কিংস-মোহামেডান ফাইনাল: নতুন এক দ্বৈরথের নিমন্ত্রণ
এ ফাইনাল আগে দেখা যায়নি বাংলাদেশের ফুটবলে!
বসুন্ধরা কিংস ও মোহামেডান স্পোর্টিং ক্লাব এর আগে কখনোই কোনো শিরোপার লড়াইয়ে মুখোমুখি হয়নি। আজ গোপালগঞ্জের শেখ ফজলুল হক মনি স্টেডিয়ামে স্বাধীনতা কাপ ফুটবলের ফাইনাল তাই ভিন্ন এক স্বাদের লড়াই-ই উপহার দিতে যাচ্ছে ফুটবলপ্রেমীদের।
এই জায়গায় একটু থামতেই হচ্ছে। এ দেশের ফুটবলের ঐতিহ্যপন্থী ফুটবল-দর্শকদের কাছে কিংসের সঙ্গে মোহামেডানের তুলনা একটু বাড়াবাড়িই মনে হতে পারে। ইতিহাস-ঐতিহ্য তুলনা করলে কোথায় মোহামেডান আর কোথায় কিংস।
মোহামেডানের অতীত ইতিহাস কত রঙিন, কত বর্ণাঢ্য। সাফল্যের অজস্র পালক দিয়ে ঘেরা তার মুকুট। কত নস্টালজিয়া, গত গল্পগাথা, কত কিংবদন্তি এই ক্লাবের। অন্যদিকে কিংসের আবির্ভাব তো এই সেই দিন! ২০১৮ সালে দেশের ফুটবলের সর্বোচ্চ পর্যায়ে খেলতে আসা একটা ক্লাব ৮৭ বছরের পুরোনো এক ক্লাবের সঙ্গে এই প্রথম শিরোপার লড়াইয়ে মাঠে নামছে, এ নিয়ে এত কথাবার্তার কি আছে!
কিন্তু হাল আমলের ফুটবলপ্রেমীদের ভাবনাটা আবার অনেকটাই ভিন্ন। তাদের কাছে মোহামেডান নামটা পুরোনো দিনের গানের মতো। শুনতে ভালো লাগে, কিন্তু নতুন ভার্সন নেই। ঐতিহ্যপ্রিয় অনেক তরুণ যেমন ইউটিউবে হারানো দিনের গানের নতুন কোনো সংস্করণ খুঁজে ফেরেন, মোহামেডানও তাদের কাছে তেমনই। নতুন সংস্করণ দরকার। নতুন করে সে গানটা গাওয়া দরকার। বসুন্ধরা কিংস ক্লাবটি এখন তাদের কাছে নতুন রিলিজ হওয়া ওটিটির থ্রিলার সিরিজের মতোই। পরতে পরতে রোমাঞ্চ, নতুনত্ব। সর্বোচ্চ পর্যায়ে আবির্ভাবেই বাংলাদেশের ফুটবলে অনেক নতুনত্বের সন্ধান দিয়েছে এ ক্লাবটি।
উঁচু মানের বিদেশি ফুটবলার, আধুনিক সুযোগ-সুবিধার নিজস্ব ভেন্যু, পেশাদারত্বে মোড়ানো কাঠামো; ইতিহাস, ঐতিহ্য নিয়ে দিন কাটিয়ে দেওয়া অনেক ক্লাবের জন্যই বসুন্ধরা কিংস হয়ে এসেছে ‘জেগে ওঠার ডাক’। ২০১৮ সাল থেকে ঘরোয়া ফুটবলে চারটি প্রিমিয়ার লিগ শিরোপা, দুটি ফেডারেশন কাপ আর দুটি স্বাধীনতা কাপের শিরোপা তো আছেই, আন্তর্জাতিক ক্লাব ফুটবলেও এ দলটির চোখ অনেক দূর বিস্তৃত।
২০২০ থেকে এএফসি কাপ নিয়ে তাদের স্বপ্ন সেটিই বলছে, তারা পেরেছে কি পারেনি, সেটি ভিন্ন প্রসঙ্গ। কিন্তু লক্ষ্যে, পথচলায় তারা মোহামেডান, আবাহনীর মতো দেশীয় ফুটবল ‘ব্র্যান্ড’গুলোকে যে যোজন ব্যবধানে পেছনে ফেলেছে, সেটি স্পষ্টই। ঘরোয়া ফুটবলে একচ্ছত্র আধিপত্য দেখানো কিংসকে গত পাঁচ বছরে অন্য ক্লাবগুলো খুব কমই চ্যালেঞ্জ জানাতে পেরেছে। একমাত্র আবাহনী লিমিটেডই হয়তো ধারে-ভারে কিংসের প্রধান প্রতিদ্বন্দ্বী হতে পেরেছে।
মোহামেডান দৃশ্যপটে ছিল না অনেক বছর। ঘুরে দাঁড়ানোর প্রবল প্রচেষ্টার মধ্যেই মোহামেডান ইদানীং কিংসের সঙ্গে আরও একটি আনন্দময় দ্বৈরথের ক্ষেত্র তৈরি করছে। এর মধ্যেই স্বাধীনতা কাপ ফুটবলের ফাইনালে কিংসের সঙ্গে মোহামেডানের শিরোপা-যুদ্ধ এ প্রজন্মের ফুটবলপ্রেমীদের ভিন্ন এক আমেজই উপহার দিচ্ছে।
মোহামেডানের ঘুরে দাঁড়ানোর পালাটা শুরু হয়েছে আসলে এ বছরই। মে মাসে আবাহনীকে ধ্রুপদি এক ফাইনালে হারিয়ে ১৪ বছর পর ফেডারেশন কাপ জয় করে সাদাকালো শিবির। নির্ধারিত ও অতিরিক্ত সময়ে ৪-৪ গোলে অমীমাংসিত ম্যাচটি মোহামেডান জেতে টাইব্রেকারে। সেই ফাইনালে ওঠার ইতিহাসটাও দুর্দান্ত।
সেমিফাইনালে প্রবল পরাক্রমশালী কিংসকে ২-১ গোলে হারিয়েই শিরোপা নির্ধারণী মঞ্চে উঠেছিল মোহামেডান। পেশাদার যুগে এখন পর্যন্ত বাংলাদেশ প্রিমিয়ার ফুটবল লিগ জিততে পারেনি একটা সময় দ্বিতীয় হওয়াটাই ছিল যাদের ব্যর্থতা, সেই মোহামেডানই। এ বছর ফেডারেশন কাপ জয় যেন ঐতিহ্যবাহী এ দলটিকে নতুন করে জাগিয়ে তুলেছে। তাই এবারের স্বাধীনতা কাপের ফাইনালে কিংসের প্রতিপক্ষ যখন মোহামেডান, তখন সেটি ফুটবলপ্রেমীদের নতুন এক রোমাঞ্চে আলোড়িত করছে। দুই দলের মুখোমুখি লড়াইয়ের পরিসংখ্যানে মোহামেডান যদিও পিছিয়ে, কিন্তু কিংসের বিপক্ষে একেবারে একপেশেও নয়। ফেডারেশন কাপের সেমিফাইনালে তো বটেই, ২০২০ সালের প্রিমিয়ার লিগে এই কিংসকেই ১–০ গোলে হারানোর রেকর্ড আছে মোহামেডানের।
মাঝেমধ্যে শক্তিধর দলের বিপক্ষে আন্ডারডগের লড়াইটাও আকর্ষণীয় হয়ে ওঠে। ফেডারেশন কাপের ফাইনালই তার প্রমাণ। সেদিন মোহামেডানের বিপক্ষে আবাহনী শক্তিতে এগিয়ে ছিল অনেকটাই। কিন্তু তারপরও মোহামেডানের কাছে হেরেছিল তারা। কিংসের বিপক্ষেও মোহামেডানের প্রেরণা সেই ম্যাচটিই। মোহামেডানের চেয়ে কিংস এগিয়ে শক্তিতে ও সামর্থ্যে। বিদেশি খেলোয়াড়েরা দুর্দান্ত। রবসন দা সিলভা, মিগুয়েল ফেরেইরা, দরিয়েলতন গোমেজরা যেকোনো দলকেই ছত্রখান করে দিতে পারেন নিজেদের দিনে।
মোহামেডানেরও ভালো বিদেশি আছে। মালির সোলেমান দিয়াবাতে তো একাই ফেডারেশন কাপের ফাইনালে হারিয়েছিলেন আবাহনীকে। ইদানীং মোহামেডানের প্রধান অস্ত্র হয়ে উঠছেন উজবেকিস্তানের মোজাফফরভ। তাঁর সেট পিসগুলো চিন্তার কারণ হয়ে উঠছে মোহামেডানের প্রতিপক্ষের। রক্ষণে নাইজেরিয়ান ইমানুয়েল টনি আর মধ্যমাঠে ইমানুয়েল সানডে সহায়ক শক্তি হিসেবে মন্দ নন। কিংসের দেশি ফুটবলাররা প্রায় সবাই জাতীয় দলের। তবে মোহামেডানের দেশিরাও এ দেশের ফুটবলে একেবারেই ফেলে দেওয়ার মতো নন। কয়েকজন তো যথেষ্টই প্রতিশ্রুতিশীল। অস্কার ব্রুজোন আর আলফাজ আহমেদ—ডাগআউটে দাঁড়িয়ে বুদ্ধি আর কৌশলের খেলায় কে কতটা এগিয়ে থাকবেন, সেটিও এ ম্যাচের আরেক রোমাঞ্চকর দিক।
কিংস-মোহামেডানের এ ফাইনাল হয়তো বাংলাদেশের ফুটবলে নতুন এক দ্বৈরথেরই নিমন্ত্রণ!