বাংলাদেশ ফুটবল ফেডারেশনের (বাফুফে) ফেসবুক পেজের বয়স ১৩ বছর হলো গত পরশু। পেজটির কোনো পোস্টই হাজারখানেক শেয়ারও হয়নি। দেশের ফুটবলের খবর না রাখা কোনো ব্যক্তি এই পেজ দেখে হয়তো আন্দাজ করে নেবেন, এই তাহলে ফুটবল নিয়ে উন্মাদনা! ভুল। মাঝে একটা শুভংকরের ফাঁকি আছে।
নারী সাফ চ্যাম্পিয়নশিপের ফাইনালে ওঠার পর কাল নিজের ফেসবুক পেজে একটি লেখা পোস্ট করেন বাংলাদেশের রাইট উইঙ্গার সানজিদা আক্তার। বাস্তবতা ও আবেগের মিশেলে সেই লেখা এরই মধ্যে সাড়ে তিন হাজারের বেশি শেয়ার হয়েছে।
সংবাদমাধ্যম সানজিদার লেখার অংশবিশেষ নিয়ে নিজেদের ফেসবুক অ্যাকাউন্টে শেয়ার করেছে। ফুটবলপ্রেমী বাংলাদেশের মানুষেরাও সানজিদার এই লেখা শেয়ার করেছেন নিজেদের ফেসবুক অ্যাকাউন্ট থেকে। পার্থক্যটা তাই পরিষ্কার। ফুটবল নিয়ে দেশের মানুষ উন্মাদনায় ভাসতে চায়। কিন্তু উপলক্ষ মেলে খুব কমই।
নারী সাফ চ্যাম্পিয়নশিপে উপলক্ষটা আসার পর সানজিদার এক পোস্টেই বোঝা গেছে, ফুটবল নিয়ে দেশের মানুষের সুপ্ত উন্মাদনা ভিসুভিয়াসের মতো ফেটে পড়ার অপেক্ষায় ছিল। দশরথ স্টেডিয়ামে আজ ফাইনালে নেপালকে ৩–১ গোলে হারিয়ে বাংলাদেশ চ্যাম্পিয়ন হওয়ার পর এই ৫৬ হাজার বর্গমাইলে কান পাতলে অনুচ্চারে একটা কথাই শোনা যাবে, কথা রেখেছেন সানজিদারা!
কথা দিয়ে কথা রাখতে না পারার নজির কম নেই বাংলাদেশের ক্রীড়াঙ্গনে। ছেলেদের ক্রিকেটে অনেকবারই এভাবে হৃদয় ভেঙেছে। দেশের ফুটবলপ্রেমীরা অভিমানে বলতে পারেন, তবু তো ছেলেদের ক্রিকেট নিয়েই উন্মাদনা বেশি। সে যুক্তি–তর্ক অন্য দিন হবে।
শুধু মনে করিয়ে দেওয়া যাক, বাংলাদেশের ক্রীড়াঙ্গন থেকে আন্তর্জাতিক ময়দানে অন্যতম বড় দুটি সাফল্য কিন্তু মেয়েরাই এনে দিয়েছেন। ২০১৮ এশিয়া কাপ এবং এবারের নারী সাফ চ্যাম্পিয়নশিপ—ক্রিকেট ও ফুটবল। এর মধ্যে ফুটবল নিয়ে আক্ষেপই ঝরে বেশি। কখনো কখনো বাংলাদেশ ফুটবল ফেডারেশন (বাফুফে) থেকেও ধৈর্য হারানোর ইঙ্গিত মিলেছে।
২০১৬ সালেই তো বাংলাদেশ ফুটবল ফেডারেশনের (বাফুফে) ফেসবুক পেজে করা পোস্টে দোষারোপ করা হয়েছিল দর্শকদের। অনূর্ধ্ব–১৬ দলের ম্যাচ দেখতে কতজন স্টেডিয়ামে এসেছেন, এ নিয়ে অভিযোগ করা হয়েছিল। সেখানে এক ফুটবলপ্রেমী বলেছিলেন, দর্শকদের মাঠে যাওয়ার জন্য পরিবহনের ব্যবস্থা করা যায় কি না? বাফুফে ফেসবুক অ্যাডমিন জবাব দিয়েছিলেন, ‘হ, তারপর আর কী কী করমু একটা লিস্ট দে।’
মেয়েরা সাফ জেতার পর এখন সম্ভবত কারও এমন কোনো তালিকা তৈরির সময়ও নেই। অযুত শুভেচ্ছায় ম ম করছে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের ফিড।
দশরথ স্টেডিয়ামের কর্দমাক্ত মাঠে খেলা এমনিতেই কঠিন। বল পায়ে মেয়েরা যখন নেপালের বিপৎসীমায় বারবার ঢুকে পড়ছিলেন, তখন নিশ্চয়ই সানজিদার সেই স্ট্যাটাসের দু–এক লাইন অনেকের মনে পড়েছে, ‘পাহাড়ের কাছাকাছি স্থানে বাড়ি আমার। পাহাড়ি ভাইবোনদের লড়াকু মানসিকতা, গ্রামবাংলার দরিদ্র ও খেটে খাওয়া মানুষদের হার না মানা জীবনের প্রতি পরত খুব কাছাকাছি থেকে দেখা আমার। ফাইনালে আমরা একজন ফুটবলারের চরিত্রে মাঠে লড়ব এমন নয়, এগারোজনের যোদ্ধাদল মাঠে থাকবে...।’
সানজিদার স্ট্যাটাসটি যে নিখাদ আবেগের মিশেলে সত্য কথা ছিল, তা বোঝা গেছে খেলা দেখেই। আর দর্শকদের জন্যও প্রাপ্তি ছিল। যে ফুটবল নিয়ে বাফুফে বনাম দেশের মানুষের লড়াই চলে, যেখানে দেশের ফুটবলপ্রেমীদেরও মাঝেমধ্যে দাঁড়াতে হয় কাঠগড়ায়, সেসব মানুষই আজ বিকেল ৫টা ১৫ মিনিটের পর টিভির সামনে বসে ছিলেন। রাস্তার পথচারী যেমন ঘর থেকে ভেসে আসা উল্লাসের আওয়াজ পেয়েছেন, তেমনি ঘরে টিভি সেটের সামনে বসে থাকা লোকজনও রাস্তায় মানুষের উল্লাসের আওয়াজ শুনেছেন। যেন সমগ্র বাংলাদেশের মানুষের চোখ–কান পাতা ছিল দশরথ স্টেডিয়ামে। তার মিঠে পুরস্কারই পেলেন বাংলাদেশের ফুটবলপ্রেমীরা।
সানজিদা তাঁর স্ট্যাটাসে লিখেছিলেন, ‘যাঁরা আমাদের এই স্বপ্নকে আলিঙ্গন করতে উৎসুক হয়ে আছেন, সেই সকল স্বপ্নসারথিদের জন্য এটি আমরা জিততে চাই। নিরঙ্কুশ সমর্থনের প্রতিদান আমরা দিতে চাই। ছাদখোলা চ্যাম্পিয়ন বাসে ট্রফি নিয়ে না দাঁড়ালেও চলবে, সমাজের টিপ্পনীকে একপাশে রেখে যে মানুষগুলো আমাদের সবুজ ঘাস ছোঁয়াতে সাহায্য করেছে, তাদের জন্য এটি জিততে চাই।’
অর্থাৎ শিরোপাটা বাংলাদেশের মানুষেরই। মেয়েরা আসলে এই দেশের মানুষকেই জিতিয়ে দিয়েছেন। একটা সাফল্যের জন্য বুভুক্ষু যে জাতি, সেই জাতির বুকে একপশলা বৃষ্টির ধারা বইয়ে দিয়েছে এই সাফল্য। অথচ এই প্রতিবেদন লেখা পর্যন্ত বাফুফের ফেসবুক পেজে মেয়েদের শুভেচ্ছা জানিয়ে একটা শব্দও লেখা হয়নি!