্বী আগামী বছরের বিশ্বকাপে খেলার সিদ্ধান্ত নিলে রোনালদো বসে থাকবেন কেন? কিছুদিন আগেই এক সাক্ষাৎকারে বলেছেন, ‘আমি এতটাই প্রতিদ্বন্দ্বিতাপূর্ণ মানসিকতার যে মাঝেমধ্যে নিজের অর্জন ভুলে যাই।’

তাহলে অসম্ভব বিষয়টি কি ২০৩০ বিশ্বকাপে খেলা, যে আসরের আয়োজক তাঁর জন্মভূমি? বুট তুলে রাখবেন কি তারপর? রোনালদোর একসময়ের সতীর্থ ন্যানির সন্দেহ কিন্তু তেমনই। কিন্তু ৪৫ বছর বয়সে বিশ্বকাপে খেলা কীভাবে সম্ভব? তা–ও পর্তুগালের মতো জাতীয় দলে? ন্যানির ভাষায়, ‘(সে যে পারবে) তা নিয়ে কোনো সন্দেহ নেই। আরেকবার হয়তো নিজের খাদ্যাভ্যাস ঠিক করে সুন্দর ছিপছিপে দেহ নিয়ে নেমে পড়বে।’

‘ফিটনেস-ফ্রিক’ বলে যে শব্দটি আমরা শুনি, রোনালদো তাঁর একদম যথার্থ উদাহরণ। সে জন্য বিসর্জনও কম নয়।

‘ফিটনেস-ফ্রিক’ বলে যে শব্দটি আমরা শুনি, রোনালদো তাঁর একদম যথার্থ উদাহরণ। সে জন্য বিসর্জনও কম নয়। ক্যানাল ১১-কে কিংবদন্তি নিজে বলেছেন, “‘আমার অনেক বন্ধু বলে, “তোমার জীবন বলে কিছু নেই।” কথাটা সত্য। তবে এটা আমার পছন্দ। জানি না, আগামী দুই-তিন বছরের মধ্যে হয়তো এসব শেষ হবে। ঠিক বলতে পারছি না।’ তিন বছর? অর্থাৎ ২০২৬ বিশ্বকাপে খেলার ইচ্ছা পরিষ্কার। তাহলে তিনের পর আরও দুই বছর বাড়ালে তো ঘরের মাঠেই বিশ্বকাপ খেলে অবসর নেওয়া সম্ভব!
রোনালদোর পক্ষে কি তা সম্ভব? শরীর ঠিক রাখতে এই বয়সেও তাঁর প্রতিদিনের রুটিন শুনলে অবশ্য বলতে পারেন, অসম্ভবকে সম্ভব করাই রোনালদোর কাজ!

জন্মদিনে পরিবারের সঙ্গে রোনালদো
ইনস্টাগ্রাম

পৃথিবীর সব কর্মবীরেরই সপ্তাহে অন্তত এক দিন ছুটি লাগে। এই ছুটিটি সপ্তাহের বাকি ছয় দিনের ঘাম ঝরানোর জ্বালানি আসলে। কিন্তু মৌসুম চলুক কিংবা না চলুক, রোনালদোর শরীরচর্চায় সাপ্তাহিক ছুটি বলে কিছু নেই। সপ্তাহে পাঁচ দিন জিমে চার ঘণ্টা করে সময় কাটান। ফিটনেস–চর্চায় ‘হাই-ইনটেনসিটি ইন্টারভ্যাল ট্রেনিং’ (এইচআইআইটি) বলে একটা কথা আছে। মানে একটু বিরতি দিয়ে তীব্রভাবে অনুশীলন—রোনালদো ঠিক এই কাজটাই করে যাচ্ছেন বছরের পর বছর। স্প্রিন্টিং ও সাইক্লিং করেন প্রতিদিনই। স্প্রিন্টিং ও জগিংয়ে তাঁর সঙ্গী প্রেমিকা জর্জিনা রদ্রিগেজ। কখনো কখনো বড় ছেলেকেও পান পাশে।

ফিটনেস নিয়ে সব সময় সচেতন রোনালদো
ইনস্টাগ্রাম

চিনিযুক্ত খাবার, কার্বোনেট পানীয় ও অ্যালকোহল ছুঁয়েও দেখেন না রোনালদো। মাছ, মুরগি ও তাজা শাকসবজি তাঁর খাবার। পছন্দের পানীয়র মধ্যে ব্ল্যাক কফি ও ইলেকট্রোলাইট ড্রিংকস। আর ঘুম? এমনিতে একটি সাধারণ ধারণা হলো, সুস্থ শরীরের জন্য আট ঘণ্টা ঘুম আবশ্যক। রোনালদো এই কাজটাই করেন একটু অন্যভাবে। শরীরের স্বাভাবিক ছন্দ ঠিক রাখতে ৯০ মিনিট করে ঘুমোন পাঁচবার। তবু রোনালদো ঠিক সন্তুষ্ট হতে পারেন না। কেন? তাঁর সাবেক এজেন্ট হোর্হে মেন্দেজের ভাষায়, নিজেকে নিয়ে সব সময় অতৃপ্তিতে ভোগাটা রোনালদোর স্বভাব। তাঁকে জন্মদিনের শুভেচ্ছা জানাতে গিয়ে বলেছেন সে কথাই, ‘...এমন কোনো সীমানা নেই, যেখানে সে পৌঁছাতে পারে না। দুই যুগের বেশি সময় ধরে এমন হয়েছে ও সেটা এখনো চলমান। সে কখনো সন্তুষ্ট হয় না। বিশেও ছিল না, ত্রিশেও না এবং এখন চল্লিশেও না।’

আত্মতৃপ্তিকে দূরে সরিয়ে ফিটনেসের বিষয়ে রোনালদো সব সময় হালনাগাদ তথ্য মাথায় রাখেন। মানে, শরীরচর্চা নিয়ে নতুন কী প্রযুক্তি এল, সেটা কেমন, কতখানি কাজে লাগবে, এসব বিষয়ে জানাশোনা রাখা আরকি। এ জন্য পর্তুগাল জাতীয় দলের চিকিৎসক জোসে কার্লোস নরোনিয়াকে কম ঝামেলা পোহাতে হয় না। রোনালদো কিছুদিন পরপরই তাঁকে খুদেবার্তা পাঠান, ‘ডাক্তার সাহেব, বিজ্ঞানসম্মত এমন কোনো নিবন্ধ আছে, যেটা তুমি পড়ার জন্য আমায় বলতে পারো?’

আরও পড়ুন

মাঠে লম্বা সময় নিজেকে ধরে রাখতে রোনালদোর পড়াশোনার ব্যাপারটা পুরোনো। নরোনিয়াও তাঁর পুরোনো মানুষ। রোনালদোর ম্যানচেস্টার ইউনাইটেডে প্রথম মেয়াদ (২০০৩-২০০৯) দিনগুলো থেকে তাঁদের সখ্য। নরোনিয়ার ভাষায়, ‘পুষ্টি এবং অন্যান্য বিষয় নিয়ে বিজ্ঞানসম্মত নতুন কোনো নিবন্ধের বিষয়ে সে জানতে চায়। শারীরিক ও মানসিক ফিটনেসের চূড়ায় থাকতে সে যা যা করা দরকার, সবই করে। সে এটার উৎকৃষ্ট উদাহরণ।’

২০০৩ সালে প্রীতি ম্যাচে পর্তুগালের হয়ে অভিষেকের সময় রোনালদোর সতীর্থ ছিলেন কস্তিনিয়া। সে সময় রোনালদো তাঁকে একটি কথা বলেছিলেন, যেটা কস্তিনিয়া ভোলেননি, ‘কস্তা, আমি ৩০ বছর পর্যন্ত খেলব, এরপর ভিন্ন কিছু করব।’
না, রোনালদো কথা রাখতে পারেননি। শুধু এটা নয়, দুর্দান্তভাবেই পারেননি। ২০ থেকে ৩০ বছর বয়সের মধ্যে করেছেন ৪৪০ গোল। আর ৩০ থেকে ৪০–এর মধ্যে করেছেন ৪৬০ গোল! এটাকে কি আপনার স্বাভাবিক মনে হয়? রোনালদোর বিষয়ে অবশ্য অস্বাভাবিক ব্যাপারগুলোই তো স্বাভাবিক।

যেমন ধরুন, আরও কয়েক বছর খেলা চালিয়ে যাওয়ার বিষয়ে চারটি বিষয় তাঁর মধ্যে তাড়নার ঢেউ তুলতে পারে। এক. ২০২৬ বিশ্বকাপ। দুই. ১ হাজার গোল, এখন ৯২৩। তিন. পর্তুগালের হয়ে ২৫০ ম্যাচ, এখন ২১৭। চার. ছেলে ক্রিস্টিয়ানো জুনিয়রের সঙ্গে একই দলে খেলা, ১৪ বছর বয়সী জুনিয়র এখন আল নাসরের বয়সভিত্তিক দলে।
এ তো গেল রোনালদোর মাঠের বিষয়-আশয়। মাঠের বাইরে তাঁর সাম্রাজ্য কিন্তু মাঠের ভেতরকার পারফরম্যান্সের মতোই। সেটা ব্যবসা-বাণিজ্যের সাম্রাজ্য। টিভি চ্যানেল, হোটেল, চুল ট্রান্সপ্লান্ট ক্লিনিক থেকে অন্তর্বাস—এসব ক্ষেত্রে ব্যবসায় হাত দিয়েছেন।

পর্তুগালের সাপ্তাহিক সংবাদমাধ্যম এক্সপ্রেসোর তথ্যানুযায়ী, নিজের সিআরসেভেন এসএ প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে গত দুই বছরে মালিকানাধীন প্রতিষ্ঠানের সংখ্যা দ্বিগুণ করেছেন রোনালদো। সংবাদমাধ্যমের হিসাবমতে, ২১টি ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানে শেয়ার আছে রোনালদোর। আর দুই বছরে মালিকানাধীন প্রতিষ্ঠানের সংখ্যা দ্বিগুণ হওয়ার একটি ব্যাখ্যাও দাঁড় করানো যায়। অবসর নিতে হবে, তা জানেন। যাওয়ার আগে মাঠ ও মাঠের বাইরে ফুটবল থেকে যতটা সম্ভব নিয়ে নেওয়া, যেটা তাঁর মতো আর কে পারেন!

রোনালদো বিশ্বের সবচেয়ে জনপ্রিয় অ্যাথলেটদের একজন। এই ভুবনের সবচেয়ে ধনীদেরও অন্যতম। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে অনুসারী সংখ্যায় অন্তত খেলার ভুবনে তাঁর ওপরে কেউ নেই।

বিশ্বের সবচেয়ে জনপ্রিয় অ্যাথলেটদের একজন। এই ভুবনের সবচেয়ে ধনীদেরও অন্যতম। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে অনুসারী সংখ্যায় অন্তত খেলার ভুবনে তাঁর ওপরে কেউ নেই। পর্তুগালের আগামী প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে এক প্রার্থী কিছুদিন আগে আওয়াজ তুলেছেন, রোনালদোকে তিনি নিজের কাউন্সিলে দেখতে চান। সব মিলিয়ে রোনালদো মাঠে যেমন, মাঠের বাইরেও ঠিক তাই। তারকা!

পেলে, ডিয়েগো ম্যারাডোনা, লিওনেল মেসির মধ্যে থেকে সর্বকালের সেরা হিসেবে আপনি যে কাউকে বেছে নিতেই পারেন। পার্থক্য শুধু বিশ্বকাপ জয় তো? ঠিক আছে। সেটা কিন্তু শুধুই ফুটবল মাঠে পাওয়া সাফল্য বিচারে। যদি প্রশ্ন ওঠে, ফুটবলে মাঠ ও মাঠের বাইরের ভুবন মিলিয়ে সবচেয়ে বেশি সাফল্য তুলে নিয়েছেন কে? কে, বয়সকে বুড়ো আঙুল দেখিয়ে পুরোনো ওয়াইনের মতো দিন দিন আরও সতেজ হচ্ছেন, যেটা ফুটবলারদের মধ্যে প্রায় দেখাই যায় না?

এসব প্রশ্নের উত্তরে কিন্তু আপনাকে রোনালদোর কাছেই ফিরতে হবে।