ভিনিসিয়ুসের ঘটনায় মেসি-রোনালদো কেন চুপ
প্রশ্নটা তুলেছে ব্রাজিলের সংবাদমাধ্যম ‘গ্লোবো’। তবে চাইলে এই প্রশ্ন তুলতে পারেন সবাই।
ভিনিসিয়ুসের বর্ণবাদের শিকার হওয়ার পাঁচ দিন পার হয়ে গেল। বলতে গেলে গোটা ফুটবল-বিশ্বই সোচ্চার হয়ে পাশে দাঁড়িয়েছে ব্রাজিল তারকার। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে বর্ণবাদের বিরুদ্ধে একের পর এক পোস্ট করছেন সাবেক ও বর্তমান ফুটবলাররা।
শুধু ফুটবল নয়, লুইস হ্যামিল্টনের মতো অন্য খেলার তারকারাও ভিনির পাশে দাঁড়িয়েছেন। ফিফা সভাপতি প্রতিবাদ করেছেন, জাতিসংঘের মানবাধিকারবিষয়ক হাইকমিশনারও বর্ণবাদের বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়েছেন।
একই ভূমিকায় যুক্তরাস্ট্রের পররাষ্ট্র দপ্তরের মুখপাত্র ম্যাথু মিলারও। ভ্যালেন্সিয়ার মাঠে ভিনির বর্ণবাদী আচরণের শিকার হওয়াকে ‘ভয়ংকর’ বলেছেন। কিন্তু বর্তমান ফুটবল-বিশ্বে সবচেয়ে বড় তারকা হিসেবে যাঁদের বিবেচনা করা হয়, সেই মেসি-রোনালদো এখনো চুপ। ভিনিসিয়ুসের এই ঘটনা নিয়ে তাঁদের মুখে কেন কুলুপ?
এমন নয় যে ভিনির সঙ্গে দুজনের সম্পর্ক খুব খারাপ। আবার এটাও ভেবে নেওয়া ভুল হবে, মেসি-রোনালদো এমনই। অন্য কারও সুখ-দুঃখ নিয়ে তাঁদের কোনো মাথাব্যথা নেই। এর আগেও বিভিন্ন বিষয়ে ভুক্তভোগী খেলোয়াড়দের পাশে দাঁড়িয়েছেন দুই কিংবদন্তি। আর পৃথিবীও তো সেই আগের মতো নেই—স্পেনে একটা ঘটনা ঘটবে আর বিশ্বের আনাচকানাচে ছড়িয়ে পড়তে কয়েক দিন লাগবে!
প্রযুক্তির কল্যাণে পৃথিবী এখন অনেক ছোট—অন্তত যোগাযোগের দিক থেকে। এখন কোথাও কোনো ঘটনা ঘটলে সবার জানতে আর দিন পার হয় না। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ও অনলাইন পোর্টালের কল্যাণে পুরো পৃথিবীর খবর জানতে কয়েক মিনিট লাগে! তাই ভিনিসিয়ুসের ঘটনা যে মেসি-রোনালদোর কানে যায়নি, তা ভেবে নেওয়ার কোনো সুযোগ নেই। কিন্তু সংবাদমাধ্যমে প্রতিবাদ জানানো দূরঅস্ত, সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমেও ভিনিসিয়ুসকে নিয়ে কেউ একটি বর্ণও লেখেননি, বর্ণবাদের প্রতিবাদে কোনো পোস্টও দেননি। কেন?
অথচ ভিনিসিয়ুস কিন্তু লিওনেল মেসি-ক্রিস্টিয়ানো রোনালদোকে স্মরণ করেছিলেন। ভ্যালেন্সিয়ার মাঠে দর্শক গ্যালারি থেকে ‘বানর’ কটূক্তি শোনার পর ম্যাচ শেষে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ভিনি নিজের প্রথম পোস্টেই স্মরণ করেছিলেন দুই কিংবদন্তিকে, ‘...যে চ্যাম্পিয়নশিপ (লা লিগা) আগে রোনালদিনিও, রোনালদো, ক্রিস্টিয়ানো, মেসিদের ছিল, সেটাই এখন বর্ণবাদীদের দখলে...।’
এই কথা চাইলে আরেকটু ভাঙা যায়। পোস্টে ভিনি যাঁদের নাম উল্লেখ করেছেন, তাঁদের সবাই একসময় লা লিগা মাতিয়েছেন। রিয়াল মাদ্রিদ উইঙ্গার এই একই প্রতিযোগিতায় বারবার (২০২১ থেকে এ পর্যন্ত মোট ১০ বার) বর্ণবাদী আচরণের শিকার হয়ে শেষ পর্যন্ত ক্ষোভে ফেটে পড়েছেন এবং কিংবদন্তিদের স্মরণ করেছেন।
এসব কিংবদন্তির কেউই ভিনির আর্তনাদে সাড়া দিতে বাধ্য নন, কিন্তু খেলাধুলায় ‘লিগ্যাসি’ বলে একটা কথা আছে। রোনালদিনিও, লিওনেল মেসি-ক্রিস্টিয়ানো রোনালদোদের কল্যাণেই লা লিগাকে একসময় বিশ্বের সেরা লিগ বিবেচনা করা হতো। এখন সে প্রতিযোগিতাই যখন বর্ণবাদের বিষে জর্জরিত, তখন কি তাঁরা হাত গুটিয়ে বসে থাকতে পারেন? একজন সাধারণ ফুটবলপ্রেমী কিন্তু এই প্রশ্ন তুলতেই পারেন। নিজেদের তারকাখ্যাতিটা তাঁরা যে উচ্চতায় তুলেছেন, সেদিকে তাকিয়ে এই প্রত্যাশা আর যা-ই হোক দোষের কিছু না।
রোনালদিনিও ও ‘ফেনোমেনন’খ্যাত ব্রাজিলের রোনালদো বর্ণবাদের বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়ে ভক্তদের সে প্রত্যাশা মিটিয়েছেন। কিন্তু মেসি-রোনালদোর ভক্ত দুনিয়াজোড়া হলেও তাঁদের কপালে এটুকুও জোটেনি। কে জানে, ভ্যালেন্সিয়ার গ্যালারিতে যে সমর্থক/সমর্থকেরা ভিনিকে কটূক্তি করেছেন, তাঁদের কেউ কেউ হয়তো মেসি-রোনালদোর সমর্থক—যেহেতু দুজনের তারকাখ্যাতি বৈশ্বিক এবং অনেকেই তাঁদের অন্ধের মতো অনুসরণ করেন। তাই কে জানে দুই কিংবদন্তির বর্ণবাদবিরোধী একটা পোস্টে হয়তো সেসব বর্ণবাদীদের চৈতন্য ফিরলেও ফিরতে পারত! ভক্তদের জায়গা থেকে বিচার করলে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে তাঁদের একটা পোস্টের কী ক্ষমতা—সেটা কারও অজানা না।
লা লিগা সভাপতি হাভিয়ের তেবাসের বলা একটি কথাও স্মরণ করিয়ে দেওয়া যায়। ভিনিসিয়ুস কেন বারবার বর্ণবাদের শিকার, তার ব্যাখ্যায় তেবাস বুঝিয়েছেন, ভিনিসিয়ুস মেসি-রোনালদোর মতোই গ্রেট খেলোয়াড়। লা লিগায় একসময় ‘মেসি-রোনালদোকে সবচেয়ে বেশি অপমান সহ্য করতে হয়েছে, এখন ভিনিসিয়ুস লক্ষ্যবস্তু—কারণ সে গ্রেট খেলোয়াড়।’
তেবাসের এই কথায় নির্দিষ্ট কিছু ভক্তের মানসিকতাটা বুঝে নেওয়া যায়। লোকে তারকা খেলোয়াড়দেরই ভালোবাসে বেশি, নিন্দাও করে বেশি। সেসব নিন্দা কখনো কখনো সীমা লঙ্ঘন করে বর্ণবাদের কালো থাবায় রূপ নিয়েছে। আর সেসব কথা শোনার জ্বালা তাঁদের চেয়ে ভালো কে বুঝবে! এমন পরিস্থিতি কীভাবে মোকাবিলা করতে হয়, সেটাও তাঁদের জানা।
দুই কিংবদন্তি এমনিতে অন্য সময় ভিনির প্রশংসায় পঞ্চমুখ থাকলেও প্রয়োজনের সময় তাঁদের চুপ থাকাটা প্রশ্নবোধক চিহ্ন এঁকে দিয়েছে—মেসি-রোনালদোর পরবর্তী প্রজন্মের সেরা হিসেবে যেহেতু কিলিয়ান এমবাপ্পে-ভিনিসিয়ুসদের বিবেচনা করা হয়, তাই এ পরম্পরার প্রতি দায়বদ্ধ থেকে দুই কিংবদন্তি কি ভিনির জন্য মুখ খুলতে পারতেন না? এই মেসি-রোনালদোই যখন ভিনির জায়গায় ছিলেন, তখন তাঁরা কোনো সমস্যার ভেতর দিয়ে গেলে সমাধান দিয়েছেন পূর্বসূরি কিংবদন্তিরা। কিন্তু ভিনির বেলায় অন্তত তাঁদের কাছ থেকে সেই চেষ্টার লেশমাত্র দেখা যায়নি।
ভিনি বর্ণবাদী আচরণের শিকার হওয়ার পর সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে একটি পোস্ট করেছেন মেসি। সাবেক ক্লাব বার্সেলোনায় তাঁর দীর্ঘদিনের সতীর্থ ও বন্ধু জর্দি আলবা ক্যাম্প ন্যু ছাড়ার ঘোষণা দিয়েছেন—তাঁকে শুভেচ্ছা জানিয়ে পোস্টটি করেছেন মেসি। রোনালদো করেছেন তিনটি পোস্ট—একটি দলের হয়ে গোল উদ্যাপন, আরেকটি স্পনসরশিপ চুক্তির ঘোষণা এবং অন্যটি পুলে সাঁতারের।
অথচ ইনস্টাগ্রামে রোনালদোর অনুসারীর সংখ্যা সবচেয়ে বেশি—প্রায় ৫৮ কোটি ৫০ লাখ। ইনস্টাগ্রামে লিওনেল মেসির অনুসারীর সংখ্যা ৪৬ কোটি ৪০ লাখ। দুজনের মোট অনুসারীর সংখ্যা ১০৪ কোটি ৯০ লাখ। কিন্তু এই অনুসারীদের কেউই নিজ নিজ পছন্দের তারকার কাছ থেকে বর্ণবাদ নিয়ে টুঁ শব্দটি পর্যন্ত শোনেননি!
অনেকটা বাধ্য হয়েই মেসি-রোনালদোর দায়িত্বটা স্মরণ করিয়ে দিয়েছেন ইনস্টাগ্রামে তাঁদের অনুসারীরাই। মেসির সর্বশেষ পোস্টেই এক অনুসারী জানতে চেয়েছেন, ভিনিসিয়ুসের বিষয়ে তাঁর অবস্থান কী? বর্ণবাদের বিরুদ্ধে অবস্থান নিতে মিলিয়ন মিলিয়ন অনুসারী নিয়ে কোথায় গেলে—মেসিকে প্রশ্ন করেছেন তাঁরই এক অনুসারী। রোনালদোকেও ইনস্টাগ্রামে একই সুরে প্রশ্ন করেছেন তাঁর এক ভেনেজুয়েলান ভক্ত, ‘এটা কীভাবে সম্ভব যে বর্ণবাদ নিয়ে আপনি কিছুই বলছেন না?’
অথচ ফুটবলে একদম পশ্চাৎপদ দেশগুলোর একটি বাংলাদেশ থেকেও ভিনিসিয়ুসের জন্য প্রতিবাদের ঢেউ উঠেছে। জামাল ভূঁইয়া কিংবা তপু বর্মণরা সে সময় পাননি। প্রতিবাদটি করেছেন বাংলাদেশ নারী জাতীয় দলের ফুটবলার সানজিদা আক্তার, ‘এটি কোনোভাবেই সমর্থনযোগ্য নয় যে একজন প্রতিভাবান স্পোর্টস পারসনের গায়ের রংকে উদ্দেশ্য করে কথা বলে তাকে মানসিকভাবে আহত করা হবে। রেসিজমের (বর্ণবাদ) বিরুদ্ধে এই প্রতিবাদ অনেক পুরোনো হলেও সেটির প্রতিকার খুব একটা ঘটেনি। শুধু থেকে গেছে টুইটারের হ্যাশট্যাগ কিংবা ক্যাপ্টেনের আর্মব্যান্ড পর্যন্ত। আমরা এখনো মনের অজান্তে কিংবা জ্ঞানের স্বল্পতায় পাশের একজনকে এভাবে আঘাত করে বসি। অন্যায়ের বিরুদ্ধে প্রতিবাদী হওয়ার যে ব্যাপারটি ভিনির মধ্যে রয়েছে, সেটিকে আমি সমর্থন করি।’
সানজিদা কাল একই পোস্টে আরও লিখেছেন, ‘ভিনির মাধ্যমে রেসিজমের শিকড় নির্মূল হোক। ভিনির পরবর্তী অনুজেরা যেন আরও সুন্দর, স্বচ্ছ পরিবেশে ফুটবল খেলতে পারে, ভিনির প্রতিবাদের মাধ্যমে সেই ব্যবস্থা হোক। অগণিত মাইল দূর থেকে একজন ক্রীড়াবিদ হিসেবে ভিনির প্রতিবাদের প্রতি শ্রদ্ধা, সম্মান ও পূর্ণ সমর্থন জ্ঞাপন করছি।’
দূরত্ব যা-ই হোক, যেকোনো খেলাধুলার ভাষাই এক। পৃথিবীর সবচেয়ে জনপ্রিয় ও প্রচলিত খেলা ফুটবলে তো আরও বেশি। আর প্রযুক্তির আশীর্বাদে এই পৃথিবীও যেন এখন একটি দেশ—যেখানে যাই ঘটুক না কেন, মুহূর্তের মধ্যে খবর ছড়িয়ে পড়ে অনলাইন মাধ্যমগুলোয়। খেলাধুলার জন্য ব্যাপারটা আশীর্বাদ, কারণ কোনো ঘটনা ঘটলে পৃথিবীর সব ফুটবলার শুধু সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে পোস্টের মাধ্যমেই নিজেকের একসূত্রে গাঁথতে পারেন।
বৈশ্বিক তারকাখ্যাতির তুলনায় কিছুই না হয়েও সানজিদা শুধু ফুটবলার হিসেবে নিজেকে শামিল করেছেন বর্ণবাদবিরোধী মিছিলে। এর পাশাপাশি সামাজিক দায়বদ্ধতা বলেও একটি বিষয় থাকে। তারকাদের এটি থাকেই। কোনোভাবেই অস্বীকার করা যায় না, কারণ তাঁদের অনুসারীরা এই পৃথিবীর নানামুখী সমাজেরই অংশ। তাঁরা যখন কাউকে তারকা বানিয়ে তোলেন, তখন সেই তারকার শক্তিও সেসব মানুষেরাই—আর ঠিক এখানেই ‘স্পাইডারম্যান’ সিনেমার সেই সংলাপটা মনে করিয়ে দেওয়া যায়, ‘উইথ গ্রেট পাওয়ার কামস গ্রেট রেসপনসিবিলিটি।’
ভিনিসিয়ুসকে নিয়ে মেসি-রোনালদো এই দায়িত্ব পালনে বাধ্য নয়, কিন্তু সানজিদাদের মতো খেলোয়াড়েরা যখন বর্ণবাদের প্রতিবাদ জানান, তখন সেই ১০৪ কোটি ৯০ লাখ অনুসারীর জন্য দুঃখ হতেই পারে। বর্ণবাদ নিয়ে তাঁদের সচেতন করার দায়িত্বটা যাঁদের, সেই মেসি-রোনালদোই যে মুখে কুলুপ এঁটে চুপ!