এমএলএসে কেন মেসিদের ‘ব্যর্থ’ হওয়ার সুযোগ নেই
‘খুব সম্ভবত সে (মেসি) এখন আর চাপ নিতে চাইছে না বলেই বার্সেলোনায় ফেরেনি’—লিওনেল মেসি ইন্টার মায়ামিকে বেছে নেওয়ার পর গত জুনে এমন মন্তব্য করেছিলেন বার্সা কোচ জাভি হার্নান্দেজ। মেসির ক্যারিয়ার এ মুহূর্তে যে জায়গায় দাঁড়িয়ে, জাভির এমন ধারণা মোটেই অমূলক নয়।
ফুটবল থেকে আর কিছুই পাওয়ার নেই মেসির। ক্লাব ও আন্তর্জাতিক পর্যায়ে সম্ভাব্য সবকিছুই জিতে নিয়েছেন। মেসি নিজেও একাধিকবার বলেছেন, ফুটবলের কাছ থেকে আর কোনো প্রত্যাশা নেই তাঁর। খেলা চালিয়ে যাচ্ছেন ভালো লাগছে বলে।
নিছক আনন্দের জন্য হয়তো ছুটে গেছেন যুক্তরাষ্ট্রের মেজর লিগ সকারের (এমএলএ) ক্লাব ইন্টার মায়ামিতে। মেসি যাওয়ার আগে যুক্তরাষ্ট্র কখনোই ফুটবলের জন্য সেভাবে পরিচিত ছিল না। এমনকি দেশটির জনপ্রিয় তিন খেলার মধ্যেও ছিল না ফুটবলের নাম। গোধূলিবেলায় এমন একটি দেশে মেসি যদি চাপহীন থেকে ফুটবল খেলতে যাওয়ার কথা ভাবেন, তা মোটেই অস্বাভাবিক কিছু নয়।
ক্যারিয়ারে শেষ দিকে বেশির ভাগ তারকা খেলোয়াড় প্রতিদ্বন্দ্বিতা থেকে দূরে গিয়ে এমন নির্বিষ মঞ্চ বেছে নেন। কিন্তু নামটি যখন মেসি, তখন আর নির্ভার থাকার সুযোগ কই? গত আট মাসে মেসির প্রভাবে বদলে গেছে যুক্তরাষ্ট্রের ফুটবল এবং খেলার জগৎ। মেসির ছোঁয়ায় ‘নিরীহ’ এমএলএসও এখন পাদপ্রদীপের আলোয়। এর মধ্যে এসেছে বেশ কিছু বৈপ্লবিক পরিবর্তনও। মেসির পাশাপাশি এই লিগে এসেছেন লুইস সুয়ারেজ, সের্হিও বুসকেতস, জর্দি আলবার মতো তারকারা। এমন পরিস্থিতিতে যে চাপ থেকে মেসি বাঁচতে চেয়েছিলেন, সাফল্য লাভের সেই চাপও এসে হাজির হয়েছে।
আজ ভোরে রিয়েল সল্ট লেকের বিপক্ষে ম্যাচ দিয়ে এমএলএসে নতুন যাত্রা শুরু করবে মেসির ইন্টার মায়ামি। নতুন মৌসুমে শুধু ইন্টার মায়ামিই নয়, চাপ অনুভব করছে খোদ এমএলএসও। আজ থেকে পুরো পৃথিবীর চোখ থাকবে তাদের ওপরও। ফুটবল মঞ্চে নিজেদের মান ও সামর্থ্যের প্রমাণ দেওয়ার আছে তাদেরও।
মেসির নতুন শুরু
গত মৌসুমে মেসি যখন ইন্টার মায়ামিতে আসেন, তখন ক্লাবটি ছিল পয়েন্ট তালিকায় সবার নিচে। মেসি এসে শুরুতে অংশ নেন লিগস কাপে। এই টুর্নামেন্ট জিতিয়ে ইন্টার মায়ামিকে প্রথমবারের মতো শিরোপার স্বাদ দেন আর্জেন্টাইন অধিনায়ক। এরপর ইন্টার মায়ামিকে ইউএস ওপেন কাপের ফাইনালেও নিয়ে যান বিশ্বকাপজয়ী এই মহাতারকা।
যদিও এ প্রতিযোগিতায় শিরোপা জেতা হয়নি মায়ামির। এ দুই প্রতিযোগিতার পর এমএলএসে অসম্ভবকে সম্ভব করার চেষ্টা করেছিলেন মেসি। চেয়েছিলেন তলানি থেকে প্লে–অফে পৌঁছে দিতে। তবে চোটের কারণে সে সুযোগ পুরোপুরি পাননি আর্জেন্টাইন অধিনায়ক। মায়ামিও আর কোনো চমক দেখাতে পারেনি।
সেসব পেছনে ফেলে এবার নতুন শুরু করতে যাচ্ছেন মেসি। এরই মধ্যে যুক্তরাষ্ট্রজুড়ে শুরু হয়ে গেছে মেসি-ম্যানিয়া। টিকিট বিক্রি থেকে শুরু করে আবাসন খাত পর্যন্ত সব জায়গায় মেসির উপস্থিতির ছাপ পড়েছে। যুক্তরাষ্ট্রে মেসির উপস্থিতি কেমন প্রভাব নিয়ে এসেছে, তা ব্যাখ্যা করে কদিন আগে বাস্কেটবল কিংবদন্তি লেব্রন জেমস বলেছিলেন, ‘ফুটবলের গোট (গ্রেটেস্ট অব অল টাইম) মেসির উপস্থিতি এমএলএসকে সম্মানিত করেছে। সে আমাদের জন্য পুরোপুরিভাবে একজন গেম চেঞ্জার।’
প্রাক্–মৌসুমে সতর্কবার্তা
এমএলএসে মৌসুম শুরুর আগে প্রাক্–মৌসুম সফরকে পাখির চোখ করেছিল ইন্টার মায়ামি। তবে সেই সফর একেবারেই ভালো যায়নি তাদের। উল্টো হংকংয়ে গিয়ে মেসির না খেলা নিয়ে সৃষ্ট বিতর্ক নেতিবাচক প্রভাব ফেলেছে দলের ওপর। প্রাক্–মৌসুমে খেলা ৭ ম্যাচের মাত্র ১টিতে জিতেছে মায়ামি, হেরেছে ৪ ম্যাচে। একমাত্র জয়টি হংকং একাদশের বিপক্ষে।
সৌদি আরবে গিয়ে ক্রিস্টিয়ানো রোনালদোবিহীন আল নাসরের কাছে মেসিরা খেয়েছেন ৬ গোল। আল হিলালের বিপক্ষে হার ৪-৩ ব্যবধানে। প্রাক্–মৌসুমে অবশ্য মেসির চোটও বেশ ভুগিয়েছে দলটিকে। এরপরও প্রাক্-মৌসুমে এমন হতশ্রী পারফরম্যান্স ইন্টার মায়ামিকে বড় ধরনের সতর্কবার্তা দিচ্ছে। এখন নতুন মৌসুমের শুরুতে ব্যর্থতা ভুলে ঘুরে দাঁড়াতে না পারলে বিপদে পড়তে হতে পারে দলটিকে।
রক্ষণে দুর্বলতা
তারকাবহুল আক্রমণভাগ থাকলেও ইন্টার মায়ামির রক্ষণে দুর্বলতা স্পষ্ট। আক্রমণে বেশি মনোযোগ দিতে গিয়ে প্রায় এলোমেলো হয়ে পড়ে দলটির রক্ষণ। প্রাক্-মৌসুমে খেলা ৭ ম্যাচে তারা হজম করেছে ১৩ গোল। যেখানে দুই সৌদি ক্লাব আল নাসর ও আল হিলালের বিপক্ষেই ১০ গোল। অপেক্ষাকৃত শক্তিশালী আক্রমণভাগের বিপক্ষে ইন্টার মায়ামির রক্ষণকে খেই হারাতে দেখা গেছে। এ পরিস্থিতিতে লম্বা মৌসুমে রক্ষণ যদি ঠিকঠাক প্রতিরোধ গড়তে না পারে, তবে চাপ বাড়তে পারে দলটির ওপর।
প্রত্যাশার চাপ
প্রত্যাশার চাপের কথা আগেই বলা হয়েছে। তবে মেসির ওপর সেই চাপ একেবারেই সরলরৈখিক নয়। ফুটবলভিত্তিক সংবাদমাধ্যম ‘গোল ডটকম’ এক প্রতিবেদনে নিজের সমর্থকদের পাশাপাশি যাঁরা মেসিকে অপছন্দ করেন, তাঁদের চাপের কথাও উল্লেখ করেছে। অনেকেই চান, মেসি-মায়ামির এ প্রকল্প ব্যর্থ হোক। এমন ‘নেতিবাচক’ প্রত্যাশার চাপও উতরে যাওয়ার চ্যালেঞ্জ এখন মেসির সামনে।
সব মিলিয়ে এমএলএসের ইতিহাসে আর কোনো দল এত চাপ নিয়ে মৌসুম শুরু করেনি। এই দলের কারণে এবারের আসরটি হতে যাচ্ছে ইতিহাসের সবচেয়ে বেশি দেখা এমএলএস মৌসুম। যেখানে সবার চোখ থাকবে ইন্টার মায়ামি ও মেসির ওপর। এমন পরিস্থিতিতে মেসির যে ‘ব্যর্থ’ হওয়া চলে না!