নামী কোচ, কিন্তু বেকার কাটছে দিন
‘হায়ারিং টু ফায়ারিং’।
অল্প শব্দে মানবসম্পদ ব্যবস্থাপনা বিভাগের কাজ বোঝাতে কথাটা প্রায়ই ব্যবহৃত হয়। একজন কর্মীর নিয়োগ থেকে শুরু করে চাকরি ত্যাগ পর্যন্ত সবকিছু নিয়েই কাজ করে মানবসম্পদ বিভাগ। কাজের ধরনের দিক থেকে মানবসম্পদ কর্মকর্তাদের সঙ্গে ফুটবল কোচদের মেলানো কঠিন। তবু যেটুকু মিল, সেটুকু ওই ‘হায়ারিং টু ফায়ারিং’–এ অংশগ্রহণ। একজন খেলোয়াড়কে দলে ভেড়ানো এবং তাঁকে ছেড়ে দেওয়ার ব্যাপারে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা থাকে কোচের।
তবে ‘হায়ারিং, ফায়ারিং’ নামের ‘আসা-যাওয়ার খেলায় যতটা না খেলোয়াড়েরা, তার চেয়ে অনেক বেশি জড়িয়ে থাকে কোচদের নাম। চাকরিটা তাঁদের এই আছে তো এই নেই। পাঁচ বছরের কোচিং ক্যারিয়ার, এর মধ্যেই পাঁচ-ছয়টা ক্লাবে ঘোরাফেরা করে ফেলার ঘটনা এখানে খুব স্বাভাবিক। নতুন চাকরি খোঁজার জন্য জীবনবৃত্তান্ত হালনাগাদ করতে হয় প্রতিনিয়তই।
ঠিক এ মুহূর্তে যেমন চাকরির বাজারে ঘোরাফেরা করছেন বেশ কয়েকজন নামী কোচ। সেসব ‘বেকার’ কোচের মধ্যে আছে হান্সি ফ্লিক, জিনেদিন জিদান, আন্তোনিও কন্তে, জোসে মরিনিও, ফ্র্যাঙ্ক ল্যাম্পার্ড, হুলেন লোপেতেগি, গ্রাহাম পটারদের মতো বড় নাম। তাঁদের সবাই হন্যে হয়ে চাকরি খুঁজছেন, তা নয়। কেউ কেউ পছন্দের চাকরির জন্য বসে আছেন। কিন্তু বেশির ভাগই কাজ খুঁজতে এখানে-ওখানে জীবনবৃত্তান্ত পাঠিয়ে চলেছেন। চালিয়ে যাচ্ছেন আলোচনা। এর মধ্যে অন্যতম শীর্ষ নাম হান্সি ফ্লিক।
৫৮ বছর বয়সী এই জার্মান গত বছরের সেপ্টেম্বর থেকে ‘বেকার’। বায়ার্ন মিউনিখ কোচ হিসেবে বেশ সফল হওয়ায় (৮৬ ম্যাচে ৭০ জয়, ২০১৯-২০ মৌসুমে ট্রেবল) ২০২১ সালে তাঁকে জার্মানি জাতীয় দলের কোচ করা হয়। কিন্তু সেখানে তাঁর সাফল্যরেখা ছিল নিম্নমুখী। ফ্লিকের অধীন খেলে ২৫ ম্যাচের মাত্র ১২টিতে জেতে জার্মানি। ফলাফল, চুক্তির মেয়াদ বাকি থাকতেই চাকরি হারাতে হয় তাঁকে। এ মুহূর্তে ফ্লিকের নাম শোনা যাচ্ছে বার্সেলোনার সঙ্গে। মৌসুম শেষে কাতালান ক্লাবটির দায়িত্ব ছেড়ে দেবেন বলে ঘোষণা দিয়েছেন জাভি হার্নান্দেজ। বার্সেলোনা তাই নতুন কোচের খোঁজে নেমেছে। এরই মধ্যে ফ্লিকের প্রতিনিধিদের সঙ্গে বার্সেলোনার প্রাথমিক পর্যায়ের যোগাযোগও হয়েছে বলে জানিয়েছে দ্য অ্যাথলেটিক।
ফ্লিকের তুলনায় ক্লাব ফুটবলে কোচ জিদানের সফলতা আরও বেশি। দুই দফায় রিয়াল মাদ্রিদের ডাগআউট সামলানো এই কিংবদন্তি কোচ হিসেবে জিতেছেন ১১টি ট্রফি। টানা তিন বছর চ্যাম্পিয়নস লিগ জেতানো এই ফরাসি ২০২১ সালের পর থেকে কোচিংয়ের বাইরে। ফ্রান্স জাতীয় দলের কোচ হওয়ার ইচ্ছা ছিল তাঁর। কিন্তু দিদিয়ের দেশম কাজ চালিয়ে যাওয়ায় সেই পদ খালি হয়নি। জিদানও তাঁর সামনে আসা প্রস্তাবের কোনোটি পছন্দ না হওয়ায় কাজে নামেননি। কিছুদিন আগে শোনা যাচ্ছিল, ফ্রেঞ্চ লিগ আঁ-র দল মার্শেইয়ের দায়িত্ব নিতে পারেন জিদান। মার্শেইকে সৌদি আরবের পাবলিক ইনভেস্টমেন্ট ফান্ড (পিআইএফ) কিনে নিতে পারে বলে আলোচনা আছে।
জিদান, ফ্লিকদের তুলনায় ক্লাব কোচিংয়ে দীর্ঘ অভিজ্ঞতা জোসে মরিনিওর। ৬১ বছর বয়সী এই পর্তুগিজ প্রধান কোচ হিসেবে কাজ করছেন ২০০০ সাল থেকে। ইতালির ক্লাব রোমা ছিল তাঁর দশম চাকরি। সিরি ‘আ’–তে রোমার পারফরম্যান্স প্রত্যাশা অনুযায়ী না হওয়ায় গত মাসে ক্লাব ছাড়তে হয়েছে মরিনিওকে। ইংল্যান্ড, স্পেন ও ইতালিতে দুই দশকের বেশি সময় কাটিয়ে দেওয়া মরিনিও এবার সৌদি প্রো লিগের আলোচনায় আছেন। আগেও প্রস্তাব ছিল, গ্রহণ করেননি। এবার বেকার থাকায় হয়তো নতুন প্রস্তাব ভেবেও দেখতে পারেন। অবশ্য ইংল্যান্ডের কোনো ক্লাবে ফিরতে দেখা গেলেও অবাক হওয়ার কিছু নেই।
গত প্রিমিয়ার লিগে চাকরি যাওয়া বেশ কয়েকজন কোচও অবশ্য বেকার দিন কাটাচ্ছেন। সাবেক ইতালি কোচ আন্তোনিও কন্তে টটেনহামে চাকরি খুইয়েছেন ২০২৩ সালের মার্চে। এর পর থেকে বিভিন্ন ক্লাবের সঙ্গে আলোচনায় এসেছে ইন্টার মিলান ও চেলসির সাবেক এই কোচের নাম। চারটি সিরি ‘আ’ জেতা কন্তে রোমা বা নাপোলির কোচ হতে পারেন বলে গুঞ্জন আছে। চেলসির সাবেক অধিনায়ক ল্যাম্পার্ড ক্লাবটির অন্তর্বর্তীকালীন কোচ ছিলেন ২০২২-২৩ মৌসুমের শেষ দিকে। এভারটনে কাজ করে যাওয়া ল্যাম্পার্ড নিজের সাবেক ক্লাবে ভালো করতে পারেননি, চাকরিটাও আর স্থায়ী হয়নি।
২০২৩ সালের মার্চে ল্যাম্পার্ড যার জায়গায় দায়িত্ব নিয়েছিলেন, সেই গ্রাহাম পটারও এখন পর্যন্ত বেকার। ব্রাইটন থেকে বড় অঙ্কের অর্থে চেলসিতে যোগ দেওয়া এই ইংলিশ কোচ সাত মাসের কম সময়ের মধ্যে ছাঁটাই হয়েছিলেন। এরই মধ্যে লিঁও এবং রেঞ্জার্স থেকে প্রস্তাব পেলেও ভালো প্রস্তাবের অপেক্ষায় বসে আছেন তিনি। ম্যানচেস্টার ইউনাইটেডে এরিক টেন হাগের উত্তরসূরির আলোচনায় আছে পটারের নাম।
স্প্যানিশ কোচ হুলেন লোপেতেগি ইংলিশ ক্লাব উলভস থেকে চাকরি হারান গত বছরের আগস্টে। স্পেন জাতীয় দল ও রিয়াল মাদ্রিদকে কোচিং করানো এই কোচও আবার প্রিমিয়ার লিগে কোচিং করানোর আগ্রহ নিয়ে বসে আছেন। তাঁদের বাইরে কোচ হিসেবে নতুন চাকরির অপেক্ষায় অন্য বড় নামগুলোর মধ্যে আছে ম্যানচেস্টার ইউনাইটেডের সাবেক কোচ উলে গুনার শুলসার (নভেম্বর ২০২১ থেকে বেকার), ডাচ কিংবদন্তি ও আইন্দহফেনের সাবেক কোচ রুড ফন নিস্টলরয় (মে ২০২৩), আর্জেন্টিনার সাবেক কোচ হোর্হে সাম্পাওলি (সেপ্টেম্বর ২০২৩), নাপোলির সাবেক কোচ রুডি গার্সিয়া (নভেম্বর ২০২৩), সদ্য দক্ষিণ কোরিয়া কোচের পদ হারানো সাবেক জার্মান কোচ ইয়ুর্গেন ক্লিন্সমান (ফেব্রুয়ারি ২০২৪), সাবেক ম্যানচেস্টার ইউনাইটেড তারকা ও বার্মিংহাম সিটির কোচ ওয়েইন রুনিরা (জানুয়ারি ২০২৪)।
সামনের মৌসুমেই তাঁদের সবার ভাগ্যে ‘শিকে’ ছিঁড়বে, তার নিশ্চয়তা অবশ্য নেই। তবে আশার জায়গা একটিই—ফায়ারিং যেহেতু যখন-তখনই হয়, বেকার থাকা যে কেউ যেকোনো সময় ‘হায়ারিং’ও হয়ে যেতে পারেন।