খেলোয়াড়ি জীবনে কখনো ক্লাবের আবাসিক ক্যাম্পে থাকতেন না। থাকতেন নিজের জন্মস্থান ঢাকার বকশীবাজারের পাশের নবাবপুরে। ১৯৮০ সাল থেকেই প্রতিদিন লাল রঙের ভেসপায় চড়ে মোহামেডান ক্লাবে আসা শুরু করেন। তারপর আবাহনী, ভিক্টোরিয়া ক্লাবে যখন খেলেন, তখনো ভেসপাতেই যাওয়া-আসা করতেন। ২০০৪ সালে আবাস গড়েন কেরানীগঞ্জের আঁটিতে। সেখান থেকেও গত ২০ বছরে ঢাকায় কোচিং করাতে আসছেন বাইক চালিয়ে।
এমন কোনো দিন নাকি নেই, যেদিন বাইক ছাড়া ঢাকা শহরে এসেছেন আবু ইউসুফ। সর্বশেষ সাত বছর আগে কেনা ১২৫ সিসি হোন্ডা চালিয়ে এখনো আসেন কমলাপুর স্টেডিয়ামে। যেখানে চলছে পেশাদার ফুটবলের দ্বিতীয় স্তর চ্যাম্পিয়নশিপ লিগ। ঢাকা ওয়ান্ডারার্সের কোচ তিনি। কেরানীগঞ্জ থেকে বাবুবাজার ব্রিজ হয়ে কমলাপুর স্টেডিয়ামে আসতে সময় লাগে ঘণ্টাখানেক।
বয়স এখন ৬৭ বছর, বাংলাদেশে পেশাদার পর্যায়ে সবচেয়ে বেশি বয়সী ফুটবল কোচ এখন আবু ইউসুফই। জীবনে অনেক কিছু বদলেছে, কিন্তু আজও বাইকপ্রীতি ছাড়তে পারেননি তিনি। আবু ইউসুফ বলছিলেন সে কথাই, ‘প্রায় ৪০ বছরে তিনটি বাইক চালিয়েছি। সময় বাঁচে, নিজেকে সচলও রাখা যায়। অনেক সময় ছোটখাটো দুর্ঘটনায়ও পড়েছি।’
১৯৭৩ সালে ফায়ার সার্ভিস দিয়ে ঢাকার ফুটবলে শুরু। ’৭৪-৭৯ পর্যন্ত রহমতগঞ্জ। ’৮০-৮২ মোহামেডান। ’৮৩-৯১ ও ’৯৪ আবাহনীতে কাটান। আবাহনীর জার্সিতে ১০ বছরের ক্যারিয়ারে জিতেছেন ছয়টি লিগ, ১৯৮৩-৮৬ আকাশি নীলের হ্যাটট্রিক চ্যাম্পিয়ন দলের সদস্য। ’৯২-৯৩ সালে খেলেন ভিক্টোরিয়ায়। দেশের ফুটবল ইতিহাসে অন্যতম সেরা ডিফেন্ডার আবু ইউসুফ খেলতেন সেন্টার ব্যাকে।
বকশীবাজারে নবকুমার স্কুল দলে সুযোগ পাওয়ার আগেই জাতীয় দলে সুযোগ পান। ১৯৭৫ সালের মারদেকা কাপ থেকে ’৮৬ পর্যন্ত খেলেছেন জাতীয় দলে। ১৯৯৫ সালে ঢাকা মোহামেডানের দায়িত্ব নিয়ে কোচিং–জীবন শুরু। পরবর্তী সময়ে প্রিমিয়ার লিগে ঢাকা আবাহনী, শেখ রাসেল, শেখ জামাল ও মুক্তিযোদ্ধা এবং চ্যাম্পিয়নশিপ লিগে ফরাশগঞ্জ, ভিক্টোরিয়া, ফেনী সকার, ওয়ারী ও নোফেলের কোচ ছিলেন। চট্টগ্রাম লিগে চট্টগ্রাম আবাহনীর ডাগআউটে দাঁড়িয়েছেন। দ্বিতীয় বিভাগের টিঅ্যান্ডটি, প্রথম বিভাগের কসাইটুলী, জুরাইন ক্লাব, বাংলাদেশ সেনাবাহিনী, নৌবাহিনী, বিমানবাহিনীরও কোচ হয়েছেন। ৮-৯ বার কোচিং করিয়েছেন সেনাবাহিনীর বিভিন্ন ইউনিটকে।
বাফুফের বিভিন্ন বয়সভিত্তিক দল ও জাতীয় দলের দায়িত্ব পালনের পাশাপাশি দেশের নারী ফুটবলে বাফুফের প্রথম নিয়োগপ্রাপ্ত কোচও আবু ইউসুফ। ২০০৫ সালে নারী ফুটবল দল নিয়ে ভারত সফরে গিয়েছিলেন। প্রায় ৩০ বছরের কোচিং–জীবনে তাঁর পরিচয়ই হয়ে গেছে ‘তৃণমূলের কোচ’। যেখানে নেই গ্ল্যামার, প্রচার বা অর্থের ঝনঝনানি। লম্বা কোচিং–জীবনে ভিক্টোরিয়ার কোচ হয়েছেন সর্বোচ্চ তিন-চারবার। আবাহনী ও নোফেলে দুবার করে। তবে কোনো ক্লাবেই টানা দুই মৌসুম কোচিং করাননি এএফসি সনদধারী এই কোচ। দুটি ক্লাবের চাকরি মাঝপথে ছেড়ে চলে আসেন। এ নিয়ে বলছিলেন, ‘ক্লাবের সঙ্গে আমার বনিবনায় সমস্যা হয়। এ কারণে দুটি ক্লাবের দায়িত্ব ছেড়ে দিই আগেই। বাফুফে থেকেও পদত্যাগ করে চলে আসি। আমাকে অনেকে তাই একরোখা বলে।’
ক্লাবের সঙ্গে বনিবনা না হওয়ার কারণ কী? আবু ইউসুফ পেছনে ফেরেন, ‘আমি অনুশীলন করাই, কিন্তু টিম ব্রিফ করেন কর্মকর্তারা, দল নির্বাচনও করেন তাঁরা। এসব নিয়ে ঝামেলা হয়। স্বাধীনভাবে দল পরিচালনা করতে দেয় না বেশির ভাগ সময়ই। এমন হলে আমি সাফ বলে দিই, ভাই, এভাবে আমার পক্ষে সম্ভব নয়। অনেকে আমার এই চরিত্র পছন্দও করেন না। আমি তাই বিচ্ছিন্ন হয়ে গেছি।’
ফুটবলে দল গঠন করা কোচের কাজ। কিন্তু বিভিন্ন কারণে আবু ইউসুফ তা করেন না বলে জানালেন। না করার কারণটাও বলেন, ‘দীর্ঘ অভিজ্ঞতায় দেখেছি, ক্লাবের অনেকে চায় নিজেরাই খেলোয়াড়ের সঙ্গে চুক্তি করবে। এই কাজে কী মধু আছে, আমি জানি না। অথচ টিম করার কথা কোচের। এ জন্য খেলোয়াড়দের সঙ্গে একটা দূরত্ব হয়ে যায় আমার।’
কোন খেলোয়াড়ের সঙ্গে ক্লাব কত টাকায় চুক্তি করল, সেটা দেখেন না ইউসুফ। দেখেন শুধু অনুশীলনের পারফরম্যান্স, ‘অনুশীলন মাঠে আমি শুধু খেলোয়াড়দের পারফরম্যান্স দেখি। ফলে দেখা যায়, কোনো খেলোয়াড় আমাকে অপছন্দ করে বা খেলোয়াড়দের একটা গ্রুপ আমার বিরুদ্ধে চলে যায়। আবার কর্মকর্তারাও আমার বিরুদ্ধে যায়। যখন একাদশ করি বা খেলোয়াড় বদল করি, তখন খেলোয়াড় বা কিছু কর্মকর্তা তা পছন্দ করে না। ব্যাপারটা যেন এমন, তাদের কথাই শুনতে হবে আমাকে। তারা টিম বানায়, তারাই মালিক।’
বাংলাদেশের ক্লাব ফুটবলে কোচের ওপর কর্মকর্তাদের খবরদারি নতুন নয়। কর্মকর্তাদের মতের বিরুদ্ধে গেলে চাকরি হারাতে হয়। তবে আবু ইউসুফের ব্যতিক্রম অভিজ্ঞতাও হয়েছে, ‘আমি চট্টগ্রাম আবাহনীর কোচ থাকার সময় স্থানীয় খেলোয়াড়েরা ক্লাবের এক শীর্ষ কর্মকর্তার কাছে অভিযোগ করে, আমি নাকি স্থানীয়দের সুযোগ দিই না। ওই কর্মকর্তা আমাকে ডেকে বিস্তারিত জানার পর অভিযোগ করা খেলোয়াড়দেরই কড়া ভাষায় তিরস্কার করেন। তখন সবাই সোজা হয়ে যায়।’
চ্যাম্পিয়নশিপ লিগে ইউসুফের বর্তমান দল ওয়ান্ডারার্স ৭ ম্যাচ খেলে ৩টিতে জিতেছে ও ৩টিতে ড্র করেছে। সপ্তম ম্যাচ হেরেছে। দ্বিতীয় স্তর কেমন চলছে জানতে চাইলে বলেন, ‘সেখানে অনেক সমস্যা। পাতানো ম্যাচ হয় শুনি। নতুন যুক্ত হয়েছে জুয়া। কোচ, অফিশিয়াল, খেলোয়াড়েরা নাকি যুক্ত থাকে এসবে! তবে প্রমাণ দিতে পারব না। পাতানো শুনলে সাফ ক্লাবকে বলে দিই, ফিক্সিং হলে আমি মাঠে যাব না। কোচিং–জীবনে একাধিকবার হয়েছে এমন ঘটনা। এমনও হয়েছে, ক্লাব আমাকে আগেই বলে দিয়েছে, আজ পাতানো খেলবে। আমি সেদিন মাঠে যাইনি।’
স্ত্রী মারা গেছেন ২০১৪ সালে। দুই ছেলেই চিকিৎসক। কেরানীগঞ্জে ১০ কাঠার ওপর ধাপে ধাপে পাঁচতলা বাড়ি করেছেন। গরুর খামার করেছিলেন সেখানে। লোকসান হলে একদিন রাগ করে সব গরু (প্রায় ২০টি) বিক্রি করে দেন। ওই জায়গা এখন ভাড়া দিয়েছেন কোরবানির গরুর জন্য। বাড়িভাড়া পান কিছু। এভাবেই চলে তাঁর সংসার। আর চলে নীরব কোচিং-লড়াই। কোচিং তাঁর পেশা নয় এখন আর, নেশা।