এবার অপমানে কাঁদলেন সাবিনা-মাসুরারা
‘বিষয়টা আত্মসম্মানের’—এটুকু বলেই কান্না আটকাতে না পেরে মাথা নুইয়ে ফেললেন সাবিনা খাতুন। পেছনে দাঁড়িয়ে চোখ মুছতে মুছতে নিজের কথাগুলো বললেন মাসুরা পারভিন। দলা পাকিয়ে ওঠা কান্না আটকে জানালেন, ‘আমরা আসলে চেয়েছিলাম ফুটবলের সঙ্গে থাকতে, যদি আপনাদের সমস্যা হয় আমরা চলে যাব।’
সাবিনা-মাসুরা-ঋতুপর্ণারা আগেও কেঁদেছেন। দেশকে দুইবার সাফ শিরোপা এনে দেওয়ার পথে সাফল্যের আনন্দে চোখ ভিজিয়েছেন কতবার। তখন তাঁদের সঙ্গে আনন্দে কেঁদেছে দেশের মানুষও। খেলাধুলায় আকস্মিক সাফল্য পাওয়া দেশটাকে নিয়মিত সাফল্যের স্বাদ কেমন হয়, সেটা বুঝিয়েছিলেন এই মেয়েরা।
কিন্তু আজ বাফুফে ভবনের নিচে সন্ধ্যার আলো-আঁধারিতে তাঁরা আবার কাঁদলেন। নাহ, এই কান্না সাফল্যের নয়, নয় শিরোপা জয়েরও। তাঁদের এই কান্না অপমানের, মর্যাদাক্ষুণ্নের কান্না। সেই অপমানের ভার এতটাই অসহনীয় যে প্রয়োজনে খেলা ছেড়ে দেওয়ার সিদ্ধান্ত জানাতেও দ্বিধাবোধ করলেন না তাঁরা।
কিন্তু কী সেই অপমান? আজ বৃহস্পতিবার সন্ধ্যার অভিযোগগুলো শোনার আগে আরেকটু পেছনে যাওয়া যাক। গত অক্টোবরে বাংলাদেশ নারী ফুটবল দল যখন নেপালে শিরোপা ধরে রাখার মিশনে ছিল, তখনই বোমা ফাটান মিডফিল্ডার মনিকা চাকমা। প্রথম আলোর সঙ্গে আলাপের সময় জানান, কোচ পিটার বাটলার সিনিয়র খেলোয়াড়দের পছন্দ করেন না। এরপর টুর্নামেন্ট চলাকালে জল ঘোলা হয়েছে অনেক।
বাংলাদেশ দল শিরোপা ধরে রাখার পর কোচ নিজেই জানান, তিনি আর নারী দলের সঙ্গে কাজ করতে চান না। কিন্তু দুই পক্ষের অস্বস্তি ও অসন্তুষ্টির পরও বাফুফে বাটলারকে নারী দলের কোচ হিসেবে রেখে দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেয়। এই সিদ্ধান্তকে ঘিরে গতকাল বুধবার থেকে উত্তপ্ত দেশের ফুটবল। কাল থেকে শোনা যায়, বাটলারের সঙ্গে দুই বছরের চুক্তির প্রতিবাদে ‘বিদ্রোহ’ করেছেন ফুটবলাররা। বিপরীতে অনড় অবস্থান নেয় বাফুফেও। স্পষ্টভাবে জানিয়ে দেয়, ‘কোনো কথা চলবে না।’
স্বাভাবিকভাবে এমন কর্তৃত্বমূলক আচরণ মানতে পারেননি নারী ফুটবলাররা। আজ দুপুরেই তাঁরা জানান, বিকেলে চিঠি দিয়ে বাফুফেকে তাঁরা নিজেদের অবস্থানের কথা জানাবেন। তবে নিজেদের কথাগুলো কেবল চিঠিতেই সীমিত রাখেননি ফুটবলাররা। মাগরিবের পর বাফুফে ভবনের নিচে নিজেদের প্রতি হওয়া অপমান ও অন্যায় নিয়ে কথা বলেছেন সাবিনা-মাসুরারা। কথা বলতে বলতে প্রতি মুহূর্তে আবেগতাড়িত হয়েছেন। কীভাবে বাটলারের কাছে পদে পদে অপদস্থ হয়েছেন সেসবও তুলে ধরেছেন দেশকে পরপর দুইবার দক্ষিণ এশিয়ার শ্রেষ্ঠত্বের মর্যাদা এনে দেওয়া এই মেয়েরা।
মাঠে লড়াই করে যে মেয়েরা দেশের মর্যাদাকে উঁচুতে তুলেছেন, সেই মেয়েরা নিজেদের আত্মমর্যাদার প্রশ্নেও আপসহীন। যদি কোচকে না সরানো হয় তবে কী সিদ্ধান্ত নেবেন জানতে চাইলে কান্না ও আবেগ সামলে সাবিনার স্পষ্ট উচ্চারণ, ‘আমরা কোচকে সম্মান জানিয়ে নিজেদের সম্মান নিয়ে এখান থেকে চলে যাব।’ কোচকে নিয়ে নিজেদের অস্বস্তির কথা জানাতে গিয়ে সাবিনা আরও যোগ করেন, ‘এখানে আসলে নিজেদের প্রমাণ করার কিছু নেই। সব কিছু আসলে বলে বলে বোঝানো যায় না। আমরা কোনো কিছু নিয়ে অভিযোগ করছি মানে সেখানে কিছু একটা আছে। আমরা সেই জায়গাটাতে স্বস্তি পাচ্ছি না।’
নেপালে দ্বিতীয়বার শিরোপা জেতার পরই মূলত বাটলারকে রেখে দেওয়ার ব্যাপারে অনড় অবস্থান নেয় বাফুফে। কিন্তু সাবিনার মতে গত ১০ বছরে এই দল এমন জায়গায় পৌঁছেছে, যে কাউকে ডাগআউটে দাঁড় করিয়ে দিলে সাফল্য এনে দেওয়া সম্ভব, ‘মেয়েরা এখন যে অবস্থায় আছে, সেখানে সবচেয়ে বড় অবদান ফেডারেশনের। ১০ বছর তারা এক জায়গায় রেখেছে বিধায় মেয়েদের পারফরম্যান্স এখন এ পর্যায়ে এসেছে। আমি এতটুকু নিশ্চয়তা দিতে পারি যে দক্ষিণ এশিয়ার মধ্যে আপনি যে কাউকেই ডাগআউটে দাঁড় করিয়ে দেন, মেয়েরা দেশের জন্য রেজাল্ট এনে দেবে।’
এতটুকু নিশ্চয়তা দিতে পারি যে দক্ষিণ এশিয়ার মধ্যে আপনি যে কাউকেই ডাগআউটে দাঁড় করিয়ে দেন, মেয়েরা দেশের জন্য রেজাল্ট এনে দেবে।সাবিনা খাতুন, অধিনায়ক, নারী ফুটবল দল
কোচ বিতর্ক সামনে আসার পর সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে আক্রমণের লক্ষ্যবস্তু হয়েছেন মেয়েরা। বিষয়টিকে দুঃখজনক মন্তব্য করে সাবিনা বলেছেন, ‘সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে মেয়েদের নিয়ে যা লেখা হচ্ছে, সেটা আমরা ডিজার্ভ করি কি না আমরা জানি না। তারপরও দেশের মানুষ হচ্ছে সবার আগে। তারা যদি মনে করে আমরা সিন্ডিকেট করছি কিংবা দেশের ফুটবলকে নষ্ট করছি, তাহলে আমরা দেশের মানুষের জন্য তারা যেটা চায় আমরা সেটাই করব। আমাদের ফুটবল ফেডারেশনের প্রেসিডেন্ট আছেন, আমরা ওনার সঙ্গে বসতে চাই। এই একটা বিষয় নিয়ে এত হট্টগোল হোক, সেটা আমরা চাই না।’
এরপর খেলোয়াড়েরা একে একে কোচের বিরুদ্ধে নিজেদের অভিযোগগুলো জানাতে শুরু করেন। দুইবারের সাফ সেরা গোলরক্ষক রূপনা চাকমাকে উচ্চতার জন্য কটাক্ষ করা, মেয়েদের ব্যক্তিগত জীবনে হস্তক্ষেপ, টুপি পরে খেতে বসায় দল থেকে বাদ দেওয়াসহ বেশ কিছু অভিযোগ এ সময় সামনে আনেন মাসুরা-ঋতুপর্ণারা।
কোচকে নিয়ে নিজের আপত্তির কথা জানিয়ে মাসুরা বলেছেন, ‘আমরা এই কোচের ব্যাপারে অনেকবার বলেছি। তারা কোনো পদক্ষেপ নেয় নাই। তার সঙ্গে যে চুক্তি হইছে, তারা কি একবারও ভাবে নাই মেয়েগুলো কেন এই কথাগুলো বলছে! আসলে তাদের কী সমস্যা। খেলব কিন্তু আমরা। যে আঘাত পায়, সেই বোঝে আঘাতটা কত বড়। আপনারা বুঝবেন না।’
একটা ফুটবল দল মূলত একটা পরিবার। যেখানে অভিভাবকের ভূমিকা পালন করেন একজন কোচ। সেই কোচকে নিয়ে এত অভিযোগ ও আপত্তির পরও কেন এভাবে রেখে দেওয়া? বিষয়টা কতটা যন্ত্রণার সেটা জানিয়ে মিডফিল্ডার সানজিদা আক্তার বলেছেন, ‘আপনারা পরিবারের কথা চিন্তা করেন। একটা সংসারে আপনি যখন মানসিক শান্তিটা পাবেন না, তখন আপনার কেমন লাগবে? কোথাও কি আপনি কাজ করতে পারবেন? আমাদের সঙ্গেও সেটাই হচ্ছে। মানসিক শান্তিটা আমরা পাচ্ছি না। তাইলে মাঠে আমরা শতভাগ কীভাবে দেব?’
দেশসেরা এই ফুটবলারদের মানসিক শান্তি ফেরানোর দায়িত্বটা কি এখন কেউ নেবেন?