মেসি ক্লান্ত প্রাণ এক...
ম্যাচে ৩৬ মিনিটের খেলা চলছিল তখন। চোট সারিয়ে মাঠে নামা লিওনেল মেসি আর খেলা চালিয়ে যেতে পারছিলেন না। শেষ কয়েক মিনিট অনেকটা জোর করেই যেন খেললেন। মাঠ ছাড়ার আগে খুলে ফেললেন শিনগার্ডও (পায়ে থাকা সুরক্ষা গার্ড)। মেসির মুখ দেখে মনে হচ্ছিল, ফুটবল খেলাটা না জানি কত বিরক্তিকর! মুখ ও শরীরী ভাষায় ক্লান্তির ছাপ স্পষ্ট। কোথায় যেন সবকিছু ভেঙেচুরে গেছে। এরপর বেঞ্চে বসে থাকা মেসির ক্লান্ত মুখের একটি ছবি সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে বেশ ভাইরালও হয়েছে।
মেসির দীর্ঘশ্বাস ছাড়ার সেই দৃশ্য সরাসরি ভক্ত–সমর্থকদের বুকে গিয়ে যেন ধাক্কা দিয়েছিল। দৃশ্যটা সামনে এলেই মনে পড়তে পারে জীবনানন্দ দাশের সেই বিখ্যাত লাইন, ‘আমি ক্লান্ত প্রাণ এক, চারিদিকে জীবনের সমুদ্র সফেন।’ কেউ চাইলে অবশ্য রবীন্দ্রনাথের আশ্রয়ও নিতে পারেন মেসির মুখচ্ছবির ওপর এই পঙ্ক্তি বসিয়ে—‘ক্লান্তি আমার ক্ষমা করো প্রভু, পথে যদি পিছিয়ে পড়ি কভু’।
পেশাদার ফুটবলে দীর্ঘ ২০ বছরের ক্যারিয়ারে ব্যর্থতা ও না পাওয়ার যন্ত্রণায় ভেঙে পড়তে দেখা গেলেও, মেসিকে কখনো ক্লান্তিতে ভেঙে পড়তে দেখা যায়নি। এমনকি মেসি সেভাবে বড় কোনো চোটেও পড়েননি। উত্থান–পতনের নাটকীয় ক্যারিয়ারে যে আক্ষেপ জমা ছিল, শেষ ভাগে এসে মিটিয়ে ফেলেছেন সে লেনাদেনাও। ফুটবল থেকে আক্ষরিক অর্থে তাঁর নিজের চাওয়া-পাওয়ার কিছুই নেই। অর্থ, বিত্ত, সচ্ছলতা তো আরও আগেই এসেছিল। বিশ্বকাপ না জিতলে সর্বকালের সেরা হতে না পারার যে জোয়াল মেসির কাঁধে চাপিয়ে দেওয়া হয়েছিল, সেটিও নামালেন ১০ মাস আগে। আক্ষরিক অর্থেই ‘বাকেট লিস্টে’ আর কিছুই বাকি ছিল না! মেসি যদি গত বছরের ১৮ ডিসেম্বর বুট জোড়া খুলেও রাখতেন, তবু অনেকের কাছে তাঁর ‘সর্বকালের সেরা’র তকমায় এতটুকু ধুলাও জমত না!
কিন্তু পাওয়ার কিছু না থাকতে পারে, দেওয়ার তো ছিল। হয়তো ‘আউট অব দ্য বক্স’ কিছু করার কথা ভেবেছিলেন মেসি। চেয়েছিলেন কখনো চ্যাম্পিয়নস লিগ না জেতা পিএসজিকে সেই শিরোপা এনে দেবেন। কিন্তু যাঁর কাছে ফরাসিরা বিশ্বকাপ হারিয়েছে, তাঁকে তারা প্যারিসে টিকতে দিল না। বৈরী পরিবেশের সঙ্গে মানিয়ে নিতে ব্যর্থ হয়ে ছাড়লেন ক্লাবটি। সেখান থেকে যেতে পারতেন ফুটবলের নতুন তীর্থ হয়ে ওঠা সৌদি আরবে। প্রস্তাবও ছিল চোখধাঁধানো। কিন্তু মেসি চেয়েছিলেন অন্য কোনো সুর বাঁধতে। বেছে নিলেন ইন্টার মায়ামিকে। মেজর লিগ সকারের (এমএলএস) একেবারে তলানির দলকে।
কোণঠাসা দলকে সাফল্যে ফেরাতে মেসি খেলে গেলেন একের পর এক ম্যাচ। সাফল্য লুটিয়েছেও তাঁর পদতলে। মায়ামি জিতল নিজেদের ইতিহাসের প্রথম শিরোপা। পাশাপাশি নিশ্চিত হয়েছে অন্য একটির ফাইনালও। কিন্তু মেসি যখন সব ভুলে ছুটছিলেন, আড়ালে কিছু একটা যেন ধসে পড়ছিল। বলছি আসলে শরীরের কথা। বল পায়ে যতই অতিমানব হন, শরীরটা তো মানবীয় তাঁর। সবকিছু তাই আর দশটা মানুষের মতোই। আর বয়সও তো আটকে নেই সেই ষোলো কিংবা বিশে। বিশ্বকাপের পর বিরতিহীন ম্যাচ খেলার ফলটা (কুফল) পেতেও সময় লাগল না।
আন্তর্জাতিক বিরতিতেই বোঝা গেল শরীরে বয়ে যাওয়া ঝড়টার স্বরূপ। বড় কোনো চোট নয়, মূলত মাংশপেশির ওপর বাড়তি যে চাপ এত দিন দিয়েছেন, সেটিই যেন ঠোঁট উল্টে বসল। যার ফলাফল বিশ্বকাপ বাছাইয়ে পেরুর বিপক্ষে ম্যাচ শেষ না করেই মাঠ ছাড়তে হলো তাঁকে। বলিভিয়ার বিপক্ষে লা পাজে থাকলেন দর্শক হয়ে। ইন্টার মায়ামিতে ফিরলেও খেলতে পারেননি আটলান্টার বিপক্ষে ম্যাচটি। আর এফসি টোরোন্টোর বিপক্ষে ৩৬ মিনিটে ক্লান্ত–শ্রান্ত মেসির মাঠ ছাড়ার কথা তো আগেই বলা হয়েছে। মানসিকভাবে মেসি নিজেকে তারুণ্যে আটকে রাখলেও, শরীরটা যে বুড়িয়ে গেছে, সেই প্রমাণও যেন পাওয়া গেল এতে।
বিশ্বকাপ জয়ের পর বিশ্রামে থাকায় পিএসজির হয়ে লিগে টানা দুটি ম্যাচ খেলতে পারেননি। আর পরের ২১ ম্যাচে ১৯টিতেই খেলেছেন এই আর্জেন্টাইন মহাতারকা। যার প্রতিটিতেই পুরো ৯০ মিনিট খেলেছেন মেসি। এর মধ্যে পিএসজির হয়ে চ্যাম্পিয়নস লিগের দুই ম্যাচের দুটিতেই খেলেছেন সাবেক বার্সা তারকা। ফ্রেঞ্চ কাপে খেলেছেন তিন ম্যাচের একটিতে। খেলেছেন ফরাসি সুপার কাপের শিরোপা নির্ধারণী লড়াইয়েও। বিশ্বকাপের পর আর্জেন্টিনার খেলা চারটি প্রীতি ম্যাচের তিনটিতেই খেলেছেন মেসি। আর বিশ্বকাপ বাছাইয়ের দুই ম্যাচেই খেলার কথা থাকলেও চোটের কারণে বলিভিয়ার বিপক্ষে থাকতে হয়েছে দর্শক হিসেবে।
ইন্টার মায়ামিতে আসার পর লিগস কাপ দিয়ে যাত্রা শুরু করেন মেসি। এই টুর্নামেন্টের সাত ম্যাচের সব কটি খেলে দলকে শিরোপা জেতান মেসি। এমএলএসের যাত্রা শুরুর আগে খেলেছেন ইউএস ওপেন সেমিফাইনালেও। আর এমএলএসে মাঠে নেমে প্রথম তিন ম্যাচের পুরো সময়ই মাঠে ছিলেন মেসি। এক হিসাবে জানা গেছে, ম্যাচ খেলার জন্য গত ৬ আগস্ট থেকে ৭ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত ৩২ দিনে মেসি সব মিলিয়ে ভ্রমণ করেছেন ২৮ হাজার ১১০ কিলোমিটার পথ। ভাবা যায়! এরপর আন্তর্জাতিক বিরতি শেষে চোট নিয়ে ফিরে খেলতে পারেননি আটলান্টার বিপক্ষে ম্যাচটি। টোরোন্টোর বিপক্ষে চেষ্টা করেও থাকতে পারেননি ৩৬ মিনিটের বেশি। ছুটতে ছুটতে মেসির এভাবে বাধ্য হয়ে থেমে যাওয়ার মূলে কিন্তু সেই ক্লান্তি, যা কিনা সেদিন বেঞ্চে তাঁর অভিব্যক্তিতেই স্পষ্ট হয়েছিল।
কিন্তু সব পেয়েও কেন মেসির এই বিরামহীন ছোটাছুটি? কে জানে, বলহীন মেসি হয়তো নিঃসঙ্গতায় ভোগার ভয়ে থাকেন। আর কে না জানেন, পেশাদার ফুটবলারদের জন্য সবচেয়ে বড় যন্ত্রণা হচ্ছে একাকিত্বের যন্ত্রণা। ফাঁকা মাঠের নিঃসঙ্গতা কিংবা হোটেল রুমের একাকিত্ব জেঁকে ধরে তাঁদের। ক্যারিয়ারে শুরুতে মেসিকেও যেতে হয়েছিল এমন পরিস্থিতির ভেতর দিয়ে। বার্সেলোনায় এসে মেসি তখন পুরো পরিবার নিয়ে অপেক্ষা করছিলেন ট্রায়াল দেওয়ার জন্য।
অপেক্ষার একপর্যায়ে তাঁর মনে হয়েছিল, বার্সেলোনা একটি বিরক্তিকর শহর। তাঁর ভাইয়েরও একই অবস্থা দেখে মেসির মা তাঁদের দেশে ফিরিয়ে নেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন। যদিও সেটা মোটেই সহজ ছিল না। তখন অনেক সময় মেসি বাথরুমে নিজেকে বন্দী করে কাঁদতেন। একদিন হোর্হে মেসি সিদ্ধান্ত নিলেন যে সবাইকে নিয়ে দেশে ফিরে যাবেন।
তবে এর মধ্যে রেক্সাস ফিরে আসায় শেষ পর্যন্ত তা করতে হয়নি। বার্সায় সুযোগ পাওয়ার পরও লম্বা সময় মানুষের সঙ্গে মিশতে পারতেন না মেসি। সে সময়কার মেসিকে নিয়ে লিওনার্দো ফাসিও লিখেছেন, ‘বলহীন মেসি এমন এক দুর্দান্ত খেলোয়াড়, যার ভেতর থেকে ব্যাটারি খুলে ফেলা হয়েছে। আর সে যেন নিজেরই দুর্বল এক প্রতিনিধি।’ কে জানে, হয়তো সেই ভয়েই মেসি ক্লান্তি নিয়েও বলটাকে আঁকড়ে ধরে রাখতে চান আরও অনেক দিন। খেলতে চান ২০২৪ কোপা আমেরিকা, এমনকি ২০২৬ বিশ্বকাপও। এ জন্য জয় করতে চান শরীরটাকেও।