রদ্রির চোটে গার্দিওলার ‘সাজানো বাগান’ তছনছ, যে বার্তা পাচ্ছে ফুটবলও
এমন কিছু যে ঘটবে, সেই ইঙ্গিত কি রদ্রি আগেই পেয়েছিলেন? অবশ্য রদ্রি ছাড়া আর কার সঙ্গেই–বা এ ঘটনা ঘটতে পারত! পরিবেশ, পরিস্থিতি এবং পরিসংখ্যান সবকিছুই ম্যানচেস্টার সিটির এই হোল্ডিং মিডফিল্ডারকে ঠেলে দিয়েছিল সর্বনাশের দিকে। নন্দন থেকে যান্ত্রিকতার দিকে যে ফুটবলের যাত্রা, শেষ পর্যন্ত সেই যান্ত্রিকতার নির্মম শিকার হয়েই ছিটকে গেলেন রদ্রি। এসিএল (অ্যান্টেরিয়র ক্রুসিয়েট লিগামেন্ট) চোটে সম্ভবত মৌসুমই শেষ তাঁর। স্প্যানিশ তারকার চোটে পড়ার খবর শুধু সিটি বা স্পেনের জন্যই নয়, ফুটবল বিশ্বের জন্যই বড় ধরনের দুঃসংবাদ।
রদ্রি এ মুহূর্তে নিজের পজিশনে সেরা খেলোয়াড়। এটুকু বলাই হয়তো যথেষ্ট নয়। সম্ভবত যেকোনো পজিশন বিবেচনায় রদ্রি এই সময়ের অন্যতম সেরাদের একজন। পেপ গার্দিওলা কিংবা দে লা ফুয়েন্তের মতো কোনো কোনো কোচের মতে সেরাদের সেরাও বটে। এই তো মাত্র কদিন আগে স্পেনকে ইউরো জিতিয়ে হয়েছেন টুর্নামেন্টের সেরা খেলোয়াড়। তখন কেউ কেউ তাঁকে ব্যালন ডি’অরও দিয়ে দিতে বলেছিলেন। এর আগে গত মৌসুমে সিটির টানা চতুর্থবারের মতো প্রিমিয়ার লিগের শিরোপা জেতার পথেও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছিলেন এই স্প্যানিয়ার্ড। সব মিলিয়ে রদ্রির সময়টা ছিল ‘একাদশে বৃহস্পতি।’
তবে রদ্রি যখন দিনের পর দিন ফুটবল মঞ্চকে আলোকিত করছিলেন, তখন প্রদীপের নিচে জমে থাকা অন্ধকারটুকু খুব কম জনই দেখতে পেয়েছিলেন। আর কেউ অবশ্য পাক না পাক, রদ্রি নিজে ঠিকই দেখতে পেয়েছিলেন। একটানা ফুটবল খেলার কারণে শরীরও পৌঁছে গিয়েছিল সহ্যের শেষ সীমায়। গত মঙ্গলবারে এক সংবাদ সম্মেলনে রদ্রি বলেছিলেন, ‘আমার মনে হয় এটা খেলোয়াড়দের সাধারণ মতে পরিণত হয়েছে যে যদি এভাবেই চলতে থাকে, তাহলে একটা সময়ে গিয়ে ফুটবলারদের ধর্মঘট করা ছাড়া অন্য কোনো উপায় থাকবে না।’
ধর্মঘটে যাওয়া পর্যন্ত অবশ্য রদ্রিকে সময় দেয়নি শরীর। আর্সেনালের বিপক্ষে রুদ্ধশ্বাস ২–২ ড্র করা ম্যাচে মারাত্মক চোটে পড়ে শেষ হয়ে গেছে তাঁর মৌসুম। অথচ এই মানুষটির চোটপ্রবণ হওয়ার বিশেষ কোনো ইতিহাসও নেই। ট্রান্সফারমার্কেটের হিসাবে ২০১৯ সালে সিটিতে আসার পর এই মৌসুমের আগে চোটের কারণে রদ্রি মিস করেছেন মাত্র ৫ ম্যাচ। অথচ এখন ধারণা করা হচ্ছে, চোটের কারণে আগামী এক বছর তাঁকে মাঠে নাও দেখা যেতে পারে। রদ্রিকে হারানো পেপ গার্দিওলার জন্য বিশাল এক ধাক্কাই বটে।
কেউ অবশ্য চাইলে বলতে পারেন, ফুটবলারদের জন্য চোট তো সাধারণ ঘটনা। এসিএল চোট সব সময় অতিরিক্ত খেলার কারণে হবে, সেটাও তো না। হয়তো ওই মুহূর্তে রদ্রি দুর্ভাগা ছিলেন। কিন্তু মুদ্রার উল্টোপিঠে এটাও সত্য যে অতিরিক্ত ফুটবলের কারণে চোটপ্রবণতাও অতিরিক্ত হবে। আর একজন ফুটবলার সহজাতভাবে যতই ফিট হোন না কেন, শেষ পর্যন্ত তিনি মানুষ এবং তাঁর সামর্থ্য–সক্ষমতারও একটি নির্দিষ্ট সীমা আছে। সহ্যের সেই মাত্রায় রদ্রিকে একপর্যায়ে ঠেলে দিয়েছিল ঝুঁকির দিকে। সিটির হয়ে প্রিমিয়ার লিগে রদ্রির ম্যাচ–টাইমকে বিশ্লেষণ করলেও সেই সত্যতা পাওয়া যাবে।
২০১৯–২০ মৌসুমে রদ্রি সিটির হয়ে লিগে ৩৫ ম্যাচে মাঠে ছিলেন ২,৪৮৬ মিনিট। অর্থাৎ ম্যাচ প্রতি ৭২.৭ শতাংশ সময় মাঠে ছিলেন তিনি। পরের মৌসুমে ৩৪ ম্যাচে ২,৭৪৮ মিনিট মাঠে ছিলেন রদ্রি, ম্যাচ প্রতি যা ছিল ৮০.৪ শতাংশ। ২০২১–২২ মৌসুমে ৩৩ ম্যাচে ২,৮৮৫ মিনিট মাঠে ছিলেন তিনি, ম্যাচপ্রতি সময়ের হিসাবে যা ৮৪.৩ শতাংশ। একইভাবে ২০২২–২৩ মৌসুমে ৩৬ ম্যাচে ২,৯১১ মিনিট মাঠে ছিলেন এই ডিফেন্সিভ মিডফিল্ডার। সময়ের হিসাবে সেবার ৮৫.১ শতাংশ সময় মাঠে ছিলেন তিনি।
এই চোট কাটিয়ে রদ্রি ফিরবেন ঠিকই, কিন্তু ধারাবাহিকতা ও কার্যকারিতার পরাকাষ্ঠা হয়ে ওঠা সেই রদ্রিকে আর দেখা যাবে কি না সেই সন্দেহও আছে।
সর্বশেষ গত মৌসুমে ৩৪ ম্যাচ খেলা রদ্রি মাঠে ছিলেন ২,৯৩১ মিনিট, সময়ের হিসাবে ম্যাচ প্রতি ৮৫.৭ শতাংশ সময় মাঠে ছিলেন। অর্থাৎ প্রতি মৌসুমেই ধারাবাহিকভাবে চাপ বেড়েছে রদ্রির শরীর ও মনের ওপর। এর বাইরে চ্যাম্পিয়নস লিগ, ইংলিশ ফুটবলের ঘরোয়া লিগ এবং স্পেনের হয়ে খেলা ম্যাচ তো রয়েছেই। এসবের চূড়ান্ত পরিণতিই মূলত ভয়াবহ এই চোট।
এই চোট কাটিয়ে রদ্রি ফিরবেন ঠিকই, কিন্তু ধারাবাহিকতা ও কার্যকারিতার পরাকাষ্ঠা হয়ে ওঠা সেই রদ্রিকে আর দেখা যাবে কি না সেই সন্দেহও আছে। রদ্রির মতো ২০২০ সালের অক্টোবরে এসিএলের চোটে পড়েছিলেন লিভারপুল তারকা ভার্জিল ফন ডাইক। আট মাস পর চোট কাটিয়ে ডাচ সেন্টার ব্যাক ফিরেছিলেন বটে, কিন্তু পুরোনো ফন ডাইককে আর কখনোই খুঁজে পাওয়া যায়নি। রদ্রির পরিণতিও তেমন হলে সেটা ফুটবলের জন্য দুঃখজনক এক অধ্যায় হয়েই থাকবে।
রদ্রির চোটে সবচেয়ে বড় ঝড়টা যাবে সিটির ওপর দিয়েই, যা নিশ্চিতভাবে ঘুম হারাম করবে গার্দিওলারও। গত ফেব্রুয়ারিতেই রদ্রিকে নিয়ে গার্দিওলা বলেছিলেন, ‘সে অবিশ্বাস্য এক খেলোয়াড়। অন্যদের চেয়ে অনেক এগিয়ে থেকে বিশ্বের সেরা মিডফিল্ডার। এর কারণ সে সবকিছু করতে পারে।’ সত্যিকার অর্থেই রদ্রির অভাব পূরণ হওয়ার নয়। একই সঙ্গে রক্ষণ ও আক্রমণভাগের সঙ্গে সংযোগ তৈরি করার মধ্য দিয়ে সিটির খেলার সুর বেঁধে দেন তিনিই।
চলতি বছর রদ্রিকে নিয়ে শুধু একটি ম্যাচে হেরেছে সিটি। ম্যানচেস্টার ইউনাইটেডের বিপক্ষে এফএ কাপের সেই ফাইনাল বাদ দিলে রদ্রি ছিলেন রীতিমতো অপ্রতিরোধ্য। তাঁর খেলা মানেই সিটির সাফল্য। ২০১৯ সালে আতলেতিকো মাদ্রিদ থেকে রদ্রি আসার পর তাঁকে ছাড়া প্রিমিয়ার লিগে ২১টি ম্যাচ খেলেছে সিটি, যার মধ্যে ৭টিতেই হেরেছে ইতিহাদের ক্লাবটি। অর্থাৎ রদ্রিকে ছাড়া খেলে ৩৩ শতাংশ ম্যাচেই হার দেখেছে ক্লাবটি। আর সব মিলিয়ে রদ্রির খেলা ১৭৪ ম্যাচে ১৯টিতে হেরেছে সিটি। রদ্রিকে নিয়ে সিটির হার মাত্র ১১ শতাংশ ম্যাচে।
এমন পরিসংখ্যান অবশ্য চাইলে আরও দেওয়া যাবে, যা সিটি সমর্থকদের দীর্ঘশ্বাসই শুধু বাড়াবে। রদ্রির কারণেই সহজাত সেন্টারব্যাক থেকে সরে এসে হোল্ডিং মিডফিল্ডার পজিশনে খেলেছেন জন স্টোনস। দুজনের জুটিও ছিল দারুণ সফল। এখন রদ্রির পরিবর্তে মাতেও কোভাচিচের সঙ্গে সেই সাফল্যের পুনরাবৃত্তি বেশ কঠিনই হবে স্টোনসের জন্য। কোভাচিচ ছাড়া এ জায়গায় ম্যাচ টাইম পেতে পারেন ম্যাথুস নুনেজও। তবে দুজনের কেউ রদ্রির মতো কার্যকর নন। এর বাইরে রদ্রির বিকল্পের জন্য জানুয়ারির দলবদলকে পাখির চোখ করতে পারেন গার্দিওলা। যদিও সেসব এখনো দূরের বাতিঘর।
সবমিলিয়ে রদ্রির চোট যান্ত্রিকতায় মোড়া আধুনিক ফুটবলের বিশাল এক সতর্কবার্তা। ফুটবলের কর্তাব্যক্তিরা দ্রুত এই সতর্কবার্তা আমলে নিলে তা খেলোয়াড়, ক্লাব, দেশ এবং সর্বোপরি ফুটবলের জন্যই মঙ্গল। নয়তো ক্লান্তি ও চোটের অন্ধকার এই টানেলে হারাতে হতে পারে আরও অনেক তারকাকে।