চুরি যাওয়া বিশ্বকাপ পদক ফিরে পেয়েছেন আর্জেন্টাইন কিংবদন্তি

উবালদো ফিলোল—১৯৭৮ বিশ্বকাপজয়ী আর্জেন্টাইন ফুটবল দলের গোলকিপার। হাতে তাঁর সেই বিশ্বকাপের ফাইনালে পরা গ্লাভসইনস্টাগ্রাম

লোকটার উচ্চতা খুব বেশি ছিল না। ৬ ফুটের একটু কম। কিন্তু রিফ্লেক্স ছিল চমৎকার, ভীষণ অ্যাক্রোবেটিকও। আর্জেন্টাইন ফুটবলে সে সময় এত অ্যাক্রোবেটিক, রিফ্লেক্সসম্পন্ন এবং পায়ের ব্যবহার জানা গোলকিপার ছিল না। লোকে আদর করে তাঁকে ‘এল পাতো’ নামে ডেকেছে—আর্জেন্টাইন ফুটবলে নামটা চিরস্থায়ী জায়গাও পেয়েছে। বাংলায় নামটার অর্থ হলো ‘হাঁস’।

ঠিক কী কারণে এই নাম, তাঁর সুলুকসন্ধান করা যায়নি। একটা মিল হতে পারে এমন, পানির ওপর হাঁস যতটা সহজাত, মাঝেমধ্যে ডানা ঝাঁপটে লাফিয়ে শিকার ধরে—পোস্টের নিচে তিনিও ততটাই সহজাত ছিলেন। এ নিয়ে প্রশ্ন উঠতে পারে, হতে পারে বিতর্কও। তবে শুধু আর্জেন্টিনার ফুটবল কেন, ফুটবল ইতিহাসেই তাঁর কিংবদন্তি মর্যাদা নিয়ে কোনো প্রশ্ন উঠতে পারে না। ওহ, লোকটির নামই বলা হয়নি। তিনি উবালদো ফিলোল—১৯৭৮ বিশ্বকাপজয়ী আর্জেন্টাইন ফুটবল দলের গোলকিপার। কেউ কেউ তাঁকে আর্জেন্টিনার ইতিহাসেই সেরা গোলকিপার মানেন। গত মাসের মাঝামাঝিতে ফিলোলের ’৭৮ বিশ্বকাপ জয়ের পদক চুরি গিয়েছিল। গতকাল আর্জেন্টিনার সংবাদমাধ্যম ‘ক্লারিন’কে ফিলোলের ছেলে সেবাস্তিয়ান জানিয়েছেন, হারানো সেই পদক ফিরে পেয়েছেন তাঁর বাবা।

আরও পড়ুন
চুরি গিয়েছিল ১৯৭৮ বিশ্বকাপে পাওয়া উবালদো ফিলোলের পদক
ইনস্টাগ্রাম

ফিলোলের পদক চুরি যাওয়ার খবর গত ১৮ মার্চ জানিয়েছিল সংবাদমাধ্যম ‘ক্লারিন’ ও ‘বুয়েনস এইরেস টাইমস’। স্ত্রীর জন্মদিন পালনে বাইরে খেতে গিয়েছিলেন পরিবারকে সঙ্গে নিয়ে। ভোরে রেস্টুরেন্ট থেকে বের হওয়ার পর ফিলোল টের পান সঙ্গে থাকা তাঁর কিছু কাগজপত্র এবং বাসার চাবি চুরি গেছে। বাসায় ফিরে তো চক্ষু চড়কগাছ! সবকিছু ছড়ানো–ছিটানো এবং কিছু জিনিসপত্র চুরিও গেছে। সেই চুরি যাওয়া জিনিসপত্রের মধ্যে ’৭৮ বিশ্বকাপ জয়ের সোনার পদকও ছিল। ক্লারিন জানিয়েছে, চুরি যাওয়া সেই পদক ফিরে পাওয়ার খবর সেবাস্তিয়ান জানানোর কয়েক মিনিট আগে ৭৩ বছর বয়সী ফিলোল নিজেই এক ভিডিও বার্তায় সেটি ফেরত পাওয়ার খবর নিশ্চিত করেন।

ভিডিও বার্তায় ফিলোল বলেন, ‘আমি আপনাদের জানাতে চাই, আজ (গতকাল) অভিযান চালিয়ে কয়েকজনকে আটকের পাশাপাশি চুরি যাওয়া মালপত্রও ফেরত পেয়েছি। ভালো লাগছে এই ভেবে, যে বিষয়টির জন্য খুব কষ্ট পেয়েছিলাম, সেটি আজ (গতকাল) ফেরত পেয়েছি।’ এ ঘটনায় বুয়েনস এইরেসের সিটি পুলিশকেও ধন্যবাদ জানিয়েছেন ফিলোল।

ক্লারিন জানিয়েছে, বুয়েনস এইরেসের সিকিউরিটি ফোর্স তিনটি অভিযান চালিয়ে পদকটি উদ্ধার করেছে। একটি অভিযান চালানো হয় বুয়েনস এইরেস শহরের মধ্যে। বাকি দুটি অভিযান লা মাতাঞ্জায়—শহরের বাইরে হলেও বুয়েনস এইরেস প্রদেশের মধ্যে জায়গাটি। একজনকে গ্রেপ্তারও করা হয়েছে। চুরি যাওয়া মালামাল উদ্ধারের পাশাপাশি পুলিশ চুরির কাজে ব্যবহার হওয়া কাপড়, কয়েকটি মুঠোফোন, ছয়টি চাবি, পেনড্রাইভ, পরিচয়পত্র এবং একটি ভক্সওয়াগন ভেন্ট মডেলের গাড়িও আটক করা হয়।

আরও পড়ুন

পদক চুরি যাওয়ার কয়েক দিন পর ফিলোল জানিয়েছিলেন, তিনি এ ঘটনায় খুব কষ্ট পেয়েছেন এবং আর্জেন্টিনা ছেড়ে যাওয়ার কথাও ভেবেছিলেন। বলেছিলেন, ‘ওরা আমার খেলাধুলার ক্যারিয়ারটাই নিয়ে গেছে। খুব ক্লান্ত লাগছে। সন্তানদের বলেছি, অন্য কোনো দেশে গিয়ে আর্থিক এবং খেলাধুলা–সংশ্লিষ্ট কোনো ব্যাপারে ভালো করার মতো সংগতি তো আমার এখন নেই। তবে সেটা থাকলে (দেশ) ছেড়ে যেতাম।’

আর্জেন্টিনার হয়ে ১৯৭৪, ১৯৭৮ ও ১৯৮২ বিশ্বকাপে খেলেছেন ফিলোল। ’৮৬ বিশ্বকাপের বাছাইপর্বে খেললেও পরে মূল দলে আর জায়গা পাননি। তত দিনে ছত্রিশে পড়েছিল তাঁর বয়স। ১৯৭৪ বিশ্বকাপ দিয়ে আর্জেন্টিনা দলে ডাক পাওয়া ফিলোল চার বছর পর ঘরের মাঠে আয়োজিত সেই বিশ্বকাপের সেরা গোলকিপারও হয়েছিলেন। আর্জেন্টিনায় ক্লাব ক্যারিয়ারে কুইলেমস ও রেসিংয়ে খেলার পর রিভার প্লেটে যোগ দিয়ে ক্লাবটির কিংবদন্তিতে পরিণত হন ফিলোল। রিভার প্লেটের (১৯৭৩-১৯৮৩) হয়ে জেতেন ৭টি শিরোপা।

স্ত্রীর সঙ্গে উবালদো ফিলোল
ইনস্টাগ্রাম

সে সময় রিভার প্লেটের চিরপ্রতিদ্বন্দ্বী ক্লাব বোকা জুনিয়র্সের গোলকিপার ছিলেন হুগো গাত্তি। দুজনকেই সে সময় দেশের সেরা গোলকিপার বিবেচনা করতেন আর্জেন্টিনার ফুটবলপ্রেমীরা। ফিলোল এবং গাত্তির মধ্যে তাই অদৃশ্য এক প্রতিযোগিতাও তৈরি হয়েছিল। ৪০ বছর বয়সে ফিলোল অবসর নেওয়ার আগে আর্জেন্টিনার ঘরোয়া ফুটবলে যৌথভাবে ২৬টি পেনাল্টি ঠেকানোর রেকর্ড গড়েন। এই রেকর্ডে তাঁর ভাগীদার কে জানেন তো? কে আবার, হুগো গাত্তি!

১৯৭৭ সালে আর্জেন্টিনার গোলকিপার হিসেবে দেশটির বর্ষসেরা ফুটবলারের পুরস্কারও জিতেছেন জাতীয় দলের হয়ে ৫৮ ম্যাচ খেলা ফিলোল। আর্জেন্টিনার প্রিমিয়ার লিগে তাঁর নামে ২০০৮ সালে গোলকিপারদের পুরস্কারও চালু হয়—উবালদো ফিলোল অ্যাওয়ার্ড। ১৯৯০ সালে অবসর নেওয়ার পর আর্জেন্টিনা জাতীয় দলের গোলকিপারদের কোচের দায়িত্ব সামলেছেন তিনি।

আরও পড়ুন