‘বাংলাদেশ’ নাম নিয়ে মুক্তিযোদ্ধার ইয়েমেনকে হারানোর সেই গল্প
মুক্তিযোদ্ধাকেই ‘বাংলাদেশ’ নামে পাঠিয়ে দেওয়া হয়েছিল সেবার!
দেশের ফুটবলের সর্বোচ্চ পর্যায় থেকে সম্প্রতি অবনমিত মুক্তিযোদ্ধা সংসদ ক্রীড়া চক্রের গৌরবের ইতিহাস এটি। এ প্রজন্মের অনেক ফুটবলপ্রেমীরই হয়তো অজনা এ ইতিহাস। আজ থেকে ২৯ বছর আগে কাতারের দোহায় একটি আমন্ত্রণমূলক আন্তর্জাতিক টুর্নামেন্টে মুক্তিযোদ্ধা সংসদ ক্রীড়া চক্রই খেলেছিল বাংলাদেশ জাতীয় ফুটবল দলের মোড়কে। ইয়েমেনের বিপক্ষে পেয়েছিল দারুণ এক জয়।
১৯৯৪ সালের দলবদলে মুক্তিযোদ্ধা সংসদ ক্রীড়াচক্র আবাহনী, মোহামেডান ও ব্রাদার্সের ‘জেন্টলম্যান অ্যাগ্রিমেন্ট’ ভেঙে তারকা ফুটবলারদের দলে ভিড়িয়েছিল। মোহাম্মদ মহসিন, রিজভি করিম রুমি, মামুন জোয়ার্দার, জুয়েল রানা, ইমতিয়াজ আহমেদ নকীব, সাইফুল বারী টিটু, আতাউর রহমান, মিজানুর রহমান, বরুণ বিকাশ দেওয়ান, আরমান মিয়া, মাসুদ রানা, রকিব হোসেন, আরিফ হোসেন মুনদের মতো ফুটবলার দলে নেওয়ায় ‘মাঝারি মানের’ দলটি আবির্ভূত হয়েছিল বড় শক্তি হিসেবে। তিন প্রধানের ঘর ভেঙে মুক্তিযোদ্ধায় যোগ দেওয়া প্রায় সবাই ছিলেন সে সময় জাতীয় ফুটবল দলের নিয়মিত সদস্য। ১৯৯৪ সালের সেপ্টেম্বরে কাতার ফুটবল ফেডারেশন থেকে সে দেশের ইনডিপেনডেন্স কাপে খেলার আমন্ত্রণ যখন বাফুফের কাছে আসে, তখন তারা মুক্তিযোদ্ধাকে ‘বাংলাদেশ’ হিসেবে কাতারে পাঠিয়েছিল বিনা দ্বিধায়। সে সময় ঢাকা প্রিমিয়ার ফুটবল লিগের খেলা চলছিল। এর মধ্যে আলাদা করে জাতীয় দল গঠনের ঝামেলা এড়াতেই মূলত বাফুফে এমন সিদ্ধান্ত নিয়েছিল। সেই মুক্তিযোদ্ধা দলের কোচ ছিলেন বাফুফের বর্তমান সভাপতি কাজী সালাউদ্দিন।
ক্লাব দল বিদেশে খেলতে যায়। সারা দুনিয়ায় আয়োজিত হয় ক্লাবভিত্তিক আন্তর্জাতিক প্রতিযোগিতা। কিন্তু আন্তর্জাতিক প্রতিযোগিতায় যেখানে পূর্ণাঙ্গ জাতীয় দলের খেলার কথা, সেখানে কোনো ক্লাবকে পাঠিয়ে দেওয়ার ঘটনা ফুটবল ইতিহাসে খুব বেশি কি আছে? সেটি বাংলাদেশের ফুটবলের এক নজিরবিহীন ঘটনা হিসেবেই আছে।
কাতারের স্বাধীনতা দিবস উপলক্ষে আয়োজিত হয়েছিল সেই টুর্নামেন্ট। মুক্তিযোদ্ধা (বাংলাদেশ), ইয়েমেন ছাড়াও সেই টুর্নামেন্টে খেলছিল সুদান, ভারত, ওমান ও স্বাগতিক কাতার। সেই টুর্নামেন্টে সৌদি আরব ও কুয়েতেরও খেলার কথা ছিল, কিন্তু শেষ মুহূর্তে তারা নাম প্রত্যাহার করে নেয়। বাংলাদেশের গ্রুপসঙ্গী ছিল ইয়েমেন ও ভারত।
১৯৯৩ সালের ডিসেম্বরে ঢাকায় অনুষ্ঠিত ষষ্ঠ সাফ গেমসে ব্যর্থ হয়েছিল বাংলাদেশ। মালদ্বীপের বিপক্ষে গোলশূন্য ড্র আর নেপালের কাছে হেরে দেশের মানুষকে হতাশায় ডুবিয়েছিলেন জাতীয় দলের ফুটবলাররা। কোচ ছিলেন সুইজারল্যান্ডের ওল্ডরিখ সোয়্যাব। কিন্তু সাফ গেমসের পর জাতীয় ফুটবল দলের কোনো অস্তিত্বই ছিল না। সোয়্যাবকে বিদায় করে দেওয়া হয়েছিল। জাতীয় দল বলতে কিছু না থাকলেও সে সময়ের বাফুফে সভাপতি ও সড়ক যোগাযোগমন্ত্রী কর্নেল (অব.) অলি আহমেদ কাতারের টুর্নামেন্টে খেলার প্রয়োজনীয়তা অনুভব করেছিলেন। তাই মুক্তিযোদ্ধাকেই বাংলাদেশ জাতীয় ফুটবল দল হিসেবে কাতারে পাঠিয়ে দেওয়া হয়েছিল। দলটা কাগজে-কলমে বাংলাদেশ জাতীয় দলই। তা ছাড়া ভরা মৌসুমে প্রত্যেক খেলোয়াড়ও ছিলেন খেলার মধ্যেই।
খুব অল্প দিনের নোটিশে কাতারে পাঠানো হয়েছিল মুক্তিযোদ্ধাকে। তখনকার স্মৃতি আজও জ্বলজ্বলে মুক্তিযোদ্ধা ও জাতীয় দলের সাবেক ফুটবলার সাইফুল বারী টিটুর, ‘মনে আছে লিগ চলছিল। তিন-চার দিনের একটা হালকা প্রস্তুতি নিয়ে আমরা কাতার গিয়েছিলাম। ঢাকায় আমরা খেলছিলাম বৃষ্টি-আবহাওয়ায় ভেজা ও কাদা মাঠে। কাতারে গিয়ে প্রচণ্ড গরম আর শুষ্ক মাঠ পেয়েছিলাম। ভারতের বিপক্ষে ম্যাচটা আমরা খেলেছিলাম লিগ ম্যাচ খেলার একদিন পরই। খুব ক্লান্ত ছিলাম। নকীব জোড়া গোল করলেও আমরা হারি। তবে ইয়েমেনের বিপক্ষে জিতি মিজানের গোলে।’
ভারতের বিপক্ষে প্রথম ম্যাচে দোহার সেই ম্যাচে প্রথম ২০/২৫ মিনিটেই ৩–০ গোলে পিছিয়ে পড়েছিল বাংলাদেশের মোড়কে মুক্তিযোদ্ধা। রক্ষণভাগের অমার্জনীয় কয়েকটি ভুলে ভারত গোল করে এগিয়ে গিয়েছিল। পরে নিজেদের গুছিয়ে নিয়ে খেলার চেষ্টা করেছিল দল। ইমতিয়াজ আহমেদ নকীব দুই গোল করেছিলেন। কিন্তু হার ঠেকানো যায়নি। ইয়েমেনের বিপক্ষে দ্বিতীয় ম্যাচে বেশ কয়েকটি বদল এনেই মাঠে নেমেছিল মুক্তিযোদ্ধা (বাংলাদেশ)। সবচেয়ে বড় পরিবর্তনটি ছিল গোলবারে। অভিজ্ঞ মহসিন ভারতের বিপক্ষে বাজে খেলায় ইয়েমেনের বিপক্ষে খেলানো হয়েছিল অরুণ বিকাশ দেওয়ানকে। নকীব ভুলে যাননি সেই ম্যাচটি, ‘ডিফেন্সের ভুলে যে গোলগুলো খেয়েছিলাম, সেগুলো বাজে গোল। আমি সে ম্যাচে দুটি গোল করেছিলাম। একটা অনেক উঁচুতে লাফিয়ে উঠে হেড করে, অন্যটি ভলিতে। ইয়েমেনের সঙ্গে মিজান দারুণ একটা গোল করেছিল। ইয়েমেনের বিপক্ষে ম্যাচটি আমার খেলা অন্যতম সেরা ম্যাচ। ভারতের বিপক্ষে ৪–২ গোলে না হারলে আমরা সেমিফাইনালে খেলতে পারতাম।’
নকীব দীর্ঘদিন খেলেছেন মুক্তিযোদ্ধায়। সে হিসেবে দলটির প্রতি অন্য রকম এক টান তাঁর। দেশের ফুটবলের সর্বোচ্চ পর্যায় থেকে মুক্তিযোদ্ধার নেমে যাওয়াটা কিছুতেই মেনে নিতে পারছেন না নকীব, ‘আমি খুবই শকড। মুক্তিযোদ্ধা দেশের ফুটবলের একটা বড় শক্তিই ছিল। মুক্তিযোদ্ধা লিগ জিতেছে, ফেডারেশন কাপ জিতেছে। ’৯৪–তে বড় দল হয়ে ওঠার পর অনেক দিন ঘরোয়া ফুটবলে প্রভাব ছিল দলটার। খুব খারাপ লাগছে মুক্তিযোদ্ধার দ্বিতীয় স্তরে নেমে যাওয়াটা। এই ক্লাবের সাবেক ফুটবলার হিসেবে আমি কষ্ট পেয়েছি। কয়টা ক্লাব জাতীয় দল নাম নিয়ে বিদেশের মাটিতে খেলেছে বা খেলার সুযোগ পেয়েছে? মুক্তিযোদ্ধা বাংলাদেশের ফুটবলে একটা বড় ইতিহাসই।’
১৯৮৪ সালে সর্বোচ্চ পর্যায়ে খেলা শুরু করা মুক্তিযোদ্ধার অবনমন দেশের ফুটবলের জন্যই হতাশাজনক এক ঘটনা। অনেক ইতিহাস সঙ্গে নিয়েই মুক্তিযোদ্ধা নেমে গেল দ্বিতীয় স্তরে। বিদেশের মাটিতে বাংলাদেশ জাতীয় দল হিসেবে আন্তর্জাতিক ফুটবলে লড়াই করা মুক্তিযোদ্ধার সমৃদ্ধ ইতিহাসেরই এক অধ্যায়।
বাংলাদেশ হিসেবে ইয়েমেনকে হারানোর সেই গল্পটা কখনোই ভুলে যাওয়ার নয়।