চোট কি মেসিকে শেষের বার্তা দিচ্ছে
‘ক্লান্তি আমার ক্ষমা করো প্রভু’—রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের গানের এ পঙ্ক্তি লিওনেল মেসির শোনার কথা নয়। আর শুনলেও স্প্যানিশ ভাষার বাইরে আর কোনো ভাষা ভালোভাবে না জানা মেসির পক্ষে এর অর্থ জানার কথাও নয়। তবে মেসি না শুনলে কিংবা না বুঝলেও এই গানের লাইনটির সঙ্গে যেন মিলে যাচ্ছে তাঁর বর্তমান অবস্থা। ক্লান্তি এবং চোট মিলিয়ে মেসি এখন যেন ‘ক্লান্ত প্রাণ’!
প্রায় দুই দশক আগে পেশাদার ফুটবলে যাত্রা শুরু করেন মেসি। এরপর উত্থান–পতনের রোলারকোস্টার অভিজ্ঞতার মধ্য দিয়ে সাফল্যের শিখর স্পর্শ করেছেন আর্জেন্টাইন তারকা। ফুটবলের সম্ভাব্য সব শিরোপা জয়ের পথে সর্বকালের অন্যতম সেরা ফুটবলার হিসেবে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করেছেন মেসি। কারও কারও চোখে ‘এলএম টেন’ অবশ্য সর্বকালের সেরাই! বিশেষ করে ২০২২ সালে কাতারে বিশ্বকাপ জয়ের পর শ্রেষ্ঠত্ব নিয়ে অনেক বিতর্কেরই ইতি টেনেছেন মেসি।
বিশ্বকাপ জয়ের পর ক্লাব ফুটবলে নতুন দিগন্তের সূচনা করতে পিএসজি ছেড়ে মেসি পাড়ি জমান যুক্তরাষ্ট্রের ক্লাব ইন্টার মায়ামিতে। যুক্তরাষ্ট্রের খেলার জগতে বদল আনতে মেসির সেখানে যাওয়াই যথেষ্ট ছিল। মেসির পদধ্বনিতেই বৈপ্লবিক পরিবর্তন এসেছে যুক্তরাষ্ট্রের ফুটবলে। মেসির কারণে দেশটিতে প্রতিনিয়ত ফুটবলের ভক্ত–সমর্থকও বাড়ছে দারুণভাবে। এত কিছুর পরও যুক্তরাষ্ট্রে গিয়ে ঠিক স্বস্তিতেই নেই মেসি।
নাহ্, মাঠের খেলা বা দলের ভেতরকার কোনো সমস্যা নয়, মেসিকে ভোগাচ্ছে মূলত চোট। আর চোটের সঙ্গে ভর করেছে অশেষ ক্লান্তিও। সর্বশেষ কনক্যাকাফ চ্যাম্পিয়নস কাপে ন্যাশভিলের বিপক্ষে ৩–১ গোলে জেতা ম্যাচে চোটের কারণে মাঠ ছেড়েছিলেন মেসি। পরীক্ষা–নিরীক্ষার পর মেসির ডান পায়ে হ্যামস্ট্রিংয়ের চোটের কথা জানা গেছে, যা তাঁর জাতীয় দলের হয়ে প্রীতি ম্যাচ খেলাকেও শঙ্কায় ফেলেছে। ২৩ মার্চ এল সালভাদর এবং ২৭ মার্চ কোস্টারিকার সঙ্গে প্রীতি ম্যাচ খেলবে আর্জেন্টিনা।
দুই দশকের লম্বা ক্যারিয়ারে ‘চোটপ্রবণ’ খেলোয়াড় হিসেবে কখনোই পরিচিত ছিলেন না মেসি। অবশ্য এমনও নয় যে একেবারে চোটে পড়েননি। এটুকু বলা যায় যে চোট কখনোই মেসির অর্জনের পথে বাধা হয়ে দাঁড়াতে পারেনি। কিন্তু এখন মেসির বয়স ৩৬ পেরিয়েছে। ক্যারিয়ারে গোধূলিবেলায় এসে দাঁড়িয়েছেন। স্বাভাবিকভাবেই মেসির শরীরও এখন বেগড়বাই শুরু করেছে।
মেসির ইন্টার মায়ামি অধ্যায়ের কথাই ধরা যাক। ফ্লোরিডার ক্লাবটির হয়ে শুরুটা দারুণভাবেই করেছিলেন। মেসি–জাদুতে প্রথম শিরোপাও জিতেছে মায়ামি। কিন্তু এরপরই চোট মেসির শরীরে আধিপত্য বিস্তার করতে শুরু করে। গত বছরের ২০ সেপ্টেম্বর টরেন্টো এফসির হয়ে মায়ামির ৪–০ গোলের জয়ে ৩৭ মিনিটে চোটের কারণে মাঠ ছাড়তে হয় মেসিকে। সেটি ছিল মায়ামির জার্সিতে মেসির প্রথম চোট। সেদিন বেঞ্চে বসে থাকা মেসির ক্লান্ত মুখের একটি ছবিও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে বেশ ভাইরাল হয়েছিল। মনে হচ্ছিল, ফুটবল খেলাটা নিয়ে রাজ্যের অভিমান ভর করেছে মেসির মনে।
শুরুতে মায়ামির পক্ষ থেকে মেসির এই চোটকে ‘অবসাদ’ বলা হলেও, পরবর্তী সময়ে সেটি ভুল প্রমাণিত হয়েছে। এর পর থেকে নিয়মিতই চোট হানা দিতে শুরু করে মেসির শরীরে। এর মধ্যে ইউএস ওপেন কাপের ফাইনাল এবং এমএলএসের শেষ দিকের ম্যাচও মিস করেছেন মেসি। ৭ অক্টোবর মেসি বেঞ্চ থেকে দলে ফিরলেও ঠেকাতে পারেননি এফসি সিনসিনাটির বিপক্ষে ১–০ গোলের হার। সেই হার মেসিকে এমএলএসের প্লে–অফের দৌড় থেকে ছিটকে দেয়। ২০২৩ সালে চোটের কারণে ইন্টার মায়ামির হয়ে ১৬ দিন বাইরে থেকে ৪ ম্যাচ মিস করেছেন মেসি। এর মধ্যে আর্জেন্টিনা জাতীয় দলেও চোটে পড়ে অনিয়মিত ছিলেন মেসি।
ইন্টার মায়ামির প্রাক্–মৌসুম সফরেও চোটের কারণে বেশ ভুগতে হয় মেসিকে। চোট থাকায় আল হিলাল এবং আল নাসরের বিপক্ষে পুরো সময় খেলতে পারেননি মেসি। এরপর হংকং একাদশের বিপক্ষে তাঁর খেলতে না পারা নিয়ে হয়েছে তুলকালাম, যার রেশ ধরে চীনে আর্জেন্টিনার প্রীতি ম্যাচ পর্যন্ত বাতিল করা হয়েছে। এরপর এমএলএসের নতুন মৌসুমে মেসিকে তাড়া করছে চোট।
এর আগে ক্যারিয়ার শুরুতে মেসিকে ভুগিয়েছে হ্যামস্ট্রিংয়ের চোট। বিশেষ করে বাঁ পায়ে এ সমস্যায় বেশি ভুগেছেন। এরপরও শীর্ষ পর্যায়ে ফুটবলার হিসেবে ক্যারিয়ারের সেরা সময়ে তুলনামূলকভাবে কম চোটে পড়তে হয়েছে মেসিকে।
ট্রান্সফারমার্কেট এর তথ্য বলছে, মেসি তাঁর ক্যারিয়ারে একটানা লম্বা সময়ের জন্য বাইরে ছিলেন ২০০৬–০৭ সালে। সেবার ৮৭ দিন মাঠে বাইরে থেকে মেসি মিস করেছিলেন ১৯ ম্যাচ। এর আগে ২০০৫–০৬ মৌসুমে দুই দফায় চোটে পড়ে ৮৪ দিন মাঠের বাইরে থেকে ১৮ ম্যাচ মিস করেছিলেন সাবেক এ বার্সেলোনা তারকা। এরপর ২০০৭–০৮ মৌসুমে ফের দুই দফায় চোটে পড়ে ৬৩ দিন বাইরে ছিলেন মেসি। সেবার মেসি মিস করেছিলেন ১৫ ম্যাচ। শুরু এই ধাক্কা পরবর্তী সময়ে সামলে নেন এ প্লেমেকার। এরপর নির্দিষ্ট মৌসুমে চোটে পড়ে দুই অঙ্কের বেশি ম্যাচে মিস করার ঘটনা মেসির ক্যারিয়ারে ঘটেছে চারবার। যদিও এর কোনোটিই নির্দিষ্ট একটি চোটের কারণে ছিল না।
অ্যাথলেটদের ক্যারিয়ারে জন্য চোট অবশ্য একটি সাধারণ ব্যাপার। ক্যারিয়ারের বিভিন্ন পর্যায়ে এ কারণে ভুগতেই হয় তাদের। কিন্তু মেসির বর্তমান চোটের সঙ্গে যোগ আছে ক্লান্তি এবং বয়সের। এ ছাড়া ফুটবলের কাছ থেকে মেসি আর কোনো চাওয়া–পাওয়া নেই। ফলে শারীরিক ও মানসিক প্রতিক্রিয়াও এখন আর আগের মতো নেই। তবে কোপা আমেরিকার আগমুহূর্তে মেসির এ চোট ও ক্লান্তি দুশ্চিন্তা বাড়াতে পারে আর্জেন্টিনা ভক্তদের। মেসিকে ঘিরেই যে আরেকটি মহাদেশীয় শিরোপার স্বপ্ন দেখছে তারা। মেসিও নিশ্চয় এভাবে চোট ও ক্লান্তির কাছে হার মানতে চাইবেন না। বিদায়ের আগে আরেকবার জ্বলে উঠতে চাইবেন স্বমহিমায়।