মরিনিও কি কখনো নিজেকে শোধরাবেন না
উয়েফা আয়োজিত প্রতিযোগিতায় এএস রোমার শিরোপার আক্ষেপ ছিল চিরকালের। জোসে মরিনিও এসেই রোমার সেই আক্ষেপ ঘোচান। ইতালিয়ান ক্লাবটিকে এনে দেন কনফারেন্স লিগ শিরোপা। ‘ওয়ান ব্রিংস অ্যানাদার’ কথাটার সার্থকতা প্রায় পূরণ হয়েই যাচ্ছিল। কিন্তু বুদাপেস্টে বুধবার রাতে ইউরোপা লিগের ফাইনালে টাইব্রেকারে সেভিয়ার কাছে হেরে যায় রোমা। নিজেদের ‘সম্পত্তি’ বানিয়ে ফেলা ট্রফিটা পুনরুদ্ধার করে সেভিয়া।
তাতে ইউরোপীয় ফাইনালে মরিনিওর শতভাগ সাফল্যের রেকর্ড শেষ হয়ে যায়। রানার্সআপের পদকটা নিলেও তাই নিজের কাছে রাখেননি পর্তুগিজ কোচ। দিয়েছেন এক খুদে ভক্তকে। পদক নিজের কাছে না রাখা নিয়ে বলেছেন, ‘হ্যাঁ, এটাই আমি করেছি। রুপার (রানার্সআপ) পদকের প্রয়োজন নেই আমার। এটি আমি চাই না। এ জন্য দিয়ে দিয়েছি।’
বোঝাই যাচ্ছে, ফল ছাপিয়ে ম্যাচটা আলোচনায় এসেছে মরিনিওর কারণেই। নির্ধারিত ও অতিরিক্ত সময়ে ১-১ গোলে সমতায় থাকা ম্যাচে আর্জেন্টাইন তারকা পাওলো দিবালার গোলে এগিয়ে যায় রোমা। দ্বিতীয়ার্ধে জিয়ানলুকা মানচিনির আত্মঘাতী গোলে সমতা আনে সেভিয়া। স্প্যানিশ ক্লাবটি পরে পেনাল্টি শুটআউটে জেতে ৪-১ ব্যবধানে।
ইউরোপীয় ফাইনালে প্রথম হারের স্বাদ পাওয়ার পর রেফারির দিকে আঙুল তুলতে দেরি করেননি মরিনিও। দ্বিতীয়ার্ধে সেভিয়ার পেনাল্টি বক্সে দলের এক ডিফেন্ডারের হাতে বল লাগলেও ইংলিশ রেফারি অ্যান্থনি টেইলর কেন পেনাল্টি দেননি, তা নিয়ে ক্ষোভ ঝাড়েন মরিনিও। এতে দেখেন হলুদ কার্ড।
শুধু তা–ই নয়, স্টেডিয়ামের পার্কিং লটেও টেইলরের ওপর চড়াও হন রোমা কোচ। মরিনিওর ‘উসকানি’ পেয়ে রোমা সমর্থকেরা তো বিমানবন্দরে টেইলর ও তাঁর পরিবারকে আক্রমণও করেন। এই যে নিজের আচরণ দিয়ে রেফারি টেইলর ও তাঁর পরিবারের বিরুদ্ধে রোমা সমর্থকদের উসকে দেওয়া, এর দায় কি মরিনিও এড়াতে পারেন? উগ্র কোনো সমর্থক যদি এখন টেইলর কিংবা তাঁর পরিবারের সঙ্গে সহিংস কিছু করে বসেন, সেটার দায় কি মরিনিওর ওপরেও বর্তাবে না?
অবশ্য রেফারি টেইলরের উদ্দেশে অপমানজনক বা অশালীন ভাষা ব্যবহার করার দায়ে এরই মধ্যে অভিযুক্ত করা হয়েছে মরিনিওকে। তবে এটা তাঁর জন্য নতুন কিছু নয়। বিতর্ক তৈরি করা তাঁর অভ্যাস।
এফসি পোর্তো ও ইন্টার মিলানকে চ্যাম্পিয়নস লিগ জেতানো, চেলসিকে তিনবার প্রিমিয়ার লিগ জেতানো, ম্যানচেস্টার ইউনাইটেডের আট বছরের ইউরোপীয় শিরোপার অপেক্ষা ফুরানো কিংবা রোমাকে প্রথম ইউরোপীয় ট্রফির স্বাদ পাইয়ে দেওয়া—নিজেকে আক্ষরিক অর্থেই ‘স্পেশাল ওয়ান’ প্রমাণ করেছেন। কিন্তু একটু উনিশ-বিশ হলেই কিংবা সিদ্ধান্ত তাঁর দলের পক্ষে না গেলেই ম্যাচ পরিচালনাকারীদের সঙ্গে লেগে যাওয়ার স্বভাব আগেও ছিল, এখনো আছে মরিনিওর। বরং ‘বুড়ো’ বয়সে সেটা বেড়ে গেছে। নয়তো কী আর এ মৌসুমে ইউরোপের শীর্ষ পাঁচ ঘরোয়া লিগের কোচদের মধ্যে সর্বোচ্চ তিনবার লাল কার্ড দেখেন!
মরিনিওর কোচিং ইতিহাস বলছে, তিনি যে ক্লাবেই গেছেন, সেখানেই কোনো না কোনো বিতর্কের জন্ম দিয়েছেন। বারবার সতর্ক করা হলেও তিনি কখনো পাত্তা দেন না। কয়েক ম্যাচ নিষেধাজ্ঞার শাস্তি পেলে বা জরিমানা গুনলেও নিজেকে শোধরান না। ছোট ক্লাবের অখ্যাত কোচরা এমন আচরণ করলে হয়তো আজীবন নিষিদ্ধ হতেন কিংবা দীর্ঘদিন তাঁকে ফুটবল থেকে নির্বাসনে পাঠানো হতো। কিন্তু ‘হাই প্রোফাইল’ কোচ বলেই বোধ হয় বারবার পার পেয়ে যান মরিনিও।
মরিনিওকে নিয়ে আরও যত বিতর্ক
ক্যাম্প ন্যুতে ২০০৫ সালে চ্যাম্পিয়নস লিগের শেষ ষোলোর প্রথম লেগে মুখোমুখি হয় বার্সেলোনা-চেলসি। সে সময় চেলসির কোচ ছিলেন মরিনিও। প্রথমার্ধ শেষে ১-০ ব্যবধানে এগিয়ে ছিল তাঁর দল। তবে ম্যাচ শেষে রেফারি আন্দ্রেস ফ্রিস্ক ও বার্সা কোচ ফ্রাঙ্ক রাইকার্ডের বিপক্ষে ফিফার নিয়মভঙ্গের অভিযোগ আনেন মরিনিও। তাঁর দাবি ছিল, বিরতির সময় তিনি রাইকার্ডকে ফ্রিস্কের ড্রেসিংরুমে ঢুকতে দেখেছেন। চেলসি স্ট্রাইকার দিদিয়ের দ্রগবাকে লাল কার্ড দেখাতে সুইডিশ রেফারিকে উৎসাহিত করেন রাইকার্ড। রেফারি দ্বিতীয়ার্ধের শুরুতেই দ্রগবাকে লাল কার্ড দেখান। ১০ জনের চেলসি শেষ পর্যন্ত হেরেছে যায় ২-১ ব্যবধানে। তবে বিরতির সময় ড্রেসিংরুমে ফ্রিস্ক ও রাইকার্ডের কথোপকথনের প্রমাণ না মেলায় মরিনিওকে দুই ম্যাচ নিষিদ্ধ করে উয়েফা। একই সঙ্গে চেলসিকে জরিমানা করা হয়। চেলসির উগ্র সমর্থকেরা তাতে ক্ষুব্ধ হয়ে রেফারি ফ্রিস্ক ও তাঁর পরিবারকে হত্যার হুমকি দিতে থাকেন। প্রাণভয়ে মাত্র ৪২ বছর বয়সেই অবসরে যান রেফারি ফ্রিস্ক।
সান্তিয়াগো বার্নাব্যুতে ২০১১ সালে চ্যাম্পিয়নস লিগ সেমিফাইনালের প্রথম লেগে মুখোমুখি হয় রিয়াল মাদ্রিদ-বার্সেলোনা। সে সময় রিয়ালের কোচ ছিলেন মরিনিও। ম্যাচের ৬১ মিনিটে বার্সার দানি আলভেজকে বাজেভাবে ফাউল করলে রিয়ালের পেপেকে লাল কার্ড দেখান জার্মান রেফারি ভলফগাং স্টার্ক। এ নিয়ে প্রতিবাদ জানান মরিনিও। উয়েফা ও ম্যাচ পরিচালনাকারীদের গালি দিতে থাকেন এই পর্তুগিজ কোচ। ফলে লাল কার্ড দেখতে হয় তাঁকেও। ১০ জনের রিয়ালকে নিয়ে এরপর ছেলেখেলায় মেতে ওঠেন লিওনেল মেসি। জোড়া গোল করে জেতান বার্সাকে। ওই বছর পরে শিরোপাও জেতে বার্সা।
পেদ্রো লিওনকে সে সময় স্পেনের সবচেয়ে সম্ভাবনাময় উইঙ্গার ভাবা হতো। হেতাফের হয়ে আগের মৌসুমে দারুণ খেলে বড় ক্লাবগুলোর নজরে আসেন লিওন। ২০১০ সালে তাঁকে কিনে নেয় রিয়াল। তবে লেভান্তের বিপক্ষে শুধু দ্বিতীয়ার্ধে প্রত্যাশা পূরণ করতে না পারায় মরিনিও তাঁকে ‘একঘরে’ করে ফেলেন। মরিনিওর বাতিলের খাতাতেও উঠে যায় তাঁর নাম। বেচারা লিওন বাধ্য হয়ে ফিরে যান হেতাফেতে। এখনো খেলা চালিয়ে গেলেও তাঁর সম্ভাবনাময় ক্যারিয়ার আসলে সেখানেই শেষ করে দেন মরিনিও।
২০১১ স্প্যানিশ সুপার কাপে মুখোমুখি হয় রিয়াল-বার্সা। চিরপ্রতিদ্বন্দ্বী দুই দলের ম্যাচটি ফুটবলপ্রেমীরা আলাদাভাবে মনে রেখেছেন। সান্তিয়াগো বার্নাব্যুতে প্রথম লেগ ২-২ সমতায় শেষ হয়। ক্যাম্প ন্যুতে ফিরতি লেগে ৩-২ ব্যবধানে জিতে চ্যাম্পিয়ন হয় বার্সা। কিন্তু দুই দলের খেলোয়াড় আর কোচদের হাতাহাতিতে যুদ্ধংদেহী ম্যাচে পরিণত হয় স্প্যানিশ সুপার কাপ। সে সময় বার্সায় পেপ গার্দিওলার সহকারী ছিলেন প্রয়াত তিতো ভিলানোভা। তাঁর চোখে (অক্ষিগোলকে) গুঁতা মারেন মরিনিও। ভিলানোভাও মরিনিওকে ধাক্কা দিয়ে দূরে সরিয়ে দেন।
এ ঘটনায় দুজনকেই নিষিদ্ধ করে স্প্যানিশ ফুটবল ফেডারেশন। যদিও পরবর্তী সময়ে নিজের দোষ স্বীকার করেন মরিনিও। যুক্তরাষ্ট্রে প্রাক্-মৌসুম প্রস্তুতি ম্যাচ খেলতে গিয়ে ফক্স স্পোর্টসকে বলেন, ‘সেদিন আমিই বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি করেছি। এ ধরনের আচরণ করা উচিত হয়নি।’