জাদুর অন্য কৌটা খুলেছেন জাবি
তাঁর রক্তে বইছে ফুটবল। খেলোয়াড় হিসেবে ক্লাব ও জাতীয় দলের হয়ে জিতেছেন সম্ভাব্য সবকিছু। খেলেছেন বিশ্বের অন্যতম সেরা তিন ক্লাব রিয়াল মাদ্রিদ, লিভারপুল ও বায়ার্ন মিউনিখে। দুটি ভিন্ন ক্লাবের হয়ে জিতেছেন চ্যাম্পিয়নস লিগ। জাতীয় দলের হয়ে একটি বিশ্বকাপ ও দুটি ইউরো শিরোপাও আছে। অর্থাৎ ট্রফি ক্যাবিনেটে অপূর্ণতা নেই। তাঁর প্রতিবেশী ছিলেন মিকেল আরতেতা আর ভক্ত পেপ গার্দিওলার কোচিংয়ের। এমন একজনের জীবনে অপূর্ণতা বলে কিছু থাকার কথা নয়। কিন্তু মানুষের জীবনই হচ্ছে একটি বৃত্ত ভরাট করে নতুন বৃত্তপূরণের লক্ষ্যে ছুটে চলা। সে ছুটে চলাই জাবি আলোনসোকে এখন নিয়ে এসেছে কোচিংয়ে।
ফুটবলার ও কোচের চ্যালেঞ্জ সম্পূর্ণ ভিন্ন। একজন সফল ফুটবলার ভালো কোচও হবেন, এমন নিশ্চয়তা নেই। চাইলে ইতিহাসের পাতা থেকে না হওয়ার দৃষ্টান্তও খুঁজে আনা যাবে। কোচের জন্য চ্যালেঞ্জটা কেমন, তা বোঝা যায় আর্সেনালের কিংবদন্তি কোচ আর্সেন ওয়েঙ্গারের একটি উদ্ধৃতিতে।
নিজের আত্মজীবনীমূলক বই ‘মাই লাইফ ইন রেড অ্যান্ড হোয়াইট’-এ লিখেছেন, ‘আমি প্রায় ভাবি মৃত্যুর পর সৃষ্টিকর্তার সঙ্গে আমার প্রথম কথা কী হবে, তা নিয়ে। তিনি আমাকে জিজ্ঞেস করবেন জীবনে কী করেছিলে, আমি জীবনকে কীভাবে অর্থবহ করেছি! আমি তাঁকে বলব, আমি চেষ্টা করেছি ম্যাচ জেতার। “এটুকুই?” তিনি জিজ্ঞেস করবেন। হতাশও হবেন। আমি তখন তাঁকে বোঝানোর চেষ্টা করব, আপনি যেমনটা ভাবছেন ম্যাচ জেতা তার চেয়ে অনেক কঠিন।’ কতটা কঠিন, তা প্রতি মৌসুমে ছাঁটাই হওয়া কোচের লম্বা তালিকা দেখলেই স্পষ্ট হওয়া যায়।
খেলোয়াড়ি জীবনের সফল পর্ব শেষ করে সেই কঠিন পথেই এবার হাঁটা শুরু করেছেন আলোনসো। কিন্তু এখন পর্যন্ত কঠিন কাজটা আলোনসোর জন্য অতটা কঠিন মনে হচ্ছে না। বরং কঠিন চ্যালেঞ্জেও জেতার কাজটা ঠিকঠাকই করে চলেছেন। গত মৌসুমে জেরার্দো সিওয়ানের অধীনে আট ম্যাচে মাত্র একটিতে জিতে লেভারকুসেন যখন ধুঁকছিল এবং অবনমনের ডাক শুনছিল, তখন দায়িত্ব নেন আলোনসো।
এরপর জাদুর ছড়ি ঘুরিয়ে সেই দলকে নিয়ে মৌসুম শেষ করেন পয়েন্ট তালিকার ছয়ে থেকে। সে সাফল্য যে কোনো আকস্মিক চমক ছিল না, তা নতুন মৌসুমে এসে ঠিকই প্রমাণ করলেন আলোনসো। চলতি মৌসুমে জিতেছেন টানা ৪ ম্যাচে। যেখানে ৩ গোল হজম করার বিপরীতে গোল করেছে ১৯টি। দলটি আছে বুন্দেসলিগার শীর্ষেও। তবে এই যাত্রার শুরুটা হয়েছিল গত মৌসুমেই। মূলত তখনই নিজের কৌশল ও কোচিংয়ের মুনশিয়ানা দেখান আলোনসো।
আলোনসোর কৌশল এবং দল পরিচালনার সঙ্গে পরিচয় হওয়ার আগে কোচ হিসেবে তাঁকে প্রভাবিত করা কিছু বিষয় জেনে নেওয়া যাক। সান সেবাস্তিয়ানের কালে মাতিয়ায় যেখানে আলোনসোর বেড়ে ওঠা, সেখানে তাঁর প্রতিবেশী ছিলেন আর্সেনালের বর্তমান কোচ মিকেল আরতেতা। ভেবে দেখুন তো, ফুটবলকে অস্তিত্বের সঙ্গে জড়িয়ে নেওয়া দুই ফুটবল-মস্তিষ্ক বেড়ে উঠেছেন একই আলো-বাতাসে, কী দারুণ ব্যাপার! কে জানে, সে সময়ে সান সেবাস্তিয়ানের বাতাসেই হয়তো লুকিয়ে ছিল গোপন কোনো রহস্য।
এমনকি যুবদলেও একসঙ্গে খেলেছিলেন তাঁরা। খুব দ্রুত অবশ্য আলাদাও হয়ে যান। আলোনসো চলে যান রিয়াল সোসিয়েদাদে, আর আরতেতা বার্সেলোনায়। তবে নিয়তি আবারও তাঁদের ভিন্নভাবে এক জায়গায় নিয়ে আসে। আলোনসো যখন ইংলিশ ক্লাব লিভারপুলে খেলছিলেন, তখন আরতেতা ছিলেন লিভারপুলের নগরপ্রতিদ্বন্দ্বী এভারটনে। নিয়তির যোগেই হয়তো এখন একই সময়ের প্রতিশ্রুতিমান দুই কোচ হিসেবে আবির্ভূত হয়েছেন তাঁরা।
আলোনসোর ওপর প্রভাব আছে গায়েলিক ফুটবলেরও (রাগবি ও ফুটবল মিশ্রণে তৈরি একধরনের খেলা যেখানে হাত ও পা উভয় ব্যবহার করা হয়।)। কৈশোরে ইংরেজি শেখার জন্য তিনি যখন স্পেনের বাইরে ছিলেন তখন কিছুদিন গায়েলিক ফুটবল খেলেছিলেন। খেলাটি নিয়ে তাঁর মত ছিল এমন, ‘এটা খুব দ্রুতগতির খেলা এবং খুব কঠিনও।’ অনেকের ধারণা, গায়েলিক ফুটবলের গতির বিষয়টাকে আলোনসো তাঁর কোচিংয়ের কৌশলেও ব্যবহার করে থাকেন।
আলোনসোর রক্তে ফুটবল থাকার বিষয়টি তো শুরুতেই বলা হয়েছে। মূলত তাঁর বাবা পেরিকো তিনবার স্প্যানিশ লা লিগার শিরোপা জিতেছেন। দুবার সোসিয়েদাদের হয়ে এবং একবার বার্সেলোনার হয়ে। এমনকি জাতীয় দলের হয়ে ২০ ম্যাচ খেলার পথে ছিলেন স্পেনের ১৯৮২ বিশ্বকাপের স্কোয়াডেও। তিনি নিজেও সোসিয়েদাদসহ একাধিক ক্লাবের কোচিং করিয়েছেন।
আলোনসোর এক ভাই মাইকেল সোসিয়েদাদ, বোল্টন ও চার্লটনের হয়ে খেলেছেন। অন্য ভাই জন কাজ করেছেন পেশাদার রেফারি হিসেবে। বলা যায়, ফুটবল বুকে জড়িয়েই তাঁর বেড়ে ওঠা। খেলাটাকে তাই তিনি মস্তিষ্কের পাশাপাশি বোঝেন হৃদয় দিয়েও। খেলাটি নিয়ে তাঁর জানাশোনাও যে অগাধ। এরই মধ্যে তাঁর ভালো কোচ হওয়ার সম্ভাবনার কথা বলেছেন খোদ জোসে মরিনিও। প্রশংসা করেছেন তাঁর ফুটবলজ্ঞানেরও।
রিয়ালে থাকার সময় পেপ গার্দিওলাকে প্রতিপক্ষ কোচ হিসেবে পেয়েছিলেন আলোনসো। কিন্তু একসময় শত্রুপক্ষ বার্সেলোনার এই কোচের ভক্ত বনে যান এই স্প্যানিশ তারকা। গার্দিওলার জন্যই তিনি রিয়াল মাদ্রিদ ছেড়ে বায়ার্ন মিউনিখে যান।
২০১৯ সালে দ্য অ্যাথলেটিককে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে গার্দিওলাকে নিয়ে আলোনসো বলেছিলেন, ‘গার্দিওলার গোপন সূত্রগুলোর স্বরূপ খুঁজে বের করতে আমি খুবই কৌতূহলী ছিলাম। তার মধ্যে স্বভাবজাত ক্লান্তিহীন উদ্যম আছে। ফুটবল মৌসুমগুলো অনেক দীর্ঘ হয়। কিন্তু শেষ পর্যায়েও পেপকে কখনো ক্লান্ত দেখায় না। সে সময় সতর্ক, সব সময় প্রস্তুত। এটা খেলোয়াড়দেরও সামর্থ্যের বাইরে গিয়ে কিছু করার অনুপ্রেরণা দেয়।’ আর গার্দিওলাকে গুরু মেনে কোচিং শুরু করে সেখানেও পাচ্ছেন গুরুর মতো সাফল্য।
আলোনসো শুরুটা করেছিলেন রিয়াল মাদ্রিদের যুব দলের হয়ে। এরপর সোসিয়েদাদের বি দলকে কোচিং করা ২০১৯-২২ পর্যন্ত। মূল দলের কোচ হিসেবে শুরুটা করেন লেভারকুসেনেই। গত বছর মাঝমৌসুমে দায়িত্ব নিয়েছিলেন আলোনসো। তাঁকে নিয়ে সে সময় লেভারকুসেন ক্লাবের পরিচালক সিমন রোলফস বলেছিলেন, ‘আমি জানি দলকে আরও ভালো করে তোলার গুণ তার আছে।’
নিজের প্রথম ম্যাচেই সেই আস্থার প্রতিদান দেন আলোনসো। সে সঙ্গে বুঝিয়ে দেন তাঁর মস্তিষ্ক কতটা ক্ষুরধার, সেটাও। সে ম্যাচে আলোনসো দলকে ৩-৪-৩ ফরমেশনে খলিয়ে শালকের বিপক্ষে আদায় করে নেন ৪-০ গোলের দুর্দান্ত এক জয়। এই ফরমেশনে আলোনসো বক্স মিডফিল্ড (দুজন পিভট বা ডিফেন্সিভ মিডফিল্ডার এবং দুজন প্লে-মেকার রেখে তৈরি করা ফরমেশন) আর সঙ্গে ব্যবহার করেছিলেন অ্যাডভান্সড উইং-ব্যাক।
সেন্ট্রাল মিডফিল্ডার, আউটসাইড সেন্টারব্যাক, উইং ব্যাক এবং নাম্বার টেন মিলিয়ে একটি ‘ওয়াইড ডায়মন্ড’ আকার তৈরি করেন আলোনসো। আর এই ফরমেশনে সাফল্য পেয়ে শুরু হয় বুন্দেসলিগায় আলোনসোর পথচলা। পরেও বেশির ভাগ সময় এই কৌশলেই তিনি দলকে খেলিয়েছেন। গত মৌসুমে ২৬ বুন্দেসলিগা ম্যাচে লেভারকুসেনকে যৌথভাবে চতুর্থ সর্বোচ্চ পয়েন্ট (৪৫) এনে দেন আলোনসো।
লেভারকুসেনের দায়িত্ব ছয় মাসের মধ্যে ইতিহাসে নিজের নামও লেখান আলোনসো। ২০০২ সালে ক্লাউস টোপমোলেরের পর তিনি প্রথম কোচ হিসেবে ক্লাবের হয়ে টানা সাত ম্যাচ জয়ের কৃতিত্ব দেখিয়েছেন। লিগে লেভারকুসেন শেষ পর্যন্ত ৬ নম্বরে থাকে, যেখানে আলোনসোর হাত ধরে সেরা চারে থাকা দলগুলোর তিনটিকে (বায়ার্ন মিউনিখ, আরবি লাইপজিগ এবং ইউনিয়ন বার্লিন) হারায় লেভারকুসেন। এরপর দলকে ক্লাবটি পৌঁছে যায় ইউরোপা লিগের সেমিফাইনালেও।
আলোনসোর কৌশলের নিখুঁত প্রয়োগ লক্ষ করা যাবে লাইপজিগের বিপক্ষে করা লেভারকুসেনের প্রথম গোলটিতে। ৩-৪-৩ ফরমেশনে খেলার সময় সেদিন সেন্টার ব্যাক থেকে বল আসে সেন্ট্রাল মিডফিল্ডারের কাছে। তাঁর থ্রো বল ধরে প্লে-মেকার কাটব্যাক করে বল পাঠান নাম্বার নাইনের কাছে। ওয়ান টাচে বল জালে জড়িয়ে গোল আদায় করে নেয় লেভারকুসেন। সে সময় লেভারকুসেনের গোলস্কোরিংয়েও দারুণ বৈচিত্র্য দেখিয়েছিল। সব মিলিয়ে ১১ জন খেলোয়াড় চার বা তার বেশি গোল পেয়েছে।
আলোনসো নিজের কৌশলে খুব বেশি পরিবর্তন না আনলেও খেলোয়াড়দের খেলার ধরন বদলে এবং বৈচিত্র্য এনে ম্যাচের গতিপথ বদলে দিতে পারেন। তবে আলোনসোর কৌশলে কিছু বিষয় খুবই সহজাত। যেখানে খেলোয়াড়দের লক্ষ্য থাকে বল পায়ে রাখা এবং যেকোনো মুহূর্তে প্রেসিং করে বল আদায়ের চেষ্টা। আর সব সময় তাদের লক্ষ্য থাকে যতটা সম্ভব বলকে প্রতিপক্ষের অর্ধে রেখে ম্যাচের নিয়ন্ত্রণ রাখা। তবে আলোনসোর দল বিল্ডআপ শুরুটা করে নিচ থেকে। যেখানে রক্ষণভাগের খেলোয়াড়দের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা থাকে। দুই উইংয়ে তিনি শক্তিশালী ডিফেন্সিভ খেলোয়াড় ব্যবহার করেন, যাতে খুব বেশি খেলোয়াড় আউট অব পজিশন না হয়ে যায়।
দলের ডিফেন্ডারদের লক্ষ্য থাকে সেন্ট্রাল মিডফিল্ডার কিংবা প্লে-মেকারকে খুঁজে বের করা। আর পজিশনাল প্লের মধ্যে তাঁদের চেষ্টা থাকে ক্রিয়েটিভ খেলোয়াড়দের জন্য জায়গা বের করে দেওয়া এবং যত বেশি সম্ভব পাসিং লাইন বের করা। আলোনসোর কৌশলে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা থাকে পিভট বা ডিফেন্সিভ মিডফিল্ডারদের। তিনি নিজেও এই পজিশনে খেলতেন যে কারণে এই জায়গা থেকে কার্যকরী ফলও বের করে আনতে পারেন। তাঁর লক্ষ্য সামষ্টিক পারফরম্যান্স হলেও ব্যক্তিগত পর্যায়েও খেলোয়াড়দের উন্নতিতে বেশ নজর রাখেন। কোনো ক্ষেত্রে খেলোয়াড়দের বেশি স্বাধীনতা দিয়ে এবং ভূমিকা বদল করেও ফল বের করে এনেছেন আলোনসো। পাশাপাশি দারুণ বুদ্ধিমত্তার পরিচয় দিয়েছেন খেলোয়াড় রিক্রুটেও। যেখানে ভিক্টর বোনিফেইস, জোনাস হফম্যান এবং আলেসান্দ্রাা গ্রিমালদোরা এরই মধ্যে আলো ছড়াতে শুরু করেছেন।
কৌশল ও বুদ্ধিমত্তার জেরে শুরুটা স্বপ্নের মতো হয়েছে আলোনসোর। তবে সকালের সূর্য সব সময় দিনের পূর্বাভাস দেয় না। আলোনসোর সামনে অপেক্ষা করে আছে কঠিন সব চ্যালেঞ্জ। শোনা যাচ্ছে, কার্লো আনচেলত্তির পর তাঁর রিয়াল মাদ্রিদের কোচ হওয়ার গুঞ্জনও। সান্তিয়াগো বার্নাব্যুতে গেলে চ্যালেঞ্জ আর প্রত্যাশা তাই একই থাকবে না। তবে ফুটবল যাঁর রক্তে, লড়াই যাঁর ব্রত, তাঁকে কি এসবে ভয় ধরানো যায়! আর আলনসোতো তো জানেনই সাফল্যকে কীভাবে মুঠোয় পুরতে হয়। এখনো তো মাত্র শুরু, পাড়ি দেওয়ার জন্য পুরো পথটাই তো বাকি।