উৎপল শুভ্রর লেখা
বেকেনবাওয়ার যেদিন হেরেও জিতেছিলেন
বেকেনবাওয়ার শুধুই একজন ডিফেন্ডার ছিলেন না। খেলা শুরু করেছিলেন ফরোয়ার্ড হিসেবে, পরে মিডফিল্ড হয়ে নেমে আসেন ডিফেন্সে। রক্তে আক্রমণের নেশাটা তাই ছিলই।
ফ্রাঞ্জ বেকেনবাওয়ার আমার কাছে শুধু টেলিভিশনে দেখা ছবি নন। সামনাসামনিও দেখেছি। ঘটনাচক্রে তখনো তাঁর পরনে সাদা পোশাক, তখনো তিনি ছিপছিপে। ২৩ বছর আগে খেলোয়াড়ি জীবনের ইতি টেনেছেন বলে শুধু ‘তরুণ’ বলা যাচ্ছে না। চোখে চশমাই শুধু নয়, মুখেও ছাপ ফেলেছে বয়স। তখন তো তিনি প্রায় ৬১। জীবনের প্রথম বিশ্বকাপ ফুটবল কাভার করতে জার্মানি গিয়েছি। বেকেনবাওয়ার সেই ২০০৬ বিশ্বকাপের প্রাণপুরুষ। ভেন্যু থেকে ভেন্যুতে ঘুরে বেড়াচ্ছেন। সংবাদ সম্মেলনের বাইরেও দু-তিনবার খুব কাছ থেকে দেখেছি। দূর থেকে আরও অনেকবার।
ফুটবলার বেকেনবাওয়ার কোথায় আলাদা ছিলেন, তা তাঁর খেলা দেখে যতটা জেনেছি, তার চেয়ে বেশি জেনেছি পড়ে। সংগঠক বেকেনবাওয়ারের বিশেষত্ব বুঝতে এসবের দরকার হয়নি। নিজেই সেটির সাক্ষী। এর আগে কখনো যেহেতু বিশ্বকাপ কাভার করিনি, ২০০৬ জার্মানি বিশ্বকাপের আয়োজন ভালো হচ্ছে না খারাপ, তা বিচার করার ক্ষমতা আমার ছিল না। তবে ১০টা-১২টা বিশ্বকাপ কাভার করে ফেলেছেন, এমন সাংবাদিকদেরও জার্মানি বিশ্বকাপ নিয়ে উচ্ছ্বসিত হতে দেখেই যা বোঝার বুঝে নিয়েছি।
বিক্ষিপ্তভাবে সুইপার পজিশনের ব্যবহার আগেও হয়েছে ফুটবলে। তবে ডিফেন্সের পেছনে আর গোলকিপারের সামনে রক্ষণের শেষ দেয়াল সুইপার যে এমন আক্রমণের অস্ত্র হয়ে উঠতে পারে, তা কেউ কল্পনাও করেনি কোনো দিন। সেই কল্পনাতীত ব্যাপারটাই রূপায়িত হয়েছিল বেকেনবাওয়ারের পায়ে।
নিজেই অবশ্য কিছুটা বুঝেছিলাম বিশ্বকাপের প্রথম দিনই। বিশ্বকাপের উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে যেখানে নাচ-গান আর আলোকচ্ছটার বাইরে ফুটবল বলতে তেমন কিছুই থাকে না, সেখানে জার্মানি বিশ্বকাপের উদ্বোধনী অনুষ্ঠান ছিল আনন্দদায়ী ব্যতিক্রম। এর আগে বিশ্বকাপজয়ী সব ফুটবলার সেই অনুষ্ঠানে আমন্ত্রিত। অলিম্পিকের মার্চপাস্টের মতো সেই বিশ্বকাপজয়ী দলগুলো একে একে মাঠে ঢুকেছিল। দল বলতে তো আর দল নয়। সবাই তো আর তত দিনে বেঁচে নেই। জীবিত অনেকেও আসতে পারেননি নানা কারণে। তারপরও যাঁরা এসেছিলেন, তাতেই মিউনিখের আলিয়াঞ্জ অ্যারেনাতে কিংবদন্তির মেলা বসে গিয়েছিল। চিন্তাটা কার মাথা থেকে এসেছিল, তা মনে হয় আর বলার দরকার নেই।
দুই দিন আগে-পরে মারিও জাগালো আর ফ্রাঞ্জ বেকেনবাওয়ারের চলে যাওয়াটাও কী অদ্ভুত! এই দুটি নাম তো একসঙ্গেই উচ্চারিত হয়ে আসছে আজ অনেক বছর। খেলে বিশ্বকাপ জিতেছেন, পরে কোচিং করিয়েও। ২০ বছর এই কীর্তিতে একমাত্র কীর্তিমান ব্রাজিলের মারিও জাগালোর গৌরবে বেকেনবাওয়ার ভাগ বসানোর পর দুজনের মধ্যে একটা সূক্ষ্ম পার্থক্য করতে দেখেছি কাউকে কাউকে। জাগালো তো ১৯৫৮ বিশ্বকাপজয়ী ব্রাজিলের দলের অধিনায়ক ছিলেন না। অধিনায়ক ও কোচ—দুই ভূমিকাতেই বিশ্বকাপ জয়ের কৃতিত্ব তাই শুধুই বেকেনবাওয়ারের। ২০১৮ বিশ্বকাপ জিতে দিদিয়ের দেশম সেখানেও বেকেনবাওয়ারকে একা থাকতে দেননি।
এসব সূক্ষ্ম বিচার বাদ দিয়ে এই তিনজনকে তাই একসঙ্গে রাখাই ভালো। তবে তা শুধু নির্দিষ্টভাবে এই ‘ডাবল’-এর ক্ষেত্রেই। ফ্রাঞ্জ বেকেনবাওয়ারকে তো শুধু এই কীর্তিতে বেঁধে রাখার উপায় নেই। খেলোয়াড় হিসেবেও বাকি দুজনের চেয়ে অনেক বড়। তা না হয় বাদই থাক, বেকেনবাওয়ার আলাদা হয়ে যাচ্ছেন খেলা ছাড়ার পরও খেলাটির সঙ্গে আরও বেশি করে জড়িয়ে থাকার কারণে। সেটিও কত রকম ভূমিকায়! কোচ, প্রশাসক, সংগঠক, প্রভাবক—সব মিলিয়ে ফ্রাঞ্জ বেকেনবাওয়ার সম্ভবত ফুটবল ইতিহাসেরই সবচেয়ে প্রভাবশালী ব্যক্তিত্ব। বলতে পারেন, এক এবং অনন্য।
খেলোয়াড়ি অধ্যায়টা কি আগে সেরে নেওয়া ভালো? এত কিছু করার পরও সেটাই তো বেকেনবাওয়ারের মূল পরিচয়। ফুটবলে যা যা জেতা সম্ভব, তার সবই জিতেছেন। তা এমন তো জিতেছেন আরও অনেকেই। বেকেনবাওয়ার কোথায় এসে বাকিদের চেয়ে আলাদা হয়ে যান? এই প্রশ্নের উত্তরটা দেওয়ার আগে একটু ভূমিকা করা যাক। যে কাউকে যদি সর্বকালের সেরা ফুটবলারদের একটা তালিকা করতে বলা হয়, তাতে কিছু নাম অবশ্য অবশ্যই কমন থাকবে। এখনো ঘোরতর বর্তমান মেসি-রোনালদো এবং সাম্প্রতিক অতীত জিদানকে বাইরে রাখলে যে নামগুলো পাবেনই পাবেন, তা মোটামুটি এমন—পেলে, ম্যারাডোনা, ফেরেঙ্ক পুসকাস, ইয়োহান ক্রুইফ, আলফ্রেডো ডি স্টেফানো, ফ্রাঞ্জ বেকেনবাওয়ার। এবার নামগুলো একটু মন দিয়ে খেয়াল করুন। পরপর অনেকগুলো নাম দিয়ে কুইজের প্রশ্ন হয় না, এখানে কে ‘অড ম্যান আউট’, মানে কে আলাদা?
এখানেও যদি এই প্রশ্ন করি, তাহলেই বেকেনবাওয়ারের মাহাত্ম্য অনেকটাই পরিষ্কার হয়ে যাবে। বাকি সবাই তো আক্রমণভাগের খেলোয়াড়, গোল করা আর করানোই যাঁদের কাজ। একমাত্র বেকেনবাওয়ারের ভূমিকাই ছিল উল্টো। যাঁর মূল কাজ প্রতিপক্ষকে গোল করতে না দেওয়া। সেই ডিফেন্ডার হয়েও দুটি ব্যালন ডি’অর (আর কারও এই কীর্তি নেই), ডিফেন্ডার হয়েও সর্বকালের সেরাদের ছোট্ট তালিকাতে। কারণ, বেকেনবাওয়ার শুধুই একজন ডিফেন্ডার ছিলেন না। খেলা শুরু করেছিলেন ফরোয়ার্ড হিসেবে, পরে মিডফিল্ড হয়ে নেমে আসেন ডিফেন্সে। রক্তে আক্রমণের নেশাটা তাই ছিলই।
১৯৬৬ সালে প্রথম বিশ্বকাপেই তো তাঁর ৪ গোল। সেই বিশ্বকাপের সেরা উদীয়মান খেলোয়াড় পরের বিশ্বকাপ আসতে আসতে আরও পরিণত। সেবার মহাকাব্যিক এক সেমিফাইনালে হারার কষ্ট মুছে দিয়ে পরেরবার তো পশ্চিম জার্মানির অধিনায়ক হিসেবে নিজেই উঁচিয়ে ধরলেন বিশ্বকাপ ট্রফি।
বেকেনবাওয়ার কেন বেকেনবাওয়ার—এতেও অবশ্য বোঝানো যায় না। তা বোঝাতে যে শব্দটা আসবে, আপনিও হয়তো সেটিরই অপেক্ষায় আছেন। সেই শব্দটা সুইপার, যেটিকে বদলে দিতে পারেন লিবেরো-তেও। খেলোয়াড়দের বেশির ভাগই শুধু খেলে, হাতে গোনা দু–একজন খেলাটাই বদলে দেয়। বেকেনবাওয়ার দ্বিতীয় দলে।
বিক্ষিপ্তভাবে সুইপার পজিশনের ব্যবহার আগেও হয়েছে ফুটবলে। তবে ডিফেন্সের পেছনে আর গোলকিপারের সামনে রক্ষণের শেষ দেয়াল সুইপার যে এমন আক্রমণের অস্ত্র হয়ে উঠতে পারে, তা কেউ কল্পনাও করেনি কোনো দিন। সেই কল্পনাতীত ব্যাপারটাই রূপায়িত হয়েছিল বেকেনবাওয়ারের পায়ে। এতটাই যে ১৯৬৬ বিশ্বকাপ সেমিফাইনালে ইংল্যান্ডের কোচ আলফ র্যামসি তাঁর দলের মূল স্ট্রাইকার ববি চার্লটনকে ‘জার্মানির সুন্দরতম তরুণ খেলোয়াড়’টির দিকে বাড়তি নজর রাখতে বলে দেন। ববি চার্লটন মাঠে নেমে আবিষ্কার করেন, কোচের তা না বললেও চলত। কারণ, বেকেনবাওয়ার ছায়ার মতো তাঁর গায়ে লেগে আছেন। সঙ্গে সঙ্গেই তিনি বুঝে ফেলেন, জার্মান কোচ হেলমুট শোন তাঁর পেছনে লাগিয়ে দিয়েছেন বেকেনবাওয়ারকে। সেই ম্যাচে ইংল্যান্ড জিতে যাওয়ার পর শোন তাই তুমুল সমালোচনার মুখে—বেকেনবাওয়ারকে মুক্তভাবে খেলতে না দিয়ে জার্মান আক্রমণকে ভোঁতা বানিয়ে দিয়েছেন বলে।
বল পায়ে ডিফেন্স থেকে সাবলীলভাবে উঠে আক্রমণের অংশ হয়ে যেতেন, কখনোবা এর আগেই বাড়িয়ে দিতেন ৩০ গজি-৪০ গজি নিখুঁত পাস। যা দেখে মুগ্ধ নিউইয়র্ক কসমসে তাঁর সতীর্থ ভ্লাদিস্লাভ বোগি একবার বলেছিলেন, ‘তাঁর প্রতিটি পাসের চোখ ছিল, তা খুঁজে নিত তাঁর সতীর্থদের।’ পেলের অনুগামী হয়ে নিউইয়র্ক কসমসে যোগ দেওয়ার পর প্রথম ম্যাচ শুরুর আগে বেকেনবাওয়ারকে দেখে কসমসের মালিক অবশ্য অবাক হয়ে বলেছিলেন, ‘ওর পেছনে এত টাকা খরচ করেছি কি ডিফেন্সের পেছনে দাঁড়িয়ে থাকতে!’ কিছুক্ষণের মধ্যেই সেই অবাক হওয়ার মাত্রাটা আরও বাড়ে। যখন তিনি ডিফেন্সের পেছনে দাঁড়িয়ে থাকা খেলোয়াড়টিকে সারা মাঠেই দেখতে পান।
নিউইয়র্কে যাওয়ার আগেই বায়ার্ন মিউনিখকে ইউরোপীয় পরাশক্তি বানিয়ে গেছেন। ১৯৭৪ থেকে টানা তিনবার ইউরোপিয়ান কাপ (এখন চ্যাম্পিয়নস লিগ) জিতিয়েছেন, তৃতীয়বার যোগ হয়েছে বিশ্বসেরা ক্লাবের স্বীকৃতি ইন্টারকন্টিনেন্টাল কাপও। পরে কোচ, সভাপতি, উপদেষ্টা—নানা ভূমিকায় এই ক্লাবের সঙ্গে জড়িয়ে থেকে হয়ে উঠেছেন ‘মিস্টার বায়ার্ন মিউনিখ’।
বিশ্বকাপে অর্জনের অংশটা তো শুধুই ছুঁয়ে যাওয়া হয়েছে এর আগে। সংক্ষেপে বললে চারটি ফাইনালের সঙ্গে জড়িয়ে তাঁর নাম। খেলোয়াড় হিসেবে যেমন একবার চ্যাম্পিয়ন, একবার রানার্সআপ; কোচ হিসেবেও তা-ই। অথচ ১৯৮৪ সালে সে সময়ের পশ্চিম জার্মানির দায়িত্ব নেওয়ার আগে কোনো কোচিং অভিজ্ঞতাই ছিল না।
খেলোয়াড় ও কোচ হিসেবে মোট পাঁচটি বিশ্বকাপ। যে একবারই শুধু ফাইনাল খেলা হয়নি, সেই ১৯৭০ বিশ্বকাপ আবার স্মরণীয় হয়ে আছে বেকেনবাওয়ারের বীরত্বগাথায়। ইতালির বিপক্ষে সেমিফাইনালে প্রতিপক্ষ ডিফেন্ডার পিয়েরলুইগি সেরার ট্যাকলে বল পায়ে আগুয়ান বেকেনবাওয়ারের ডান হাত কাঁধ থেকে স্থানচ্যুত হয়ে যায়। তখন মাত্র দুজন খেলোয়াড়ই বদল করা যেত, জার্মানির তা করা হয়ে গেছে। টেপ দিয়ে বুকের সঙ্গে জড়িয়ে দেওয়া আহত সেই হাত নিয়েই তাই বাকি সময়টা খেলে যান বেকেনবাওয়ার। ‘শতাব্দীর সেরা ম্যাচ’ নামে পরিচিতি পেয়ে যাওয়া অতিরিক্ত সময়ে গড়ানো সেই সেমিফাইনালে ৪-৩ গোলে হেরে যায় জার্মানি।
তবে ফ্রাঞ্জ বেকেনবাওয়ার বোধ হয় সেদিনও জিতেছিলেন!