যেখানে বলটা পেয়েছিলেন, ডাচদের মনে অ্যালার্ম বেল বেজে ওঠার কোনো কারণই ছিল না। গোলপোস্ট অনেক দূরে। ওখান থেকে আর কীই-বা করবেন মেসি!
যা করেছেন, তা এখন মেসি-জাদুর অনিঃশেষ ভান্ডারে সর্বশেষ সংযোজন। চোখের কোনা দিয়ে নাহুয়েল মলিনাকে দেখে দুই ডাচ ডিফেন্ডার ব্লিন্ড আর ডাইকের মাঝখান দিয়ে কম্পাসে মাপা এক পাস। তা এ আর নতুন কী! মেসি তো এমন কতই করেছেন। মেসি তো এমন করেনই।
বলতে গেলে কখনোই করেন না, এমন অনেক কিছুও করেছেন এই পাগলপারা রাতে। এটা যে আর দশটা রাতের মতো নয়। লুসাইল আইকনিক স্টেডিয়ামে যে ম্যাচটা হলো, সেটাও আর দশটা ম্যাচের মতো নয়। ফুটবলের বদলে প্রায়ই যেটি রূপ নিচ্ছিল বক্সিং ম্যাচের। একাধিকবার তো মারামারিই লেগে গেল দুই দলের মধ্যে। তা ফুটবল ম্যাচে কি আর এমন হয় না! অবশ্যই হয়, তবে খেলা শেষ হয়ে যাওয়ার পরও দুই দলের মধ্যে এমন ঘৃণা আর তিক্ততার প্রকাশ খুব কমই দেখা যায়। যা একদমই দেখা যায় না, তা হলো লিওনেল মেসির এর নেতৃত্বে থাকা।
বিশ্বকাপ ফুটবল ইতিহাসে একাধিক ম্যাচের গায়ে ‘ব্যাটল’ শব্দটা আছে। এর মধ্যে সবচেয়ে কুখ্যাত ‘ব্যাটল অব বার্ন’। ১৯৫৪ বিশ্বকাপে বার্নে ব্রাজিল আর হাঙ্গেরির কোয়ার্টার ফাইনালের শেষ বাঁশি বাজার পরও দুই দলের খেলোয়াড়েরা মারামারি করেছে। ২০০৬ বিশ্বকাপেও ‘ব্যাটল অব ন্যুরেমবার্গ’ নামে একটি ম্যাচ আছে। সেই ম্যাচেরও এক দল ছিল নেদারল্যান্ডস। প্রতিপক্ষ পর্তুগাল। ন্যুরেমবার্গের ওই ম্যাচে ৪টি লাল কার্ড আর ১৬টি হলুদ কার্ড দেখিয়েছিলেন রুশ রেফারি ভ্যালেন্টিন ইভানভ। লাল কার্ড আরেকটি বাড়তে পারত, যদি লুইস ফিগো ফন বোমেলকে মাথা দিয়ে গুঁতো দিয়েও শুধু হলুদ কার্ডে পার পেয়ে না যেতেন।
হলুদ কার্ডের সেই রেকর্ড ভেঙে দিয়েছে বলেই শুধু নয়, ম্যাচ–পরবর্তী হিংসা ও ঘৃণার উদ্গিরণের কারণেও আর্জেন্টিনা-নেদারল্যান্ডস কোয়ার্টার ফাইনাল এরই মধ্যে পরিচিতি পেয়ে গেছে ‘ব্যাটল অব লুসাইল’ নামে। ম্যাচে দুই দলেরই এতে সমানে সমান অবদান। তবে ম্যাচ শেষ হওয়ার পর শুধুই আর্জেন্টিনা। প্রতিপক্ষের দিকে তির ছোড়া থেকে শুরু করে রেফারিকে ধুয়ে দেওয়া—সবই হয়েছে আর্জেন্টিনা শিবির থেকে। বিস্ময়করভাবে এখানেও নেতৃত্বে লিওনেল মেসি।
পেনাল্টি শুটআউটে হারার চেয়ে মর্মান্তিক কিছু আর হয় না ফুটবলে। সেই শোকে কাতর ডাচ খেলোয়াড়েরা কেউ মাঠে শুয়ে পড়েছেন, কেউ দুহাতে মুখ ঢেকে বসে, কেউবা শূন্য দৃষ্টিতে তাকিয়ে। আর্জেন্টিনা দলের একাংশ তখন উদ্যাপন করছে, আরেক অংশ ডাচদের মুখ ভেঙাচ্ছে। কী বলতে বলতে, তা বোঝা যায়নি।
তবে মেসি যে এক ডাচ খেলোয়াড়কে ‘এদিকে তাকিয়ে আছিস কেন, গাধা’ বলে গালি দিয়েছেন, তা পুরো বিশ্বে প্রচারিত হয়ে গেছে। কারণ, কথাটা বলেছেন তিনি টেলিভিশন ক্যামেরার সামনে। পরে জানা গেছে, ওই ডাচ খেলোয়াড়ের নাম ভাউট ভেগহোর্স্ট। দুই গোল শোধ করে সাড়ে ৬ ফুট লম্বা যে স্ট্রাইকার নেদারল্যান্ডসকে ম্যাচে ফিরিয়ে এনেছিলেন। বেচারার মেসির সঙ্গে জার্সি বদলানোর ইচ্ছা ছিল।
কিছুক্ষণ পর ম্যাচসেরা হয়ে সংবাদ সম্মেলনে এসেছেন মেসি। এই মেসিও একটু অচেনা। স্প্যানিশ রেফারির ওপর প্রচণ্ড ক্ষোভ প্রকাশ করার ভঙিটা অবশ্য দারুণ, ‘রেফারিং নিয়ে কিছু বলার সময় সত্যি কথা কঠিন। কারণ, ফিফা শাস্তি দিয়ে দেবে।’ এতেই অবশ্য যা বলার বলা হয়ে গেছে।
বিশ্বকাপের মতো টুর্নামেন্টে কোনো রেফারি ভুল করতে পারেন, তবে পক্ষপাতমূলক কিছু করবেন বলে বিশ্বাস করা কঠিন। তবে মেসির এমন তীব্র অভিযোগ শোনার পর লাহোসের সঙ্গে তাঁর পুরোনো ঝামেলার কথা মনে পড়তেই পারে কারও। ম্যারাডোনার মৃত্যুর পর তাঁকে স্মরণ করতে লা লিগায় ওসাসুনার বিপক্ষে ম্যাচে বার্সেলোনার জার্সি খুলে নিউয়েলস ওল্ড বয়েজের ১০ নম্বর জার্সি দেখিয়েছিলেন।
লাহোস আইন অনুযায়ীই মেসিকে হলুদ কার্ড দেখিয়েছেন। মেসি যথেষ্টই ক্ষুব্ধ হয়েছিলেন। এরও আগে, সেই ২০১৩-১৪ মৌসুমে আতলেটিকো মাদ্রিদের বিপক্ষে মেসির একটা ন্যায্য গোল বাতিল করে দিয়েছিলেন লাহোস। পরে ভুল বুঝতে পেরে বার্সার কাছে ক্ষমা চেয়েছিলেন বলে শোনা গেলেও মেসির রাগ পড়েনি।
সংবাদ সম্মেলন তো পরের ব্যাপার। সেখানে আসার আগে মাঠেও তো দেখা গেছে অন্য এক মেসিকে। নেদারল্যান্ডসের কোচ লুই ফন গাল এই ম্যাচের আগে একটা খোঁচা দিয়েছিলেন। যেটির মূল কথা ছিল, প্রতিপক্ষ যখন আক্রমণে যায়, মেসি তখন অলস দাঁড়িয়ে থাকে। ম্যাচের আগে এ নিয়ে এত কথা যে মনে হচ্ছিল ম্যাচটা বোধ হয় লিওনেল মেসি বনাম লুই ফন গাল।
সেটির রেশ ধরে মাঠে প্রকাশ্যে ফন গালকে জবাব দিয়ে দেবেন মেসি, এটা কারও কল্পনাতেই ছিল না। ফন গাল যাতে রীতিমতো হতভম্ব হয়ে যান। এটাকেই যথেষ্ট মনে না করে পরে বলেছেন, ফন গাল যে এত সুন্দর ফুটবল, ভালো ফুটবল বলে মুখে ফেনা তুলে ফেলেন; সেই তিনিই কীভাবে লম্বা লম্বা ফরোয়ার্ডদের নামিয়ে বক্সের মধ্যে শুধু ক্রস ফেলতে বলেন!
অতিরিক্ত সময়ে ৬ ফুট ২ ইঞ্চি আর ৬ ফুট ৬ ইঞ্চি দুই ফরোয়ার্ডকে নামিয়ে হাওয়ায় আর্জেন্টিনাকে বিপদে ফেলার এই ফন গালীয় কৌশল মাস্টারস্ট্রোকের স্বীকৃতি পাচ্ছে। এই ট্যাকটিক্যাল মুভ নিয়েও মেসির এমন তীব্র শ্লেষমাখা আক্রমণই বলে দিচ্ছে, ফন গালের ওপর কেমন রাগ হয়েছে তাঁর!
রাগ তো হতেই পারে। তবে যে মেসিকে এত দিন সবাই দেখে এসেছেন, তিনি তো রাগ-ক্ষোভ মনে রেখে দেওয়ায় বিশ্বাসী। বিতর্ক থেকে শত হস্ত দূরে থাকার নীতিতেও। এই মেসি অন্য মেসি। হয়তো অধরা বিশ্বকাপটা হাতে নিতে তীব্র আকুলতার কারণেই।