জাবিবল—ফুটবলের কৌশলে জাবি আলোনসোর নতুন রোমাঞ্চ
ছিলেন ডিফেন্সিভ মিডফিল্ডার। নিজের সময়ে অন্যতম সেরাদের একজনও বটে। বিশ্বকাপ, ইউরো, চ্যাম্পিয়নস লিগসহ জিতেছেন সম্ভাব্য সব ট্রফিও। খেলেছেন রিয়াল মাদ্রিদ, লিভারপুল ও বায়ার্ন মিউনিখের মতো বিশ্বসেরা ক্লাবে। এরপর খেলোয়াড়ি জীবনের ইতি টেনে আসলেন কোচিং ক্যারিয়ারে। ওহ, নামটাই এখনো বলা হলো না। তিনি জাবি আলোনসো।
ঝলমলে ফুটবল ক্যারিয়ারের ইতি টেনে যিনি এখন কোচিংয়ে নিজের ছাপ রাখার চেষ্টা করছেন। ফুটবলে যাঁর এমন দখল, কোচিংয়ে তাঁকে কে আর রুখে! নাহ, ভালো খেলোয়াড় মানেই কিন্তু ভালো কোচ নন। উদাহরণ? সে–ও আছে ঢের। কোচিংয়ে এসে এখনো নিজেদের পায়ের তলায় মাটি খুঁজে বেড়াচ্ছেন স্টিভেন জেরার্ড, ওয়েইন রুনি ও ফ্রাঙ্ক ল্যাম্পার্ডরা।
একসময়ের এই সেরারা কোচ হিসেবে ক্লাব বদলাচ্ছেন ঠিকই, কিন্তু সাফল্য যেন দূরে টিমটিম করে জ্বলতে থাকা বাতিঘর। প্রশ্ন হচ্ছে, আলোনসো কি তবে সফল? যাঁর ট্রফি ক্যাবিনেট এখনো শূন্য, তাঁকে সফল বলার সুযোগ কই? কিন্তু এরপরও জেরার্ড, রুনি, ল্যাম্পার্ড এমনকি জাভি হার্নান্দেজের চেয়েও আলাদাভাবে উচ্চারিত হচ্ছে আলোনসোর নাম। কেন? কারণটা হলো ফুটবল–দর্শন।
এখনো কিছু না জেতা এই স্প্যানিশ কোচ ইউরোপিয়ান ফুটবলে নিয়ে এসেছেন কৌশলের নিজস্ব ধারা। যা হয়তো পুরোপুরি তাঁর নিজের নয়, কিন্তু এরই মধ্যে কৌশলের বাস্তবায়নে দেখিয়েছেন দারুণ মুনশিয়ানা। আর কৌশল মাঠে প্রয়োগের দক্ষতা আলোনসোকে আলাদা করেছে বাকিদের চেয়ে। এমনকি এই মুহূর্তে ইউরোপের সবচেয়ে কাঙ্ক্ষিত কোচদের একজনও সাবেক এই স্প্যানিশ ফুটবলার।
বায়ার লেভারকুসেন—ইউরোপিয়ান ফুটবলে কখনোই পরাশক্তিদের তালিকায় ছিল না। ২০০১–০২ মৌসুমে চ্যাম্পিয়নস লিগের ফাইনালে খেলাই ছিল তাদের সর্বোচ্চ অর্জন। ২০২২ সালে সেই দলটির দায়িত্ব নেন আলোনসো। এর আগে কোচিংয়ের অভিজ্ঞতা বলতে রিয়াল সোসিয়েদাদের বি দলের ডাগআউটে দাঁড়ানো। আলোনসোর লেভারকুসেনের দায়িত্ব নেওয়ার সময়টাও একেবারে পক্ষে ছিল না। সে সময় জেরার্দো সিওয়ানের অধীনে ৮ ম্যাচের মাত্র ১টি জিতে অবনমনের শঙ্কায় কাঁপছিল বুন্দেসলিগার ক্লাবটি। কিন্তু এরপরও চ্যালেঞ্জটা নেন আলোনসো। অবনমন অঞ্চল থেকে লেভারকুসেনকে টেনে তুলে তিনি নিয়ে আসেন ৬ নম্বরে।
শুরুতে অবশ্য কেউ কেউ লেভারকুসেনের এমন ঘুরে দাঁড়ানোকে আকস্মিক চমক হিসেবে দেখেছেন। কিন্তু চলতি মৌসুমে আলোনসো এরই মধ্যে বুঝিয়ে দিয়েছেন বিষয়টি মোটেই তেমন নয়। তাঁর কোচিং কৌশল কোনো তুকতাক বা কাকতাল ঘটনা নয়। নিখুঁত কৌশল, ম্যাচ সম্পর্কে বোঝাপড়া এবং নিজের সীমিত শক্তির সর্বোচ্চ ব্যবহারই আলোনসোর লেভারকুসেনকে এনে দিয়েছে অভূতপূর্ব সাফল্য।
যার ফলেই মূলত ২৮ ম্যাচ শেষে ইউরোপের শীর্ষ ৫ লিগের মধ্যে একমাত্র অপরাজিত দল লেভারকুসেন। বুন্দেসলিগার শীর্ষে থেকে যারা এখন শিরোপা স্বপ্নও দেখছে। এই স্বপ্ন দেখার আসল নায়ক আলোনসো। এখন পর্যন্ত ইউরোপিয়ান ফুটবলে লেভারকুসেনের যে দাপট, তা আলোনসোর কোচিং কৌশলেরই দান। যে কৌশল এখন এসে জাবিবল নামে আলোচিত হচ্ছে। সাম্প্রতিক সময়ে টেস্ট ক্রিকেটে ইংল্যান্ডের কৌশল ‘বাজবল’ নামে আলোচিত হয়েছে। আর এখন ফুটবলে জনপ্রিয় হচ্ছে জাবিবল।
খেলোয়াড়ি জীবনে ডিফেন্সিভ মিডফিল্ডার হিসেবে আলোনসোর কাজই ছিল নিজেদের অর্ধ থেকে নিখুঁত পাসের মধ্য দিয়ে আক্রমণের ভিত গড়ে দেওয়া। তাই কোচ হিসেবে সেই পাসকেই নিজের অস্ত্রাগারের মূল অস্ত্র হিসেবে সামনে রেখে রণকৌশল সাজাচ্ছেন আলোনসো। যদিও শুধু পাসের ওপর নির্ভর করে আলোনসো তাঁর পরিকল্পনা সাজান না। সঙ্গে আরও কিছু বিষয় যুক্ত করে রীতিমতো অভেদ্য এক দুর্গ গড়ে তুলেছেন সাবেক এই লিভারপুল তারকা।
আলোনসোর দল আক্রমণগুলো গড়ে শর্ট পাসের মধ্য দিয়ে। এ মৌসুমে বেশির ভাগ ম্যাচে গোলরক্ষকের সামনে তিনজন সেন্ট্রাল ডিফেন্ডার রেখে একাদশ সাজিয়েছেন লেভারকুসেন কোচ। ডাবল পিভট (ডিফেন্সিভ মিডফিল্ডার) হিসেবে যাদের সঙ্গে সহায়ক ভূমিকায় দেখা যায় গ্রানিত শাকা এবং এজকুয়েল পালাসিওসকে। আর এই দুজনের সঙ্গে বাঁ পাশের উইংয়ে গ্রিমাল্ডো এবং ডান পাশে প্রথম পছন্দ জেরেমি ফ্রিমপং। আর ডাবল টেন (প্লে–মেকার) হিসেবে এই চারজনের সামনে থাকেন হফম্যান ও ফ্লোরিয়ান রিটজ। আর স্ট্রাইকার হিসেবে গোল করার আলোনসোর প্রথম পছন্দ ভিক্টর বোনিফেইস। সব মিলিয়ে লেভারকুসেন ফরমেশন দাঁড়ায় ৩–৪–২–১।
নিজের পরিকল্পনাকে অক্ষুণ্ন রাখতে আলোনসো খেলোয়াড়ও খুব কম বদলান। আর বদলালেও নিজের ফরমেশনে খুব একটা পরিবর্তন আনেন না। যেমন এ মৌসুমে লিগে প্রথম ১৩ ম্যাচের ৯টিতেই একই একাদশ মাঠে নামান এ কোচ। মূলত কৌশল যেন পরিবর্তন করতে না হয়, সে জন্যই এ পথে হাঁটেন আলোনসো। তবে কৌশল বা পরিকল্পনাকে সফল বলা যায় যখন তা ঠিকঠাক বাস্তবায়ন করা হয়।
আলোনসোর আসল সফলতাও মূলত এখানেই। তাঁর দলের প্রত্যেক খেলোয়াড় জানেন তাদের কাজ কী এবং কীভাবে তা করতে হয়। এমন নয় যে পরীক্ষিত এবং হাই প্রোফাইল তারকাদের ব্যবহার করে আলোনসো সাফল্য পাচ্ছেন। বাস্তবতা হচ্ছে, এই দলের কেউই সে অর্থে বড় কোনো নাম নয়। তবে আলোনসোর দলের একেকজন খেলোয়াড় নিজেদের অনিবার্য করে তুলেছেন।
শর্ট পাসের ওপর জোর দিলেও আলোনসোর দল মোটেই শ্লথগতির ফুটবল খেলে না। বল যখন নিজেদের পায়ে থাকে তখন দুই উইংয়ের খেলোয়াড়েরা দ্রুত ওপরে ওঠে আক্রমণে নিজেদের ভূমিকা রাখেন। আবার বলের পজিশন হারালে দ্রুত নিজেদের নির্ধারিত অবস্থানে নেমে আসেন তাঁরা। আলোনসোর কৌশলে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা আছে গায়েলিক ফুটবলেরও (রাগবি ও ফুটবলের মিশ্রণে তৈরি খেলা। এই খেলায় হাত ও পা উভয়ই ব্যবহার করা হয়)। গায়েলিকের জন্য প্রয়োজন দারুণ গতিময়তা।
কৈশোরে আলোনসো নিজেও এই খেলাটি খেলেছিলেন। এই গায়েলিক ফুটবল নিশ্চিতভাবে ভূমিকা রেখেছে তাঁর কৌশলে। বলা যায়, দ্রুতগতিতে ছোট পাসে এগিয়ে গিয়ে প্রতিপক্ষ রক্ষণকে এলোমেলো করে দেওয়ায় মূলত জাবিবলকে আলাদা করে তুলেছে। অনেক সময় দেখা যায় আক্রমণে যাওয়ার সময় কয়েকজন খেলোয়াড় মিলে একটি সেট গঠন করেন।
যারা বিদ্যুৎ–গতিতে একে অপরকে পাস দিয়ে কোণঠাসা করে ফেলে প্রতিপক্ষ রক্ষণকে। যে কারণে ওপেন প্লে থেকে গোল পাওয়াও অনেক সহজ হয়। এ মৌসুমে বুন্দেসলিগায় ওপেন প্লে থেকে ২৯টি (মোট গোলের ৫৮ শতাংশ) গোল আদায় করেছে তারা। লং পাসে আলোনসোর দল কম আগ্রহী হলেও দলের প্রয়োজনে ঠিকই তারা চেষ্টা করে এটি ব্যবহারের। বলা যায়, লং পাসগুলোকে তারা মূলত লুকোনো অস্ত্রের মতো করে ব্যবহার করে।
আক্রমণই আলোনসোর কৌশলের শেষ কথা হলেও তিনি রক্ষণ নিয়ে মোটেই উন্নাসিক নন। বরং বুন্দেসলিগায় ১৯ ম্যাচ শেষে রক্ষণে সবচেয়ে সফল দল তারাই। এখন পর্যন্ত মাত্র ১৪ গোল হজম করেছে দলটি। যা কিনা বুন্দেসলিগায় সবচেয়ে কম। দ্বিতীয় স্থানে বায়ার্ন মিউনিখ হজম করেছেন ১৮ গোল। এমনকি এই ১৪ গোলের মধ্যে মাত্র ১টি গোল তারা হজম করেছে প্রতি আক্রমণ থেকে। পেনাল্টি থেকে এখন পর্যন্ত কোনো গোলই লেভারকুসেন হজম করেনি।
সব মিলিয়ে সীমিত শক্তি ও সম্পদ ব্যবহার করে শুধু কৌশল দিয়েই লেভারকুসেনকে অপ্রতিরোধ্য করে তুলেছেন আলোনসো। যা এখন ইউরোপে তাঁকে দারুণভাবে জনপ্রিয় করে তুলেছে। ফলে ইউরোপের সুপার পাওয়াররা এখন আলোনসোকে পেতে মুখিয়ে আছে। এরই মধ্যে লিভারপুল, বার্সেলোনা ও বায়ার্ন মিউনিখের পরবর্তী কোচ হিসেবে আলোনসোর নাম শোনা যাচ্ছে। যদিও এই মুহূর্তে আলোনসো সেসব কিছুই ভাবছেন না। তাঁর ভাবনাজুড়ে কেবলই লেভারকুসেন। বিদায়ের আগে দলটির হয়ে শিরোপা–স্বাদ পেতে মুখিয়ে আছেন ৪২ বছর বয়সী এ কোচ।