এমবাপ্পেকে ভরা গ্যালারিতে বরণ করে নিল রিয়াল
সান্তিয়াগো বার্নাব্যুতে টানেলের সিঁড়ি ভেঙে হাত নাড়তে নাড়তে দেখা দিলেন কিলিয়ান এমবাপ্পে। রিয়াল মাদ্রিদের সাদা জার্সিতে তাঁকে একটু অন্য রকমই লাগছিল। স্বপ্নপূরণের আতিশয্যে ফরাসি তারকা নিজেও সম্ভবত একটু লজ্জা পাচ্ছিলেন। হাসছিলেন মিটিমিটি।
সমর্থকদের অবশ্য এত খুঁটিনাটি দেখার সময় কোথায়! টানেলের সিঁড়ি ভাঙার সময়ই গর্জনে ফেটে পড়েছে বার্নাব্যুর গ্যালারি। স্লোগান ধরেছে এমবাপ্পের নামে। কিছুক্ষণ পর এমবাপ্পে যখন মঞ্চে কথা বলার মাঝে ‘আলা মাদ্রিদ’ বলে উঠলেন, তখন সমর্থকদের গর্জনে কেউ কেউ কানেও হাত দিয়েছেন। আর কেউ কেউ হয়তো ভেবেছেন যাক, স্বপ্ন সত্যি হলো!
স্বপ্ন সত্যি হওয়ার ব্যাপারটি দুই পক্ষের জন্যই সত্যি। রিয়ালে যোগ দেওয়া যেমন এমবাপ্পের স্বপ্ন ছিল, তেমনি মাদ্রিদের ক্লাবটিও ২০১৭ সাল থেকে ছুটছিল তাঁর পিছু। প্রায় প্রতি মৌসুমে দলবদলের বাজারে গুঞ্জন উঠেছে, এবার বুঝি পিএসজি ছেড়ে রিয়ালে যাচ্ছেন। কিন্তু ছয় বছর ধরে কোনোভাবেই ব্যাটে–বলে মেলাতে পারেনি দুই পক্ষ। ২০২২ সালে জুনে এমবাপ্পের রিয়ালে যোগ দেওয়া যখন নিশ্চিত মনে হচ্ছিল, ফ্রান্সের প্রেসিডেন্ট এমানুয়েল মাখোঁর হস্তক্ষেপে পিএসজিতে থেকে যেতে রাজি হন তিনি। শেষ পর্যন্ত গত জুনে ‘ফ্রি এজেন্ট’ হয়ে পড়া এমবাপ্পের সঙ্গে পাঁচ বছরের চুক্তি করে রিয়াল। এরপর অপেক্ষা ছিল আনুষ্ঠানিকভাবে পরিচয় করিয়ে দেওয়ার।
ইউরোপিয়ান চ্যাম্পিয়নশিপ (ইউরো) শেষে আজ সে আনুষ্ঠানিকতাও সারল রিয়াল। বার্নাব্যুতে সমর্থকদের সামনে ঐতিহ্যবাহী ৯ নম্বর জার্সিতে এমবাপ্পেকে নিজেদের খেলোয়াড় হিসেবে পরিচয় করিয়ে দিল বর্তমান ইউরোপিয়ান চ্যাম্পিয়নরা।
স্প্যানিশ সংবাদমাধ্যম আগেই জানিয়েছিল, এমবাপ্পেকে পরিচয় করিয়ে দেওয়ার এই অনুষ্ঠানে বার্নাব্যুর কোনো সিট খালি থাকবে না। ৮০ হাজার আসনের এই স্টেডিয়ামে সিট তো নেই–ই, স্টেডিয়ামের বক্সগুলোও খালি নেই বলে আজ অনুষ্ঠান শুরুর আগে জানিয়েছিল স্প্যানিশ সংবাদমাধ্যম এএস। অন্তত ১০০ সংবাদকর্মীও উপস্থিত ছিলেন এই মহাযজ্ঞে। স্টেডিয়ামের ভেতর মাঠে তৈরি করা হয়েছিল নীল রঙের মঞ্চ। তার ওপরে সারি সারি করে রাখা রিয়ালের চ্যাম্পিয়নস লিগ শিরোপা। দর্শক আসনে এমবাপ্পের মা ফাইজা লামারিকেও চশমার নিচ দিয়ে একবার চোখ মুছতে দেখা গেল। সন্তানের এই অর্জনে আবেগ ভর করেছিল লামারির মনে।
আবেগ ভর করেছিল এমবাপ্পের মধ্যেও। রিয়াল সভাপতি ফ্লোরেন্তিনো পেরেজ এমবাপ্পেকে মঞ্চে ডেকে আনার পর সেখানে উপস্থিত ছিলেন রিয়াল ও ফ্রান্সের কিংবদন্তি জিনেদিন জিদান। ফ্রান্সের এই সময়ের সেরা তারকাকে দলে ভেড়ানোর অনুষ্ঠানে সেই দেশের ইতিহাস–সেরা ফুটবলারকে এর বাইরে রাখার কথা ভাবেনি রিয়াল। আর জিদান তো রিয়ালের ‘ঘরেরই মানুষ’। কোচ হিসেবে টানা তিনবার ইউরো–সেরা বানিয়েছেন রিয়ালকে। মঞ্চে কিংবদন্তির সামনে দাঁড়িয়েই মুখে হাসি ফুটিয়ে একটু ধরে আসা গলায় সমর্থকদের প্রতি ‘শুভ সকাল’ জানান এমবাপ্পে। এরপর বলেছেন, ‘স্প্যানিশে কথা বলার চেষ্টা করব।’
এমবাপ্পে এরপর নিজের কথা বললেন, ‘এখানে আসতে পেরে অবিশ্বাস্য লাগছে। অনেক বছর ধরেই রিয়ালে খেলার স্বপ্ন দেখেছি, আজ সেই স্বপ্ন সত্যি হলো। সুখী লাগছে। রিয়াল সভাপতি ফ্লোরেন্তিনো পেরেজকে ধন্যবাদ। তিনি প্রথম দিন থেকেই আমার ওপর আস্থা রেখেছেন। অনেক কিছুই ঘটেছে...কিন্তু ধন্যবাদ। এখানে আসার জন্য যাঁরা সাহায্য করেছেন, তাঁদেরকেও ধন্যবাদ। (গ্যালারির প্রতি) আমার পরিবারকে দেখছি। মা কাঁদছেন (বলে রিয়ালের ব্যাজে চুমু খান এমবাপ্পে)।’
পিএসজিতে সাত মৌসুম কাটানো এমবাপ্পে এরপর রিয়ালে নিজের লক্ষ্য নিয়ে বললেন, ‘শৈশব থেকে একটি স্বপ্নই দেখেছি এবং এখানে আসতে পারাটা আমার জন্য অনেক কিছু। এখন আমার সামনে আরেকটি স্বপ্ন। এই ক্লাবের ইতিহাসের অংশ হতে চাই। এই ক্লাব ও ব্যাজের জন্য আমি নিজের জীবন উৎসর্গ করব।’ ২৫ বছর বয়সী এই ফরোয়ার্ড এরপর একটু থেমে বলে চললেন, ‘ফুটবল ইতিহাসে সেরা ক্লাবটির খেলোয়াড় হয়ে নিজের স্বপ্নপূরণ করতে পেরে ভালো লাগছে...এখন সবাই একসঙ্গে বলি ১, ২, ৩, আলা মাদ্রিদ!’ গ্যালারিতে ৮০ হাজার পেরিয়ে যাওয়া সমর্থকের দলও সঙ্গে সঙ্গে ‘আলা মাদ্রিদ’ বলে সমস্বরে গর্জন করে ওঠেন।
মঞ্চে কথা বলা শেষে মাঠে নেমে কয়েকটি বল নিয়ে কসরত দেখান এমবাপ্পে। কিছু বল কিক মেরে গ্যালারিতেও পাঠান। বলটি স্যুভনির হিসেবে রাখতে সমর্থকদের মধ্যে কাড়াকাড়ি পড়েছে। এর মধ্যে গ্যালারির কাছে গিয়ে এক খুদে সমর্থকের হাতে বলও তুলে দিয়েছেন।
জিদান, এমবাপ্পে এবং তাঁর মাকে সঙ্গে নিয়ে মঞ্চে ছবিও তুলেছেন রিয়াল সভাপতি পেরেজ। এমবাপ্পে মঞ্চে ওঠার আগে রিয়াল সভাপতি তাঁর বক্তব্যের একটি অংশে বলেছেন, ‘রিয়ালের প্রতি নিঃশর্ত ভালোবাসার জন্য ধন্যবাদ। তোমার চ্যারিটি ফাউন্ডেশনের কারণে ফ্রান্স থেকে হাজারো খুদেরা এসেছে। এসব দেখে খুব গর্ব লাগছে। কিলিয়ান, ঘরে তোমাকে স্বাগত, রিয়াল মাদ্রিদে স্বাগত।’
কোচ কার্লো আনচেলত্তির অধীনে গতকাল থেকেই অনুশীলন শুরু করেছে রিয়াল। এমবাপ্পে কয়েক দিন পর অনুশীলনে যোগ দেবেন। ইউরোয় তাঁর অধিনায়কত্বে সেমিফাইনালে উঠেছিল ফ্রান্স। স্পেনের কাছে হেরে বাদ পড়ে। পিএসজিতে ছয়বার লিগ জিতলেও চ্যাম্পিয়নস লিগ জিততে পারেননি। ইউরোপ–সেরা হওয়ার স্বপ্নও এমবাপ্পের রিয়ালে যোগ দেওয়ার বড় কারণ।