‘কী, রাত কেমন কাটল?’
চাইলে আপনার ফুটবলপ্রেমী বন্ধুকে আজ সকালে প্রশ্নটি করতে পারতেন। ফুটবলের এমন পাগলাটে রাত যে আপনার বন্ধুর জীবনে কখনোই আসেনি।
কীভাবে নিশ্চয়তা দিচ্ছি? চ্যাম্পিয়নস লিগের ইতিহাসে এক রাতে ১৮ ম্যাচ আগে কখনোই দেখা যায়নি। যেখানে পছন্দের দলের এক ম্যাচ মনোযোগ দিয়ে দেখতেই হিমশিম খেতে হয়, সেখানে ১৮ ম্যাচ! সকালে আপনার বন্ধুর চুল উষ্কুখুষ্ক থাকলে, চোখ দুটি ডিমের কুসুমের মতো হয়ে উঠলে অবশ্য এ প্রশ্ন না করলেও চলে। চাপটা কেমন গেছে, সে তো চেহারাতেই পরিষ্কার!
কিংবা আপনিই হয়তো সেই ব্যক্তি, যিনি পছন্দের দলের খেলা দেখতে কাল রাতে বসেছিলেন টিভির সামনে অথবা তাকিয়ে ছিলেন মুঠোফোনের স্ক্রিনে। ঝামেলা হলো, খেলাটা তো চ্যাম্পিয়নস লিগের প্রথম পর্ব। পরের ধাপে ওঠার নানা রকম সমীকরণ থাকে। তাই শুধু নিজের দলের ম্যাচ দেখলেই হয় না। পাশাপাশি চোখ রাখতে হয় অন্য দলগুলোর স্কোরেও। বিরাট সমস্যা হলো, চোখ তো মাত্র দুটো। চ্যাম্পিয়নস লিগের এই নতুন কাঠামোর আগে গ্রুপ পর্বে প্রতি রাতে আটটি করে ম্যাচ হতো। তখনই প্রিয় দলের খেলা দেখার পাশাপাশি অন্য স্কোরে চোখ রাখতে হিমশিম খেতে হয়েছে। সেখানে নতুন কাঠামোয় এক রাতেই ১৮ ম্যাচে চোখ রাখার সমাধান কী?
কোনো সমাধান নেই। পছন্দের ম্যাচটিকে ‘মেইন ডিশ’ বানিয়ে বাকিগুলো রাখতে হবে একটু একটু করে। সব দেখার লোভ করতে গেলে পরিস্থিতি হতে পারে টমের মতো। উইলিয়াম হান্না ও জোসেফ বারবেরার এই কার্টুনে জেরির দুষ্টুমির শিকার হয়ে একসঙ্গে অনেক কিছু খেয়াল করতে গিয়ে বেচারা টমের চোখ দুটো ভন ভন করে ঘুরতে ঘুরতে কোটর থেকে বেরিয়ে গিট্টু লেগেছে।
একবার ভাবুন তো, সামনে ১৮টি স্ক্রিন, একসঙ্গে ১৮টি ম্যাচ চলছে—কোনটা রেখে কোনটা দেখবেন! ‘জেরি’ উয়েফার ‘দুষ্টুমি’তে তখন আপনি অবশ্যই টম।
কার্টুন ছেড়ে বাস্তবতায় ফেরা যাক। সেটা আরও ভয়ানক। কাল রাতে টিভিতে কয়েকটি চ্যানেল কয়েকটি ম্যাচ সরাসরি সম্প্রচার করেছে। একসঙ্গে যেহেতু সব দেখা সম্ভব না, তাই হয়তো একটি চ্যানেলে চোখ রেখে মুঠোফোনে আপডেট নিয়েছেন অন্য ম্যাচগুলোর। কিংবা মুঠোফোনে ম্যাচ দেখলে মাঝেমধ্যে অন্য ট্যাবে গিয়ে অন্য ম্যাচগুলোর স্কোর দেখতে হয়েছে।
ঝামেলাটা ঠিক এখানেই। ধরুন, আপনি ম্যানচেস্টার সিটির সমর্থক। এমনিতেই খুব চাপে ছিলেন। ক্লাব ব্রুগার বিপক্ষে লিগ পর্বের শেষ ম্যাচটা জিততে না পারলেই বিদায়। এর মধ্যে ইতিহাদ স্টেডিয়ামের বাইরে লাগল আগুন। সেটি নিভিয়ে ফেলার পর ব্রুগার বিপক্ষে ম্যাচের ৫ মিনিট যেতে না যেতেই অন্য স্কোরে তাকিয়ে চক্ষু ছানাবড়া—ভিলা পার্কে সেল্টিকের বিপক্ষে এই সময়ের মধ্যেই দুই গোল করে ফেলেছেন অ্যাস্টন ভিলার অখ্যাত মরগান রজার্স! চ্যাম্পিয়নস লিগের ইতিহাসে ম্যাচ শুরুর ৫ মিনিটের মধ্যে দুই গোলের প্রথম এই নজির সরাসরি দেখতে না পারায় নিশ্চয়ই খারাপ লাগার কথা।
সেই খারাপ লাগা আরও বাড়তে পারে, ঠিক তখনই রেড বুল অ্যারেনায় তাকিয়ে। আতলেতিকো মাদ্রিদের ডাগ আউটে বসে থাকা বাবাকে (কোচও) সাক্ষী রেখে চ্যাম্পিয়নস লিগে নিজের প্রথম গোলটি পেয়ে গেছেন জিউলিয়ানো সিমিওনে। সিটির ম্যাচে চোখ ফিরিয়ে দেখতে দেখতে হয়তো একটু মনে হয়েছিল, যাই একটু রিয়াল মাদ্রিদের স্কোর দেখে নিই। গিয়ে দেখলেন রদ্রিগো গোল করে ফেলেছেন। আর সেই গোলটিও সরাসরি না দেখার আক্ষেপ জাগতে পারে। কারণ, ধারাভাষ্যকার বলছিলেন, চ্যাম্পিয়নস লিগের এ মৌসুমে রিয়ালের সেরা গোলগুলোর একটি। দুই ডিফেন্ডারকে কাটিয়ে দুরহ কোণ থেকে বাঁ পায়ের নিখুঁত ফিনিশিং।
লিভারপুলের ইতিহাসে সর্বকনিষ্ঠ হিসেবে নাল্লোর লাল কার্ড দেখে মাঠ ছাড়ার সেই দৃশ্য সিটির সমর্থক হিসেবে হয়তো আপনার মন্দ লাগত না! কিন্তু কী করবেন, একসঙ্গে কয়টি ম্যাচেই বা চোখ রাখবেন, কয়টি গোলই বা দেখবেন?
এমন সব আক্ষেপের মধ্যেই আপনার হয়তো মাথার চুল ছিঁড়তে ইচ্ছে করবে প্রথমার্ধের শেষ মিনিটে সিটির গোল হজমে। বিরতির পর সিটির ঘুরে দাঁড়ানোর প্রার্থনায় আপনি যখন আর কোনো স্কোরেই চোখ রাখেননি, সেই সময়ের মধ্যে অনেক কিছুই ওলট–পালট হয়েছে। অখ্যাত সেই ২২ বছর ১৮৭ দিন বয়সী মরগান হ্যাটট্রিকই করে বসেছেন। ২০০৪ সালে ফেনেরবাচের বিপক্ষে ১৮ বছর ৩৪০ দিন বয়সে ওয়েইন রুনির সেই হ্যাটট্রিকের পর দ্বিতীয় সর্বকনিষ্ঠ ইংলিশম্যান হিসেবে তাঁর এই হ্যাটট্রিক—যা আপনি হয়তো জেনেছেন শেষ বাঁশি বাজার পর। কারণ, সমর্থক হিসেবে দ্বিতীয়ার্ধে সিটির তিন গোলে ঘুরে দাঁড়ানোর মজা ছেড়ে অন্য কোথাও চোখ রাখাটা অন্যায়।
সেই ন্যায়পালনের ন্যায়পাল হতে গিয়েই আপনি হয়তো দেখেননি আরও দুটো হ্যাটট্রিক। ইন্টার মিলানের হয়ে লাওতারো মার্তিনেজের চ্যাম্পিয়নস লিগে প্রথম হ্যাটট্রিক। ২০১৮ সালে পাওলো দিবালার পর কোনো আর্জেন্টাইনের প্রথম হ্যাটট্রিক সেটি। পিএসজির হয়ে উসমান দেম্বেলেও পেয়েছেন চ্যাম্পিয়নস লিগে নিজের প্রথম হ্যাটট্রিক। এর মধ্যে আবার লিলকে বড় ব্যবধানে জিততে ‘সাহায্য’ করেছে ফেইনুর্ড, দুটি আত্মঘাতী গোল করে!
আত্মঘাতী গোল হয়েছিল তিনটি—তখন পরিসংখ্যানবিদরা জানিয়ে দিয়েছিলেন, ইউরোপসেরার এই লড়াইয়ে প্রথম দল হিসেবে এক ম্যাচে তিনটি আত্মঘাতী গোল করল ডাচ ক্লাবটি। যদিও পরে একটি গোল লিলের নামের পাশে যোগ করেছে উয়েফা। তাই বলে নিজের নামটা মুছতে পারেননি ফেইনুর্ডের সেন্টারব্যাক গেরনট ট্রনার। চ্যাম্পিয়নস লিগের ইতিহাসেই প্রথম খেলোয়াড় হিসেবে এক ম্যাচে দুটি আত্মঘাতী গোল তাঁর!
ব্রুগার আত্মঘাতী গোলে সিটি এগিয়ে যাওয়ার আনন্দে আপনি হয়তো এতটাই বুঁদ ছিলেন যে ফ্রান্সের মাঠে ওই দুটি আত্মঘাতী গোলে চোখ রাখতে পারেননি। হয়তো পারেননি ফিলিপস স্টেডিয়ামে মাত্র ৩ মিনিট ৪৬ সেকেন্ড স্থায়ী হওয়া একটি অভিষেকেও। বদলি হিসেবে লিভারপুলের মূল দলে অভিষেক হয়েছিল ১৮ বছর বয়সী ডিফেন্ডার আমারা নাল্লোর। বলে মাত্র দুটি স্পর্শের পর তৃতীয় স্পর্শের চেষ্টায় প্রতিপক্ষকে ফাউল করে পত্রপাঠ লাল কার্ড দেখে মাঠ ছাড়েন।
লিভারপুলের ইতিহাসে সর্বকনিষ্ঠ হিসেবে নাল্লোর লাল কার্ড দেখে মাঠ ছাড়ার সেই দৃশ্য সিটির সমর্থক হিসেবে হয়তো আপনার মন্দ লাগত না! কিন্তু কী করবেন, একসঙ্গে কয়টি ম্যাচেই বা চোখ রাখবেন, কয়টি গোলই বা দেখবেন? মোট ৬৪ গোলের রাতে ব্যাপারটা একটু কঠিনই, তাই না!
সিটির প্লে–অফে ওঠার শান্তিতে বিছানায় শরীর এলিয়ে ঘুমানোর প্রস্তুতি নিতে গিয়ে পরিসংখ্যান ঘেঁটে হয়তো বেরও করে ফেলেছেন, ইউরোপিয়ান শ্রেষ্ঠত্বের এই টুর্নামেন্টে একটি ‘ম্যাচ ডে’তে এটাই সর্বোচ্চ গোলের রেকর্ড নয়। চ্যাম্পিয়নস লিগে সর্বোচ্চ হলেও তার আগের সংস্করণ ইউরোপিয়ান কাপে এক ‘ম্যাচ ডে’তে সর্বোচ্চ ৬৬ গোল হয়েছে। সেটি ৫৫ বছর আগে ১৯৭০ সালের ১৬ সেপ্টেম্বর।
সকালে উঠে কী মনে হলো?
গতকাল ফুটবলের রাতটি তো জীবনের মতোই। এক জীবনে কি পৃথিবীর সব রূপ–রং–রস উপভোগ করা যায়? মানুষের যা যা পছন্দ, সেসব নিয়ে জীবন কাটিয়ে দেওয়ার পাশাপাশি অন্য সব নুন চাখার মতো চাখতে চাখতেই একদিন ‘রেফারি’র শেষ বাঁশি বেজে ওঠে। তবু আক্ষেপ থাকে, বুকে বিরহ দহনের পাশাপাশি সুখের ব্যথাও বাজে।
এই তো জীবন! এই তো ফুটবল!