তৃতীয় বিভাগ থেকে কোপা দেল রে ফাইনাল: মায়োর্কা ও প্রাত্সের রূপকথা
ব্যালন ডি’অর জয়ের দৌড়ে তাঁরা নেই। বিশ্বসেরা হওয়ার দৌড় থেকে তাঁরা আলোকবর্ষ দূরে। কিন্তু ক্লাবের সমর্থকদের কাছে তাঁদের মূল্য যাচাই হয় সোনার মোহরে—ফুটবলে এমন খেলোয়াড়ও কিন্তু আছেন। তারকা ইমেজ নেই, আর দশজন ফুটবলারের মতোই সাধারণ, কিন্তু ক্লাব–অন্তঃপ্রাণ—সমর্থকেরা এমন ফুটবলারকে ভালো না বেসে পারেন! রিয়াল মায়োর্কার আবদন প্রাত্স তেমনই এক ফুটবলার।
স্প্যানিশ কোপা দেল রে সেমিফাইনাল ফিরতি লেগে কাল রাতে রিয়াল সোসিয়েদাদের সঙ্গে ১-১ গোলে ড্র করে মায়োর্কা। দুই লেগ মিলিয়ে ১-১ ব্যবধানে দুই দল সমতায় থাকায় খেলা গড়ায় স্নায়ুক্ষয়ী টাইব্রেকারে। সেখানে ৫-৪ ব্যবধানের জয়ে ২০০৩ সালের পর প্রথমবারের মতো এই টুর্নামেন্টের ফাইনালে উঠেছে মায়োর্কা। ফাইনালে ক্লাবটি নিজেদের ১০৭ বছরের ইতিহাসে দ্বিতীয় শিরোপার সন্ধান করবে। যেবার প্রথম শিরোপাটা এসেছিল—২১ বছর আগের সেই কোপা দেল রে ফাইনালে মায়োর্কার হয়ে জোড়া গোল করেছিলেন ক্যামেরুন ও মায়োর্কা কিংবদন্তি স্যামুয়েল ইতো।
প্রাত্স তখন ১১ বছর বয়সী কিশোর। মায়োর্কা নামের দ্বীপের রাস্তায় রাস্তায় ফুটবল খেলে বেড়াতেন। ইতোর সেই জোড়া গোল প্রাত্সের চোখ খুলে দিয়েছিল। তাঁর চাচা টনি মায়োর্কার গোলকিপার ছিলেন। ইতোর সেই গোলের পর থেকেই প্রাত্স স্বপ্ন দেখেছেন, একদিন মায়োর্কার হয়ে খেলবেন। বাকিটা নিশ্চয়ই আপনার জানা। বয়সভিত্তিক দল থেকে মায়োর্কার রিজার্ভ দল (বি) ও মূল দলে খেলে বছর দুয়েকের জন্য ঠিকানা পাল্টেছিলেন প্রাত্স। ২০১৭ সালে ফিরে আসেন নিজের জন্মশহরের এই ক্লাবে। ৩১ বছর বয়সী এই ফরোয়ার্ডকে সেমিফাইনাল ফিরতি লেগে মাঠে দেখা যায়নি। স্কোয়াডেই ছিলেন না।
কিন্তু ব্রিটিশ সংবাদমাধ্যম ‘গার্ডিয়ান’–এর লাইনগুলো পড়লে বোঝা যায়, প্রাত্সের মাঠে নামা কিংবা না নামায় আসলে কিছু যায়–আসে না। তিনি এরই মধ্যে ‘রিয়াল মায়োর্কার আল্টিমেট কাল্ট হিরো। দ্বীপটির একজন আইকন। যে ক্লাবের তিনি সমর্থক, সেই ক্লাবকেই তৃতীয় বিভাগ থেকে প্রথম বিভাগে তুলেছেন, এখন গত দুই দশকেরও বেশি সময়ের মধ্যে প্রথম ফাইনালের দেখা পাইয়ে দেওয়ার অপেক্ষায় আছেন।’
সেমিফাইনাল ফিরতি লেগের আগে তাঁকে নিয়ে লেখাটা প্রকাশ করেছিল গার্ডিয়ান। গত ২৪ জানুয়ারি কোয়ার্টার ফাইনালে প্রাত্সের জোড়া গোলে জিরোনাকে ৩-২ ব্যবধানে হারিয়ে সেমিফাইনালে উঠে এসেছিল মায়োর্কা। এরপর দ্বীপটিতে উৎসব হয়েছে এবং লোকজন সেখানে কী করেছে, সেটা বোঝা যায় প্রাত্সের কথায়, ‘কার্নিভ্যালে লোকজন আমার সাজে গিয়েছিল। নকল গোঁফ কিংবা রং করে নকল গোঁফ বানিয়ে কার্নিভ্যালে গিয়েছেন অনেকেই।’ ওহ, বলাই হয়নি, প্রাত্সকে দেখে ব্রাজিলিয়ান কিংবদন্তি রিভেলিনোকেও মনে পড়তে পারে। দুজনেরই যে দশাসই গোঁফ আছে!
মায়োর্কার মানুষ প্রাত্সের এই গোঁফকে ভালোবাসে। রক্তমাংসের মানুষটিকে তো বটেই! প্রাত্সের নিজের কাছে মায়োর্কার সঙ্গে তাঁর সম্পর্কটা এককথায় ‘ভালোবাসার গল্প’।
একাডেমি থেকে ২০১২ সালের এপ্রিলে মায়োর্কার মূল দলে সুযোগ পেয়েছিলেন প্রাত্স। অভিষেক হয় লা লিগাতেও। কিন্তু সেটা মাত্র এক ম্যাচের জন্য। এরপর ক্লাবটির হয়ে তাঁর লা লিগায় ফিরতে সময় লেগেছে ৭ বছর—তখন ক্লাবে যোগ দিয়েছিলেন তৃতীয় মেয়াদে। এ সময়ের মধ্যে বার্হোসে ধারে খেলেছেন। দ্বিতীয় বিভাগে টেনেরিফ, মিরান্দেস ও রেসিংয়েও খেলেছেন। এরপর ২০১৭ সালে এল মাহেন্দ্রক্ষণ। আবারও মায়োর্কায় যোগ দেওয়ার ডাক পেলেন প্রাত্স। এমন নয় যে শৈশবের ভালোবাসার ক্লাবে ফিরতে নিজেকে তিনি তৈরি করেছিলেন। মায়োর্কা সে সময় স্পেনের তৃতীয় বিভাগে নেমে গিয়েছিল।
ভালোবাসার টানে প্রাত্স এক ধাপ নিচে নামতে কার্পণ্য করেননি। ফিরে যান মায়োর্কায় এবং তৃতীয় বিভাগে প্রথম মৌসুমেই সর্বোচ্চ গোলদাতা হয়ে ক্লাবকে দ্বিতীয় বিভাগে টেনে তোলেন। পরের বছর প্লে–অফে দারুণ এক গোলে মায়োর্কাকে উন্নীত করেন লা লিগায়। কিন্তু ২০১৯-২০ মৌসুমে আবারও অবনমন হয় মায়োর্কার এবং প্রাত্স আবারও কেঁচে গণ্ডূষ করেন—অর্থাৎ, দ্বিতীয় বিভাগ থেকে দলকে টেনে তোলেন লা লিগায় এবং সে মৌসুমে আবারও সর্বোচ্চ গোলদাতা হন। ২০২২ সালে রায়ো ভায়োকানোর বিপক্ষে যোগ করা সময়ে তাঁর গোলে লা লিগায় টিকে থাকা নিশ্চিতও হয় মায়োর্কার।
প্রাত্স ফুটবলের বাইরেও আরেকটি কাজ করেন—মৃৎশিল্প। এ জন্য সময় বের করে তাঁকে ক্লাসও করতে হয়, ‘সামনে কিছু প্রজেক্ট আছে। এগুলো শেষ করতে হবে। সেখানে (ক্লাসে) দুই ঘণ্টার জন্য আমি সবকিছু ভুলে যাই। এটা অনেকটাই থেরাপির মতো—যে ব্যাপারটা আমি চার-পাঁচ বছর আগে আবিষ্কার করি। আমি প্লেট, মোমদানি, বাটি ও মগ বানাই।’ জানতে চাওয়া হয়েছিল রিয়াল মায়োর্কার জন্য কিছু বানাতে পারবেন? প্রাত্স হেসে বলেন, ‘ব্যাজটা বানাতে পারব কি না, জানি না। তবে লাল-কালো রঙের একটা বানিয়ে দিতে পারি। নিজের বানানো জিনিস ব্যবহার করতে আমি ভালোবাসি। নিজের বানানো মগে সকালবেলা কফি খেতে ভালো লাগে।’
প্রাত্স বড় তারকা না হতে পারেন। কিন্তু মায়োর্কাকে যেভাবে ভালোবাসেন, তা সত্যিই অনুকরণীয়। সেমিফাইনাল ফিরতি লেগের আগে বলেছিলেন, ‘মায়োর্কা স্পেনের মানচিত্রে ফিরেছে ঠিকই, তবে আমরা ফাইনালে উঠতে পারলে এবং (চ্যাম্পিয়ন হয়ে) ইউরোপিয়ান প্রতিযোগিতায় অংশ নিতে পারলে বিশ্বের মানচিত্রেও ফিরতে পারব।’
সত্যিই কাল্ট হিরো হলে এমনই হতে হয়!