২৬তম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীর আয়োজন দেখতে ক্লিক করুন
মূল সাইট দেখতে ক্লিক করুন

চমকের যুগ্ম চ্যাম্পিয়ন মরক্কো-জাপান

কাতার বিশ্বকাপে চমকের পর চমক উপহার দিচ্ছে মরক্কো ও জাপানছবি: এএফপি ও রয়টার্স

দোহার যে হোটেল মাসখানেকের জন্য ‘বাড়ি’ হয়ে গেছে, তাতে প্রচুর মরোক্কান সমর্থক উঠেছেন। এতই যে বলতে গেলে দিন শুরু হয় কোনো না কোনো মরোক্কানকে দেখে, শেষও তা-ই। দেখাসাক্ষাৎ যা হয়, তা অবশ্য হোটেল থেকে বেরোনো আর ঢোকার সময় লিফটেই। হোটেলে আর থাকা হয় কই! সকালে বেরোনোর পর ফিরতে ফিরতে যে রাত দেড়টা-দুইটা বেজে যায়।

সেই লিফটেই মরোক্কানদের চোখে বিশ্বকাপের নানা রং দেখলাম। শুরুর রংটা কেমন ছিল? বিশ্বকাপ শুরুর দিনের কথাই বলি। সকালে লিফটে নামার সময় সব মরোক্কানের মধ্যে আমিই শুধু হংসমাঝে বক যথা। মরক্কো দলের অবস্থা কী, জানতে চাওয়ায় সবাই একসঙ্গে কথা বলতে শুরু করলেন।

একেকজনের ইংরেজি একেক রকম। তবে কথার মমার্থ বুঝতে কোনো সমস্যা হলো না। সারাংশ এ রকম: মরক্কো দলের অবস্থা মোটেই সুবিধার নয়। মাত্র তিন মাস আগে কোচ বদল হয়েছে। দলের খেলোয়াড়দের কে কেমন, সেটাই তো ভালোভাবে বুঝতে পারেননি।

মরক্কো দলের অবস্থা সুবিধার নয়—এটা ভদ্র অনুবাদ হয়ে গেল। মরোক্কানদের কথা বলার ধরন আর মুখের চেহারা যেমন ছিল, তাতে ‘মরক্কো দলের অবস্থা ছ্যাড়াব্যাড়া’ বললে বরং তা ভালো বোঝানো যায়। সেই ‘ছ্যাড়াব্যাড়া’ মরক্কোই এখন এই বিশ্বকাপের বড় চমক।

লিখেই মনে হলো, চমকের কথা বললে তো এই বিশ্বকাপে যুগ্ম চ্যাম্পিয়ন। মরক্কোর সঙ্গে জাপানও তো আছে। মরক্কোর মতো জাপানও গ্রুপ চ্যাম্পিয়ন হয়ে দ্বিতীয় রাউন্ডে উঠেছে। দুটির মধ্যে কোনটি বড় চমক, এ নিয়ে বরং আলোচনা হতে পারে। সূক্ষ্মতম ব্যবধানে জাপানই কি এগিয়ে? নাটকীয়তার দিক থেকে অবশ্যই। প্রথম ম্যাচে বেলজিয়ামকে হারিয়ে আর দ্বিতীয় ম্যাচে ক্রোয়েশিয়ার সঙ্গে ড্র করেই তো মরক্কো শেষ ষোলোতে এক পা দিয়ে রেখেছিল। কানাডার বিপক্ষে শেষ ম্যাচটাতে তারাই ছিল ফেবারিট। ওটাতে মরক্কোরই জেতার কথা ছিল। জিতেছেও।

স্পেনকেও হারানোর পর জাপানের খেলোয়াড়দের উদ্‌যাপন
ছবি: এএফপি

জাপানের ঘটনা তো তা নয়। শুরুটাতে যদিও মিল ছিল। জার্মানির বিপক্ষে জয়ের পর কোস্টারিকার কাছে পরের ম্যাচেই হেরে বসায় অবশ্য মনে হচ্ছিল, জাপান না আবার সৌদি আরব হয়ে যায়! প্রথম ম্যাচে হইচই ফেলে দেওয়া এক অঘটন ঘটানোতেই চমকের সমাপ্তি। তা হওয়ার শঙ্কা তো ছিলই। শেষ ম্যাচটা স্পেনের সঙ্গে।

কোস্টারিকাকে যারা ৭-০ গোলে হারিয়েছে, জার্মানির সঙ্গে ড্র ম্যাচেও জানিয়ে দিয়েছে, এই বিশ্বকাপে শিরোপার অন্যতম দাবিদার তারা। দ্বিতীয় রাউন্ডে উঠতে হলে স্পেনকে হারাতেই হবে—এই কঠিন সমীকরণ ও এর আনুষঙ্গিক চাপ মাথায় নিয়ে খেলতে নেমে এই জয়! মহিমায় যা জার্মানির বিপক্ষে জয়কেও যেন ছাড়িয়ে যেতে চায়।

জাপান যখনই কোনো বিশ্ব আসরে খেলতে যায়, একটা কারণে তারা সব সময়ই আলোচনায় থাকে। পরিষ্কার–পরিচ্ছন্নতার মূর্তিমান বিজ্ঞাপন হয়ে ওঠার জন্য। তা শুধু ব্যক্তিগত পরিষ্কার–পরিচ্ছন্নতা নয়। আশপাশের সবকিছু পরিষ্কার–পরিচ্ছন্ন রাখাটাকে জাপানিরা কর্তব্য মনে করে।

ম্যাচে জিতুক-হারুক, ড্রেসিংরুম ছাড়ার আগে তা চকচকে তকতকে করে রেখে যায়। জাপানি দর্শকেরাও এমন। এমনকি জাপানি সাংবাদিকেরাও। এই বিশ্বকাপে জাপান যেন প্রতিজ্ঞা করে এসেছিল, শুধু এ কারণেই যেন তাদের মনে রাখা না হয়। বিশ্বকাপ ড্রয়ের পর যা বললে সবাই নির্ঘাত হাসতেন। যে গ্রুপে সাবেক দুই বিশ্বকাপ চ্যাম্পিয়ন, সেই গ্রুপ থেকে পরের রাউন্ডে যাওয়ার প্রশ্ন আসে কোত্থেকে! এমনও নয় যে উরুগুয়ের মতো সেই কবেকার চ্যাম্পিয়ন।

এবারও বিশ্বকাপে গ্যালারির ময়লা পরিস্কার করে আলোচনার জন্ম দিয়েছেন জাপানের সমর্থক
ছবি: রয়টার্স

মাত্র একটা বিশ্বকাপ আগেই তো পরপর দুই বিশ্বকাপে চ্যাম্পিয়ন স্পেন ও জার্মানি। সেই দুই দলকেই হারিয়ে দেওয়া তো জাপানের জন্য বিশ্বকাপজয়ের সমতুল্যই। গত বিশ্বকাপে ৮০ বছর পর বিশ্বকাপের প্রথম রাউন্ড থেকে বিদায় নিয়েছিল জার্মানি। পরপর দুই বিশ্বকাপের প্রথম রাউন্ডেই ছুটি হয়ে যাওয়ার উদাহরণ ৮০ বছর কেন, ১০০ বছর পেছালেও মিলছে না। না-ই যে!

জার্মান ফুটবলের গায়ে এই কলঙ্ক লেপে দিয়েছে জাপান। বেলজিয়ামের সোনালি প্রজন্মের শেষটা যেমন দুঃস্বপ্ন বানিয়ে দিয়েছে মরক্কো। জাপানের গ্রুপের মতো সাবেক দুই চ্যাম্পিয়ন না থাকুক, গতবারের রানার্সআপ ছিল, ছিল গতবারের সেমিফাইনালিস্টও। তাদেরই একটিকে বিদায় করে দিয়ে শেষ ষোলোতে ওঠাটাই একরকম অসম্ভবের নামান্তর ছিল।

বিশ্বকাপ শুরুর আগে গ্রুপ চ্যাম্পিয়ন হয়ে উঠবে বললে মরোক্কানরাই তাঁদের নিয়ে রসিকতা করা হচ্ছে বলে ভাবতেন। বিশেষ করে বিশ্বকাপের আগে যে ‘ছ্যাড়াব্যাড়া’ অবস্থা ছিল মরক্কো দলের। ৩৬ বছর আগে, ১৯৮৬ মেক্সিকো বিশ্বকাপে সর্বশেষ শেষ ষোলোতে উঠেছিল মরক্কো।

এবার বিশ্বকাপের শেষ ষোলোয় উঠে চমকে দিয়েছে মরক্কো। দেশটির সমর্থকদের উদ্‌যাপন
ছবি: রয়টার্স

সেবারও কিন্তু চমক জাগিয়েই। গ্রুপের বাকি তিনটি দলই ছিল ইউরোপিয়ান—ইংল্যান্ড, পোল্যান্ড ও পর্তুগাল। প্রথম দুই দলের সঙ্গে ড্র করার পর পর্তুগালকে ৩-১ গোলে হারিয়ে মরক্কোর সেবার শেষ ষোলোতে ওঠা। সেখানেও সে সময়ের পশ্চিম জার্মানির সঙ্গে দারুণ লড়ে শেষ পর্যন্ত ১-০ গোলে হার।

এবার মরক্কো কি সেখানেই থেমে যাবে? কে জানে! শেষ ষোলোতে মরক্কোর প্রতিপক্ষ স্পেন, জাপানের প্রতিপক্ষ ক্রোয়েশিয়া। দুই দল তাই একে অন্যের কাছ থেকেই সাহস খুঁজে নিতে পারে।

স্পেনের মুখোমুখি হওয়ার সময় মরক্কোর নিশ্চয়ই মনে পড়বে, আগের ম্যাচেই এই স্পেনকে হারিয়ে দিয়েছে জাপান। ক্রোয়েশিয়ার সঙ্গে ম্যাচে জাপান ভাববে, মরক্কো কি এই দলকে রুখে দেয়নি? অঘটনের বিচারে এই বিশ্বকাপ এখনই ছাড়িয়ে গেছে আগের সব বিশ্বকাপকে। জাপান ও মরক্কো পরে ধারাটা পরে এগিয়ে নিয়ে গেছে, তিউনিসিয়া, গ্রুপ পর্বের শেষ দিন দক্ষিণ কোরিয়া-ক্যামেরুনও; তবে অঘটনের শুরুটা করেছিল কারা, মনে আছে তো?

একটা ধন্যবাদ বোধ হয় পেতেই পারে সৌদি আরব!