যে ৪ কারণে রিয়াল মাদ্রিদকে হারাতে পারে ইউনিয়ন বার্লিন
পূর্ব বার্লিনের কোপেনিক শহরের আলটেন ফোর্সতেরেই মাঠের একটি দোতলা সাদামাটা বিল্ডিং। বিল্ডিংটির গায়ে গ্রাফিতি আঁকা। জার্মান ভাষায় সেখানে যা লেখা, তার অর্থ হচ্ছে, ‘আইরন ইউনিয়ন’। ফুটবল–দুনিয়ায় ক্লাবটির পরিচিতও ‘দ্য আইরন ওয়ানস’ নামে। সেই বিল্ডিংয়ের সামনে লাইন ধরে দাঁড়িয়ে আছেন একদল লোক।
উদ্দেশ্য চ্যাম্পিয়নস লিগের টিকিট কেনা। কয়েক বছর আগেও এই ক্লাবটিকে ঘিরে এমন কোনো দৃশ্যের কথা শুনলে যে কেউ হেসে উঠত। সেই হাসিটি অট্টহাসিও হতে পারত। অথচ সেই ‘পরাবাস্তব’ দৃশ্যটিই এখন বাস্তব। ইউনিয়ন বার্লিন নামের এমন একটি দল এবার চ্যাম্পিয়নস লিগে খেলতে যাচ্ছে, কয়েক বছর আগেও যাদের অস্তিত্বের কথা অনেকের কাছে ছিল অজানা।
২০১৯-২০ মৌসুমের আগপর্যন্ত দলটি কখনো যে বুন্দেসলিগায় খেলার সুযোগই পায়নি। পূর্ব বার্লিনের প্রথম দল হিসেবে সেবারই প্রথম স্তরের লিগে খেলার সুযোগ পায় ইউনিয়ন বার্লিন। অথচ আগের ২০ বছরের কম সময় আগে তারা ছিল চতুর্থ সারির একটি দল। সেই দলটি পরবর্তী সময়ে কী চমক নিয়ে আসছে, তখন কেউ বুঝতেই পারেনি। সে মৌসুমে তারা লিগ শেষ করেছে ১১ নম্বরে থেকে। পরের দুই মৌসুমে তাদের অবস্থান ছিল যথাক্রমে ৫ ও ৭।
উন্নতির সেই ধারাবাহিকতা ধরে রেখে গত মৌসুমে একপর্যায়ে শিরোপা জয়ের সম্ভাবনাও জাগিয়েছিল ইউনিয়ন বার্লিন। ১৮ ম্যাচ শেষে দলটি ছিল পয়েন্ট টেবিলের ২ নম্বরে। এমনকি সে সময় বায়ার্ন মিউনিখের চেয়ে মাত্র ১ পয়েন্টে পিছিয়ে ছিল তারা। শেষ পর্যন্ত অবশ্য শিরোপা জেতা হয়নি। শেষ দিকে পথ হারিয়ে চারে থেকেই মৌসুমের ইতি টানে তারা। ইউনিয়ন বার্লিনের এ অগ্রযাত্রা অনেকের কাছেই অবিশ্বাস্য। কেউ কেউ এই দলের উত্থানকে তুলনা করেছেন ২০১৬ সালে লেস্টার সিটির প্রিমিয়ার লিগ জয়ের সঙ্গেও।
বুন্দেসলিগা মাত করার পর ইউনিয়ন বার্লিনের সুযোগ ইউরোপিয়ান মঞ্চে নিজেদের প্রমাণ দেওয়ার। যেখানে প্রথম ম্যাচেই তারা প্রতিপক্ষ হিসেবে পাচ্ছে রিয়াল মাদ্রিদকে। এই ম্যাচে নিরঙ্কুশ ফেবারিট হিসেবে মাঠে নামবে রিয়াল। শক্তি, সামর্থ্য কিংবা ইতিহাসে দুই দলের পার্থক্য যোজন যোজন। এরপরও ইউনিয়ন বার্লিনকে আগেই বাতিল করার সুযোগ নেই।
এর আগেও শেরিফ তিরাসপুলের মতো অখ্যাত এক দলের কাছে চ্যাম্পিয়নস লিগের গ্রুপ পর্বে হেরেছিল রিয়াল। সেই ম্যাচটিও অনুষ্ঠিত হয়েছিল রিয়ালের মাঠ সান্তিয়াগো বার্নাব্যুতেই। ইউনিয়ন বার্লিনেরও সুযোগ আছে একই ঘটনার পুনরাবৃত্তির। বেশ কিছু কারণে এই ম্যাচে ঘটতে পারে অঘটন। তার উল্লেখযোগ্য চারটি কারণ এখানে তুলে ধরা হলো।
চ্যাম্পিয়নস লিগের চিরায়ত অনিশ্চয়তা
চ্যাম্পিয়নস লিগ অনেক সময়ই বিস্ময় উপহার দেয়। শেরিফের কাছে রিয়ালের হারের কথা তো আগেই বলা হয়েছে। তবে সেটিই কিন্তু একমাত্র উদাহরণ নয়। ১৯৯৮–৯৯ মৌসুমে বায়ার্ন মিউনিখকে হারিয়ে চমকে দেয় ডেনমার্কের অখ্যাত ক্লাব ব্রন্ডবি। ২০১২ সালে বার্সেলোনাকে হারিয়ে অঘটনের জন্ম দেয় সেল্টিক। এই তো গত মৌসুমেই আরবি লাইপজিগের কাছে হারের স্বাদ পেয়েছিল এই রিয়ালই।
তাই চমক ও অঘটনের জাদুর ওপর ইউনিয়ন বার্লিন চাইলে বিশ্বাস রাখতেই পারে। তবে সাম্প্রতিক সময়ে বুন্দেসলিগায় টানা দুই ম্যাচে হেরেছে তারা। এই হারের ধাক্কা সামলে রিয়ালের মতো শক্তিশালী দলের মুখোমুখি হওয়া মোটেই সহজ হবে না। তবে দুটো প্রতিযোগিতা একেবারেই আলাদা। ইউরোপ সেরার মঞ্চ যদি এখনো ইউনিয়ন বার্লিনকে আলাদাভাবে উজ্জীবিত করে, তবে সান্তিয়াগো বার্নাব্যুতে অন্য রকম কিছু ঘটতেই পারে।
অজানা প্রতিভার ঝলক
ইউনিয়ন বার্লিনের সবচেয়ে পরিচিত মুখ লিওনার্দো বোনুচ্চি। নিজের সময়ের অন্যতম সেরা এই ডিফেন্ডারের খেলায় বয়সের ছাপ পড়লেও তাঁর অভিজ্ঞতাকে আড়াল করার কোনো সুযোগ নেই। ক্যারিয়ারে এর আগে পাঁচবার রিয়ালের মুখোমুখি হওয়ার অভিজ্ঞতা আছে বোনুচ্চির। তাই রিয়ালের খেলার অনেক কিছুই তাঁর জানা। অভিজ্ঞতার এই রসদ সতীর্থদের মধ্যেও নিশ্চিতভাবে ছড়িয়ে দেবেন ইউরোজয়ী এই ইতালিয়ান। তবে বোনুচ্চি ছাড়া বেশির ভাগ খেলোয়াড় সম্পর্কে তেমন কোনো ধারণা ছাড়া খেলতে নামবে রিয়াল। এমন দলের বিপক্ষে খেলাটা সব সময় অস্বস্তিকর। ইউনিয়ন বার্লিন যদি শুরু থেকে নিয়ন্ত্রিত ফুটবল খেলতে পারে, তবে তা রিয়ালকে চাপে ফেলতে পারে। এমনকি শুরুতে রিয়াল গোল খেয়ে বসলে ম্যাচে ফেরাটাও কঠিন হয়ে যেতে পারে।
বেলিংহাম ধাঁধার উত্তর জানা
রিয়াল মাদ্রিদকে চলতি মৌসুমে পথ দেখাচ্ছেন জুড বেলিংহাম। লা লিগায় প্রথম ৪ ম্যাচে ৫ গোল করে বেলিংহাম বুঝিয়ে দিয়েছেন তিনি কেন এত আরাধ্য। লা লিগা এর আগে বেলিংহামকে এতটা কাছ থেকে দেখেনি। তাই রহস্য আবিষ্কারের আগেই বেলিংহাম হয়ে উঠেছেন অপ্রতিরোধ্য। তবে বেলিংহামের খেলার আদ্যোপান্ত না হলেও অনেকটাই জানা আছে ইউনিয়ন বার্লিনের। রিয়ালে যাওয়ার আগে বেলিংহাম খেলেছেন বুন্দেসলিগার ক্লাব বরুসিয়া ডর্টমুন্ডে।
এখন পর্যন্ত ছয়বার এই ইংলিশ মিডফিল্ডারের মুখোমুখি হয়েছে ইউনিয়ন বার্লিন। যেখানে দুবার বেলিংহামকে হারের তিক্ত স্বাদও দিয়েছে তারা। বেলিংহামকে নিষ্ক্রিয় করে রাখার সূত্রটা বেশ ভালোভাবেই জানে তারা। গত বছরের অক্টোবরে ডর্টমুন্ডের বিপক্ষে ব্যাকে পাঁচজন খেলোয়াড় রেখে ডায়মন্ড মিডফিল্ড ফরমেশন তৈরি করেন ফিশের। আর এই জালে ঠিকঠাকভাবেই আটকা পড়েন বেলিংহাম। ইউনিয়ন বার্লিন ম্যাচ জিতে ২–০ গোলে। এখন রিয়ালের বিপক্ষে বেলিংহামকে বশে রাখার সেই মন্ত্র আবার ফিরিয়ে আনতে পারলে রিয়াল–বধও অসম্ভব নয়।
আরস ফিশারের জাদু
ক্লাবটিকে বদলে দেওয়ার মূল কারিগর কোচ আরস ফিশের। ২০১৮ সালে দায়িত্ব নেওয়ার পর দলকে বদলে দেন এই সুইস কোচ। মাছ ধরতে পছন্দ করা এই কোচই ইউনিয়ন বার্লিনকে বুন্দেসলিগার ট্রেন ধরিয়ে দেন। কীভাবে ‘অখ্যাত’ একদল খেলোয়াড়কে দিয়ে একটি ক্লাবকে বড় স্বপ্ন দেখানো যায়, তা বেশ ভালোভাবেই দেখিয়েছেন এই সুইস কোচ।
এমনকি রূপকথার গল্প লিখে দলটিকে পৌঁছে দেন চ্যাম্পিয়নস লিগেও। চ্যাম্পয়িনস লিগের ড্রয়ের পর ফিশার বলেছিলেন, ‘রিয়াল মাদ্রিদ বিশ্বের সেরা দল। তাদের বিপক্ষে তাদের মাঠে খেলাটা স্বপ্ন সত্যি হওয়ার মতো।’ তবে স্বপ্নটা আরও রঙিন হবে যদি রিয়ালের মাঠ থেকে জয় নিয়ে ফিরতে পারলে। ফিশের অবশ্য সহজে হার মানার পাত্র নন। যে দলটিকে তলানি থেকে এ পর্যায়ে নিয়ে এসেছেন, তাদের নিয়ে ইউরোপের শ্রেষ্ঠত্বের মঞ্চে সাফল্য মুখিয়েই থাকবেন এই কোচ।