একটা গল্প দিয়ে লেখাটা শুরু করা যাক।
১৯৮৮-৮৯ মৌসুমের ইউরোপিয়ান কাপ সেমিফাইনালে মুখোমুখি হয়েছিল রিয়াল মাদ্রিদ ও এসি মিলান। সে সময়ের দুই ফুটবলীয় পরাশক্তির লড়াই নিয়ে উত্তেজনায় কাঁপছিল গোটা ইউরোপ। জয়ের জন্য মরিয়া দুই দলই। যে কারণে ম্যাচের আগে প্রতিপক্ষ এসি মিলানের কৌশল বুঝতে গোপনে একজন স্কাউটকে গুপ্তচর হিসেবে অনুশীলন মাঠে পাঠায় রিয়াল। কিন্তু মিলানের অনুশীলন দেখে হতভম্ব সেই গুপ্তচর। ফিরে এসে বিস্মিত সেই গুপ্তচর দলকে জানায়, মাঠজুড়ে পুরো স্কোয়াড ম্যাচ অনুশীলন করছিল, কিন্তু তাদের পায়ে কোনো বল ছিল না।
ফুটবলীয় কৌশলের ইতিহাসে এটি পরে `শ্যাডো প্লে’ হিসেবে পরিচিতি পেয়েছিল। সেবার সেমিফাইনালে দুই লেগ মিলিয়ে মিলানের কাছে ৬-১ গোলে বিধ্বস্ত হয়েছিল রিয়াল। ম্যাচটা মিলান মাঠে নয়, জিতেছিল মাঠের বাইরে। সেই অনুশীলনেই। ফুটবলে কৌশল কতটা গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠতে পারে তা-ও বোধ হয় এই গল্পতেই অনেকটা পরিষ্কার। এই খেলাটি শেষ পর্যন্ত দুজন মানুষের মস্তিষ্কের লড়াই, যার মীমাংসা অনেক সময় মাঠের বাইরেই হয়ে যায়, দুই দলের ড্রেসিংরুমে কিংবা ডাগআউটে।
কে জানে, এবার সেমিফাইনালের আগে রিয়ালের অনুশীলন দেখতে বায়ার্ন কোচ টমাস টুখেল কোনো গুপ্তচর পাঠিয়েছেন কি না! পাঠালে তা মোটেই অস্বাভাবিক কিছু হবে না, অন্তত চ্যাম্পিয়নস লিগে রিয়ালের আগের ম্যাচটির পর টুখেল তেমন কিছু ভাবলেও ভাবতে পারেন। একটা ম্যাচ জেতার জন্য কৌশলগতভাবে যতটা বদলানো সম্ভব, ম্যানচেস্টার সিটির বিপক্ষে কোয়ার্টার ফাইনালে ততটাই বদল নিয়ে এসেছিলেন আনচেলত্তি।
ইতিহাদে ৯০ মিনিট ধরে অবিশ্বাস্য এক ডিফেন্সিভ-মাস্টারক্লাস উপহার দিয়েছিলেন রিয়ালের এই ইতালিয়ান কোচ। আগেরবার সিটির মাঠে বিধ্বস্ত হওয়ার ঘটনা থেকে শিক্ষা নিয়েই রক্ষণে অভেদ্য এক দুর্গ তৈরি করেছিলেন আনচেলত্তি। হ্যাঁ, এমন কৌশলে ম্যাচ জেতার জন্য কিছুটা ভাগ্যের ছোঁয়াও লাগে, যেটা তিনি ঠিকই পেয়েছেন। যাকে কেউ চাইলে চ্যাম্পিয়নস লিগে রিয়ালের ‘চ্যাম্পিয়ন’স লাক’ও বলতে পারে। অবশ্য বলা হয়ে থাকে, ভাগ্য নাকি সাহসীদের পক্ষে থাকে। সিটির মতো দলের বিপক্ষে অলআউট রক্ষণ-দুর্গ দাঁড় করানো শুধু সাহস নয়, রীতিমতো দুঃসাহসই বটে।
প্রশ্ন হচ্ছে, বায়ার্নের বিপক্ষে আজ রাতে কোন কৌশলে দলকে খেলাবেন আনচেলত্তি? এখানেই অবশ্য রাজ্যের নীরবতা! অনেকটা সাচ্চির সেই ‘শ্যাডো প্লে’র মতো কিছু, যা নিয়ে আগাম কোনো ধারণা দেওয়া যায় না। তবে দলটি যেহেতু সিটির জায়গায় বায়ার্ন তাই কৌশল যে আগের ম্যাচের মতো হবে না, তা বলাই যায়।
বায়ার্ন মিউনিখ অদ্ভুত এক মৌসুম পার করছে এবার। ১১ বছর পর কোনো ধরনের প্রতিদ্বন্দ্বিতা ছাড়াই বায়ার লেভারকুসেনের হাতে তুলে দিয়েছে বুন্দেসলিগার রাজত্ব। ঘরোয়া ফুটবলে এ মৌসুমে শূন্য হাতেই থাকতে হবে দলটিকে। এমন ব্যর্থতায় মৌসুম শেষে কোচ টুখেলের বিদায়ও নিশ্চিত হয়ে আছে। দলটির কাছ থেকে সমর্থকদের এবার আর কোনো বিশেষ চাওয়া-পাওয়াও নেই। ফলে এ মৌসুমে বায়ার্নের আসলেই হারানোর নেই কিছুই।
এমন পরিস্থিতি সামনে রেখে এর আগে শেষ আটে আর্সেনালের মুখোমুখি হয়েছিল বায়ার্ন। এ মৌসুমে ইংল্যান্ডের অন্যতম সেরা দলকে হারিয়েই সেমির টিকিট পেয়েছে মিউনিখের ক্লাবটি। তবে চ্যাম্পিয়নস লিগে রিয়াল ও আর্সেনাল যে একেবারেই ভিন্ন দুটি দল তা নিশ্চয়ই টুখেলের ভালোই জানা। হাড্ডাহাড্ডি লড়াইয়ের কারণে সমর্থকেরা এ দুদলের লড়াইকে ‘ব্ল্যাক বিস্ট’ বলে ডাকলেও সাম্প্রতিক সময়ে লড়াইটা জমেছে কদাচিৎ। গত এক দশকে তিনবার মুখোমুখি হয়ে একবারও রিয়ালকে হারাতে পারেনি বায়ার্ন। আর তিনবারই শেষ পর্যন্ত শিরোপা জিতেছে রিয়ালই। সামগ্রিকভাবে ২৬ ম্যাচে মুখোমুখি হয়ে রিয়ালের জয় ১২টিতে এবং বায়ার্নের ১১টিতে।
রিয়াল যেমন আর্সেনাল নয়, তেমনি বায়ার্নও কিন্তু সিটি নয়। গার্দিওলা ও টুখেলের দল কৌশল ও দর্শনগত দিক থেকে সম্পূর্ণ ভিন্ন দুটি দল। গার্দিওলার মতো পজেশন ধরে রেখে ‘ফিলোসফিক্যাল’ ফুটবলে বিশ্বাসী নন টুখেল। নিখুঁত ফুটবল কিংবা বলের পজিশন নিয়েও এই জার্মান কোচের তেমন কোনো মাথাব্যথাও নেই। কোয়ার্টার ফাইনালে দুই লেগ মিলিয়ে আর্সেনালের ১১২ শতাংশ বল পজেশনের বিপরীতে বায়ার্নের দখলে বল ছিল ৮৮ শতাংশ। সেমিফাইনালেও বলের পজিশন রিয়ালকে রাখতে দিয়ে আকস্মিক প্রতি-আক্রমণে ‘লস ব্লাঙ্কোস’ রক্ষণকে কাঁপিয়ে দেওয়ার পথ নিতে পারে বায়ার্ন।
বায়ার্নের সম্ভাব্য এ কৌশলকে তুলনা করা যেতে পারে দাবার বোর্ডে কিংবদন্তি দাবাড়ু মিখাইল তালের ‘স্যাক্রিফাইস’ কৌশলের সঙ্গে। নিজের কৌশল নিয়ে তাল একবার বলেছিলেন, ‘দুই ধরনের স্যাক্রিফাইস আছে। একটি হচ্ছে যা সঠিক এবং অন্যটি আমার নিজের।’ রিয়ালের বিপক্ষেও একইভাবে পজেশন বলি দিয়ে ম্যাচটা জেতার দিকেই মনোযোগ দিতে পারে বায়ার্ন।
কারণ, শেষ পর্যন্ত পজেশন, শট কিংবা পাসিংয়ের সংখ্যা নয় ম্যাচটা জিততে হবে গোল করে। ফলে রিয়ালের পায়ে বল তুলে দিয়ে টুখেল যদি তাদের ক্লান্ত করার কৌশল নেন, তা মোটেই বিস্মিত হওয়ার মতো কিছু হবে না। আর্সেনালের বিপক্ষে এই কাজটাই করেছিল তারা। আর ম্যাচ জেতার জন্য এমন কোনো কাজ নেই যা টুখেল করবেন না। বায়ার্নে নিজের ছাপ রেখে যাওয়ার এবং জবাব দিয়ে যাওয়ার এ সুযোগ নিশ্চয়ই হেলায় হারাতে চাইবেন না তিনি।
পাশাপাশি সিটিকে হারানোর কৌশলে যে বায়ার্নের বিপক্ষে খেলার সুযোগ নেই, সেটা অজানা নেই আনচেলত্তি। সিটির মতো মুখস্থ কৌশলের ফুটবল বায়ার্ন কখনোই খেলবে না। যেকোনো বিশৃঙ্খল পরিস্থিতির সুবিধা নেওয়ার মতো খেলোয়াড়ও তাদের মজুত আছে। তা ছাড়া বক্সের ভেতর বায়ার্নকে জড়ো হতে দেওয়াটা রীতিমতো মারণঘাতী হতে পারে রিয়ালের জন্য।
মনে রাখা ভালো, এই মুহূর্তে ইউরোপের সবচেয়ে বিধ্বংসী গোলস্কোরারটি খেলেন বায়ার্নের হয়ে। হ্যাঁ, হ্যারি কেইনের কথাই বলা হচ্ছে। দলগতভাবে সাফল্য না পেলেও গোল করায় কেইন এ মৌসুমেও অপ্রতিরোধ্য। তাঁর সঙ্গে জামাল মুসিয়ালা-লেরয় সানে-থমাস মুলাররা তো আছেনই। রিয়াল রক্ষণকে তাই বিরামহীন মার্কিং করে যেতে হবে। ফলে মাঝমাঠের দখলে রাখাটাই বরং রিয়ালের জন্য ফলপ্রসূ হতে পারে। যেখানে মূল দায়িত্ব থাকবে জুড বেলিংহামের ওপর।
একই সঙ্গে টনি ক্রুস-লুকা মদরিচের অভিজ্ঞতাও পার্থক্য গড়ে দিতে পারে ম্যাচটিতে। বড় ম্যাচে কীভাবে ম্যাচ বদলে দিতে হয়, সেটা এ দুজনের চেয়ে ভালো আর কে জানে। এ ম্যাচে নিজেদের সেরাটা খেলতে হবে ভিনিসিয়ুস জুনিয়র এবং রদ্রিগোকেও। ম্যাচের ফল নিজেদের পক্ষে আনতে রিয়ালের দুই উইংকেও একই সঙ্গে কার্যকর হয়ে উঠতে হবে।
খেলোয়াড়দের ভূমিকা যতই বড় হোক না কেন, এই ম্যাচে বায়ার্নের সবচেয়ে বড় ভয়ের নাম আনচেলত্তি। ডাগআউটে উচ্ছ্বাসহীন-গোমড়ামুখো এই মানুষটি যেন চোখের ইশারাতেই বদলে দিতে পারেন ম্যাচের গতি-প্রকৃতি। কে জানে, আজ রাতের জন্য গোপন আস্তিনে কোন কার্ডটি লুকিয়ে ‘ডন-কার্লো’ খ্যাত এই বয়বৃদ্ধ মানুষটি। সাফল্য পেতে হলে সবার আগে এই মানুষটিকেই নিষ্ক্রিয় করতে হবে টুখেলকে। সেটি করতে পারলে বাভারিয়ানদের কাজের অর্ধেকটাই সম্ভবত সম্পন্ন হয়ে যাবে। টুখেলের দল কাজটি করতে পারবে কি না, সে উত্তর পেতে ম্যাচ পর্যন্ত অপেক্ষা করা যাক তবে। উত্তাপের এ ‘ইউরোপিয়ান ক্লাসিকো’তে অবশ্য শেষ পর্যন্ত যেই জিতুক, ফুটবল-রোমান্টিকদের চাওয়া থাকবে রুদ্বশ্বাস এক পয়সা উশুল ম্যাচের।