হামজাকে বরণ করে নিতে কতটুকু প্রস্তুত বাংলাদেশ
‘বাংলাদেশের সমর্থকদের সঙ্গে ভালো সম্পর্ক আমার। আমি যেন বাংলাদেশের হয়ে খেলি, এই মেসেজ আমি প্রতিদিন পাই’—কথাটি হামজা দেওয়ান চৌধুরীর। হামজার কথা ধরে বলতে চাই, আমি সেই সমর্থকদেরই একজন।
৪ জুলাই ২০১৯
‘আমি ভালা আছি। আপনি কী রকম আছেন’—৮ হাজার ২২ কিলোমিটার (গুগলের তথ্যমতে) দূর থেকে ভেসে আসা কণ্ঠটা মুহূর্তের মধ্যে আমাকে চমকে দিয়েছিল। ইংরেজি প্রশ্নের প্রত্যুত্তরে অপ্রত্যাশিত বাংলা জবাবে যে এত রোমাঞ্চঠাসা, সেদিনের আগপর্যন্ত আমার জানা ছিল না!
কারণ, ফোনের অপর প্রান্তের মানুষটি বাংলাদেশি বংশোদ্ভূত ইংল্যান্ডের ফুটবলার হামজা। আনন্দের বিষয় হলো, এখন তাঁর নামের পাশে লিখতে পারছি বাংলাদেশের ফুটবলার।
হামজার সঙ্গে আমার যোগাযোগ একজন ক্রীড়া সাংবাদিক হিসেবে। আমি তখন প্রথম আলোতে কাজ করি। নাম ও পদবিতে বাংলাদেশি হলেও বিশ্বের অন্যতম সেরা ইংলিশ প্রিমিয়ার লিগ ফুটবলে খেলা ছেলেটির মুখে সিলেটের আঞ্চলিক বাংলা শুনে অবাক না হয়ে উপায় ছিল না।
সেদিন প্রায় ১০ মিনিট ভিডিও আলাপের শুরুতে সিলেটের আঞ্চলিক বাংলায় ‘দ্যাশি (দেশি) ভাই’ বলে আড়মোড়া ভেঙেছিলেন হামজা নিজেই। পরে সেই গল্প সিলেট হবিগঞ্জের দেওয়ানবাড়ি থেকে শুরু করে ইংল্যান্ডের লেস্টার সিটি ঘুরে এসে থেমেছিল আলোর পথ খোঁজা বাংলাদেশের ফুটবলের অন্ধকার গলিতে। সেই অন্ধকার গলিতে অবশেষে আশার আলোর সলতে জ্বালিয়ে দিয়েছেন হামজা।
হামজা চৌধুরীকে পেতে বাংলাদেশের সময় লেগেছে চার বছর। গত বৃহস্পতিবার এ দেশের ফুটবলপ্রেমীরা পান হামজার লাল–সবুজের হয়ে খেলার ছাড়পত্রের সুখবর।
মাত্র দুই দিন আগে ইংল্যান্ডের হয়ে অনূর্ধ্ব-২১ ইউরো চ্যাম্পিয়নশিপ খেলে ইতালি থেকে ইংল্যান্ডে ফিরেছিলেন হামজা। স্বাভাবিকভাবেই তাঁর গায়ে তখনো লেগেছিল ইংল্যান্ডের জার্সির ঘ্রাণ। একই সঙ্গে ইংল্যান্ড জাতীয় দলের হয়ে খেলার স্বপ্নও এবং সেটাই স্বাভাবিক।
এমন এক খেলোয়াড় ১৮৮ র্যাঙ্কিংধারী (বাংলাদেশের তৎকালীন র্যাঙ্কিং) বাংলাদেশের হয়ে খেলবেন কি না? এই প্রশ্ন করা ছিল দুঃসাহসের মতো । তবু হামজার প্রতি বাংলাদেশের মানুষের আবেগ ও ভালোবাসার কথা জানানোর সঙ্গে জাতীয় দলের অধিনায়ক ডেনমার্কপ্রবাসী জামাল ভূঁইয়ার প্রসঙ্গ তুলে জিজ্ঞাসা করেছিলাম, ‘বাংলাদেশ জাতীয় দলে আপনাকে দেখা যাবে কি না?’ এ প্রশ্নের জবাবে হামজা বলেছিলেন, ‘বাংলাদেশের জার্সি পরে খেলতে পারলে আমার ভালা লাগত। বাংলাদেশের কথা মনে পড়ে সব সময়।’
একই সঙ্গে বাস্তবের জমিনে পা রেখেও হামজা বলেছিলেন, ‘আমি এখন ইংল্যান্ড দলের হয়ে খেলার স্বপ্ন দেখি। যুব দলে যখন খেলছি, তখন জাতীয় দলের হয়েও খেলতে পারব।’
তবু ফুটবল-সমর্থক হিসেবে আশা ছাড়িনি। সেই আশার পালে প্রতিনিয়ত অনুপ্রেরণা দিয়েছেন প্রথম আলোর সম্পাদক মতিউর রহমানসহ প্রথম আলো ক্রীড়া বিভাগ। ক্রীড়াবান্ধব সম্পাদকের সঙ্গে চলতে–ফিরতে দেখা হলেই, ‘উস্তাদ, আপনার হামজার খবর কী?’ এ ছাড়া তাঁর সিগনেচার টাইপ প্রশ্ন, ‘বাংলাদেশের ফুটবল নিয়ে আমাকে এমন একটা ভালো নতুন তথ্য দিন, যেটা আমি জানি না।’
প্রতিদিন এমন নতুন নতুন তথ্য কোথায় পাই! তাই খোঁজার তাড়নাটা ছিল। সেই তাড়না থেকেই হামজার পেছনে আমাদের লেগে থাকা। পরবর্তী সময়ে সহকর্মী নাইর ইকবাল ভাইসহ বেশ কয়েকজন ক্রীড়া সাংবাদিক হামজার পরিবারের সঙ্গে যোগাযোগের চেষ্টা চালিয়ে গিয়েছেন নিয়মিত।
২০২০ সালের ৪ জুলাই হামজার সঙ্গে অনেক সময় নিয়ে কথা বলা হলো আবার। এবার তিনি বাংলাদেশে খেলার ব্যাপারে নির্দিষ্ট টাইমলাইন দিয়ে দিলেন, ‘আমি আগে ইংল্যান্ডের জার্সিতে খেলার স্বপ্ন দেখি। আমি আরও দুই বছর চেষ্টা করব ইংল্যান্ড জাতীয় দলে জায়গা করে নেওয়ার। এরপর পরিস্থিতি বিবেচনা করে বাংলাদেশের হয়ে খেলার ব্যাপারে ভাবব।’
হামজাকে পেতে সময় লেগেছে চার বছর। গত বৃহস্পতিবার বাংলাদেশের ফুটবলপ্রেমীরা পান হামজার লাল–সবুজের হয়ে খেলার ছাড়পত্রের খবর। লম্বা এ সময়ের শেষটা মধুময় হওয়ার জন্য বাংলাদেশের ফুটবলপ্রেমীদের বাংলাদেশ ফুটবল ফেডারেশনকে (বাফুফে) ধন্যবাদ দিতেই হবে। হামজাকে পাওয়ার ব্যাপারে দেশের ফুটবলের সর্বোচ্চ সংস্থা সর্বোচ্চ চেষ্টা চালিয়ে শেষ পর্যন্ত সফল হয়েছে।
কোনো সন্দেহ নেই, বাংলাদেশের ফুটবলে এক বিশাল জনস্রোত নিয়ে আসছেন হামজা। সবার আগে সমর্থকদের কথা বলতে হবে। দেশের অভিজাত ফুটবল–সমর্থকদের ড্রইংরুমেও তো ঢুকে গেল বাংলাদেশের ফুটবল। এরপর ধীরে ধীরে আসবে একলাফে বাংলাদেশ জাতীয় দলের মানদণ্ড উঁচুতে ওঠার গল্পসহ প্রচার-প্রসার, পৃষ্ঠপোষকতার হাতছানির গল্প। সর্বোপরি বাংলাদেশের ফুটবলে মাঠ ও মাঠের বাইরে অপার এক সম্ভাবনার গল্পই হাতছানি দিয়ে ডাকছে।
আগামী ২৫ মার্চ এশিয়ান কাপ বাছাইয়ে ভারতের বিপক্ষে ম্যাচ দিয়ে বাংলাদেশের জার্সিতে অভিষেক হতে পারে হামজার। একই সঙ্গে একটি প্রশ্নও ওঠে। পৃথিবীর সেরা ইংলিশ প্রিমিয়ার লিগের সাবেক চ্যাম্পিয়ন লেস্টার সিটিতে খেলছেন, ক্লাবের অধিনায়কত্ব করেছেন এবং জিতেছেন এফএ কাপও—এমন একজন খেলোয়াড়কে বরণ করে নিতে প্রস্তুত তো বাংলাদেশ?
প্রশ্নটি ওঠার কারণ, ফুটবল–বিশ্বের তলানিতে থাকা বাংলাদেশের ফুটবল অবকাঠামো ইংল্যান্ডের তুলনায় কিছুই না। হামজা লেস্টার সিটিতে যে সুযোগ–সুবিধার মধ্যে ফুটবল খেলছেন, সে তুলনায় কতটুকু চাহিদা পূরণ করতে পারবে বাংলাদেশ? বাফুফে হামজাকে সন্তুষ্ট করার কোনো চেষ্টার ত্রুটি রাখবে না, এ কথা জোর দিয়েই বলা যায়। কিন্তু বাস্তবতা হলো, বাফুফের সীমাবদ্ধতাও আছে।
বিষয়টি নিয়ে উদ্বিগ্ন হামজার পরিবারও। কাল দুপুরে (ইংল্যান্ডে তখন সকাল ৮টা ৩৭ মিনিট) ফর্টিস এফসি লিমিটেডের প্রেসিডেন্ট শাহিন হাসানের রুমে হামজা প্রসঙ্গে আলোচনা করার সময় হামজার বাবা দেওয়ান গোলাম মুর্শেদ চৌধুরীর ফোন পেলাম। বলা বাহুল্য, হামজাকে বাংলাদেশের হয়ে খেলতে সবচেয়ে বেশি উদ্বুদ্ধ করেছেন তাঁর বাবাই।
হামজার বাবার কথার সারাংশ হলো, সংবাদমাধ্যম মারফত তাঁরা জানতে পেরেছেন, বাংলাদেশ জাতীয় দলে অনেক সময় ফিজিও, ডাক্তার থাকেন না। এরই মধ্যে বিষয়টি নিয়ে হামজার মা তাঁর সঙ্গে কথা বলেছেন। এই বিষয়গুলোর সত্যতা সম্পর্কে নিশ্চিত হওয়ার জন্যই আমাকে ফোন দিয়েছিলেন হামজার বাবা।
হামজার মতো ফুটবলারকে অনেকটা না চাইতেই পেয়ে গেছে বাংলাদেশ। সেটা সৌভাগ্যবশত বললে ভুলও হয় না। একজন বিশ্বমানের ফুটবলার তৈরি করার প্রক্রিয়াটাই তো জানা নেই বাংলাদেশের। অথবা জানা থাকলেও সেই পথে হাঁটা হয়নি কখনো।
হামজার বাবাকে বোঝানোর চেষ্টা করলাম, বাংলাদেশ দলের সঙ্গে ভালো ফিজিও ও ডাক্তার থাকেন। সবচেয়ে বড় কথা, হামজার বিষয়টি নিয়ে বাফুফের নতুন কমিটি খুবই উচ্ছ্বসিত এবং একই সঙ্গে সতর্কও। একজন সমর্থক হিসেবে যতটুকু জানি, হামজার জন্য সর্বোচ্চ সাপোর্টের ব্যবস্থা রাখবে বাফুফে।
তবু লম্বা আলাপে হামজার বাবার শেষ কথাটি ছিল, সবার আগে এই বিষয়গুলোর পুরোপুরি নিশ্চয়তা পাওয়া প্রয়োজন। বাবা হিসেবে এটা খুবই স্বাভাবিক। কারণ, ভদ্রলোক ভালো করে জানেন, কোনো কিছুর কমতি থাকলে লেস্টার সিটি খেলোয়াড় ছাড়তে অপারগতা প্রকাশ করতে পারে। আর ক্লাব ও জাতীয় দলের মধ্যে সাপে-নেউলে সম্পর্ক তো এখন বিশ্ব–ফুটবলেরই নিয়মিত চিত্র।
প্রসঙ্গক্রমে বলতেই হচ্ছে, সাধারণত বাংলাদেশ জাতীয় দল টুর্নামেন্টের আগে লম্বা সময় ক্যাম্প করে। কিন্তু ক্যাম্পে চাইলেই তো আর হামজাকে পাওয়া যাবে না। আন্তর্জাতিক নিয়ম অনুযায়ী ফিফা উইন্ডোতে ৭২ ঘণ্টা আগে প্লেয়ার ছেড়ে থাকে ক্লাবগুলো। বড় দলগুলো খেলোয়াড় ছাড়ার সময় জুড়ে দেন কিছু শর্তও। বিশেষ করে ফুটবল অবকাঠামোতে পিছিয়ে থাকা দেশগুলোর জন্য সেগুলো মানা কষ্টসাধ্য।
খেলোয়াড়দের সুরক্ষার কথা বিবেচনা করে সবচেয়ে বেশি গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠে মেডিকেল টিম। আমাদের দেশের প্রেক্ষাপটে শুনলে অবাক হতেই হয়, সিমন মোরিসের অধীন লেস্টার সিটির মেডিকেল টিমের সদস্য ১৪ জন। আর বাংলাদেশ? আঙুলের কর ওপরের দিকে ওঠে না! অবশ্য হামজা দলের সঙ্গে যোগ দেওয়ার আগে কী কী করতে হবে, তা বাফুফে সভাপতি তাবিথ আউয়ালের অজানা নয়।
মানুষের আগ্রহ আর ভালোবাসা হামজাকে এতটাই আপ্লুত করেছে যে হামজা হয়তো ধরেই নিয়েছেন, এ দেশের ফুটবল থেকে ‘যেটুকু না হলেই নয়’, তেমন সুযোগ-সুবিধাটুকু তিনি পাবেনই! হামজার সেই বিশ্বাসটুকু মজবুত করাই এখন বাফুফের বড় দায়িত্ব।
হামজার মতো ফুটবলারকে অনেকটা না চাইতেই পেয়ে গেছে বাংলাদেশ। সেটা সৌভাগ্যবশত বললে ভুলও হয় না। একজন বিশ্বমানের ফুটবলার তৈরি করার প্রক্রিয়াটাই তো জানা নেই বাংলাদেশের। অথবা জানা থাকলেও সেই পথে হাঁটা হয়নি কখনো। সেখানে প্রিমিয়ার লিগে খেলা একজন ফুটলার যখন স্বেচ্ছায় ধরা দেন, তখন তা প্রত্যাশাকেও ছাড়িয়ে যায়। হামজার কথাটাই একবার ভাবুন?
বাংলাদেশের ফুটবল সম্পর্কে দূর থেকে যতটুকু জানা যায়, ততটুকুই জেনেছেন। বাংলাদেশের হয়ে ফুটবল খেলতে এলে বাফুফে তাঁকে কোথায় রাখবে, কী খাওয়াবে, কোন সুযোগ-সুবিধা পাবেন— এসব ‘সাধারণ জিজ্ঞাসা’ হয়তো হামজা আগ বাড়িয়ে নিজ থেকে খোঁজ নিতেও যাননি। আবার এটাও সত্যি, দেশের জার্সি গায়ে চাপানোর আগেই এই দেশের লোকেদের কাছ থেকে এমন ভালোবাসাও কেউ পাননি। এই নিবিড় ভালোবাসা হামজাকেও ছুঁয়ে গেছে, নইলে এখন কেন হামজার বাবা অবাক হচ্ছেন?
এসব প্রশ্ন তো আগেও জানতে চাইতে পারতেন। মানুষের আগ্রহ আর ভালোবাসা হামজাকে এতটাই আপ্লুত করেছে যে হামজা হয়তো ধরেই নিয়েছেন, এ দেশের ফুটবল থেকে ‘যেটুকু না হলেই নয়’, তেমন সুযোগ-সুবিধাটুকু তিনি পাবেনই! হামজার সেই বিশ্বাসটুকু মজবুত করাই এখন বাফুফের বড় দায়িত্ব।
এত সব আড়ম্বরের আতিশয্যে এখন বাংলাদেশের কাজ তো আসলে এটাই। হামজার মতো ফুটবলারকে ধারণ করার ক্ষমতা যে বাংলাদেশের আছে, সেটুকু নিশ্চিত করা।
হামজা জানেন, এই দেশের মানুষ তাঁকে কত ভালোবাসেন, তাঁর জন্য কতটা হৃদয় উজাড় করে ভালোবাসার ময়দান বিছিয়ে রেখেছেন ফুটবল অবকাঠামোতে পিছিয়ে থাকা বাংলাদেশের মানুষ। তবু পেশাদার ফুটবলার বলে কথা! তাই হামজার বরণের ন্যূনতম লজিস্টিক সাপোর্ট পূরণের প্রস্তুতিটা শুরু হোক এখনই।
✍️রাশেদুল ইসলাম, জাতীয় দলের সাবেক ফুটবলার ও ম্যানেজার ফর্টিস এফসি লিমিটেড