ইসরায়েলকে ‘লাল কার্ড’ দেখিয়ে ফিফার ‘হলুদ কার্ড’ পেল ইন্দোনেশিয়া
ফিফা অনূর্ধ্ব-২০ বিশ্বকাপ শুরু হওয়ার কথা আগামী ২০ মে। টুর্নামেন্ট শুরু হতে দেড় মাসও বাকি নেই। তবে এখন পর্যন্ত টুর্নামেন্টের আয়োজক চূড়ান্ত করতে পারেনি ফিফা।
বৈশ্বিক টুর্নামেন্ট নিয়ে এমন অচলাবস্থা তৈরি হয়েছে শেষ মুহূর্তে আয়োজক বাতিল করায়। সাড়ে তিন বছর ধরে ফিফা অনূর্ধ্ব-২০ বিশ্বকাপ আয়োজনের প্রস্তুতি নিয়েছিল ইন্দোনেশিয়া। গত সপ্তাহে দেশটির আয়োজক স্বত্ব বাতিল করে ফুটবলের নিয়ন্ত্রক সংস্থা।
শুধু বিশ্বকাপ আয়োজনেই নয়, আর্থিক নিষেধাজ্ঞার কবলেও পড়েছে ইন্দোনেশিয়ার ফুটবল অ্যাসোসিয়েশন (পিএসএসআই)। বৃহস্পতিবার ফিফার পক্ষ থেকে জানানো হয়, পরবর্তী নোটিশের আগপর্যন্ত ফিফা ফরোয়ার্ড ফান্ডের অর্থ পাবে না ইন্দোনেশিয়া। ফুটবলে পিছিয়ে থাকা দেশগুলোকে প্রকল্প বাস্তবায়ন ও পরিচালন ব্যয়ের জন্য ফরোয়ার্ড ফান্ডের অর্থ দিয়ে থাকে ফিফা।
ফুটবলে ইন্দোনেশিয়ার এই বেকায়দা ইসরায়েল বিরোধিতার জেরে। ইউরোপের বাছাইপর্ব উতরে ফিফা অনূর্ধ্ব-২০ বিশ্বকাপে জায়গা করে নিয়েছিল ইসরায়েল। তবে ইন্দোনেশিয়ার জনসাধারণ ও রাজনীতিবিদদের একটি অংশ দেশটিতে ইসরায়েলের আগমনের বিরোধিতায় সরব ছিলেন।
মধ্যপ্রাচ্যে ফিলিস্তিনের ওপর আগ্রাসনের কারণে মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ ইন্দোনেশিয়ায় ইসরায়েল বিরোধিতা প্রবল। রাজধানী জাকার্তায় অনূর্ধ্ব-২০ বিশ্বকাপে ইসরায়েলের আগমন ঠেকাতে কয়েক দফায় বিক্ষোভ হয়। বিরোধিতায় নামেন ডেমোক্রেটিক পার্টি অব স্ট্রাগলের (পিডিআই-পি) সেক্রেটারি জেনারেল হাসতো ক্রিস্তিয়ান্তোও।
ইউক্রেনের সঙ্গে যুদ্ধ ইস্যুতে রাশিয়াকে কাতার বিশ্বকাপে নিষিদ্ধ করা আর ফিলিস্তিনের ওপর ধারাবাহিক হামলার পরও ইসরায়েলকে অনূর্ধ্ব-২০ বিশ্বকাপ খেলতে দেওয়াকে তিনি ফিফার ‘দ্বিচারিতা’ বলে মন্তব্য করেন। তবে ইন্দোনেশিয়ার প্রেসিডেন্ট জোকো উইদোদো ও ইন্দোনেশিয়ার ফুটবল অ্যাসোসিয়েশনের পক্ষ থেকে অংশগ্রহণকারী সব দলের পর্যাপ্ত নিরাপত্তার বিষয়ে সব সময়ই আশ্বস্ত করা হয়েছে।
ইন্দোনেশিয়ার বিশ্বকাপ আয়োজন নিয়ে ফিফা কঠোর সিদ্ধান্ত নেয় বালি গভর্নরের চিঠির পর। বিশ্বকাপের অন্যতম ভেন্যু ছিল বালি দ্বীপ। সেখানকার গভর্নর ওয়াইয়ান কোসতার ইন্দোনেশিয়ার ক্রীড়া মন্ত্রণালয়ে চিঠি লিখে জানান, তাঁর অঞ্চলে ইসরায়েলকে আতিথেয়তা দেওয়া হবে না। টুর্নামেন্ট থেকে ইসরায়েলকে বাদ দেওয়ার দাবি জানান তিনি।
এর পরপরই অনূর্ধ্ব-২০ বিশ্বকাপের আয়োজক স্বত্ব থেকে ইন্দোনেশিয়াকে বাদ দেয় ফিফা। যদিও আনুষ্ঠানিক বিবৃতিতে শুধু ‘বর্তমান পরিস্থিতির কারণে’ উল্লেখ করা হয়। পিএসএসআই নির্বাহী কমিটির সদস্য আর্য সিনুলিনগা নিশ্চিত করেন, একজন আঞ্চলিক নেতার বিরোধিতার কারণে কঠোর সিদ্ধান্ত নিয়েছে ফিফা।
বিপুল অঙ্কের আর্থিক ক্ষতি
ব্রাজিল ও পেরুকে টপকে ইন্দোনেশিয়া অনূর্ধ্ব-২০ বিশ্বকাপের আয়োজক হয় ২০১৯ সালের অক্টোবরে। সেই সময়ে টুর্নামেন্টটি মাঠে গড়ানোর কথা ছিল ২০২১ সালে। করোনা মহামারির কারণে তা দুই বছর পিছিয়ে দেওয়া হয়। সাড়ে তিন বছর ধরে অবকাঠামোসহ ২৪ দলের টুর্নামেন্ট আয়োজনে ব্যাপক প্রস্তুতি গ্রহণ করে ইন্দোনেশিয়ার সরকার।
টাইমসের খবরে বলা হয়, যুব ও ক্রীড়া মন্ত্রণালয়ের দেওয়া গত বছরের হিসাব অনুযায়ী, অনূর্ধ্ব-২০ বিশ্বকাপের প্রস্তুতিতে ৩ কোটি ৩০ লাখ মার্কিন ডলার বাজেট রাখা হয়েছিল। এর পাশাপাশি স্টেডিয়াম সংস্কারের জন্য পাবলিক ফান্ড থেকে আরও ২ কোটি ১০ লাখ ডলার খরচ হয়েছে বলে জানায় ভয়েস অব ইন্দোনেশিয়া। টুর্নামেন্ট প্রায় নিকটে চলে এসেছিল বলে এত দিন প্রায় সব ব্যয়ই হয়ে যাওয়ার কথা। টুর্নামেন্ট না হওয়ায় এর প্রায় পুরোটাই এখন ক্ষতির খাতায়।
নিউইয়র্ক টাইমসের খবরে বলা হয়, ৫টি স্টেডিয়াম ও ২০টি অনুশীলন ভেন্যু প্রস্তুত করতে খরচ হয়েছিল প্রায় ১২০ লাখ মার্কিন ডলার।
ইউনিভার্সিটি অব ইন্দোনেশিয়ার ইনস্টিটিউট ফর ইকোনমিক অ্যান্ড সোশ্যাল রিসার্চের সূত্র উল্লেখ করে টাইমস জানায়, অনূর্ধ্ব-২০ বিশ্বকাপ কেন্দ্র করে ৪৪ হাজারের বেশি চাকরির সুযোগ সৃষ্টি হওয়ার প্রাক্কলন করা হয়েছিল। এ ছাড়া ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্প, পর্যটন ও ভেন্ডর মিলিয়ে আরও বিপুল অর্থ আয়ের হিসাব করা হয়েছিল। বিনিয়োগ হয়েছিল এসব খাতেও।
ইসরায়েলে ‘না’ ইন্দোনেশিয়ার
ফিফা আয়োজক স্বত্ব কেড়ে নেওয়ার আগেই ইসরায়েলের অংশগ্রহণ নিয়ে কথা বলেছিলেন ইন্দোনেশিয়ার প্রেসিডেন্ট জোকো উইদোদো। ফিলিস্তিনের প্রতি সমর্থন আগের মতোই আছে জানিয়ে তিনি বলেছিলেন, ‘আমরা খেলার সঙ্গে রাজনীতি মেশাতে চাই না।’ ইসরায়েলসহ অংশগ্রহণকারী ২৪টি দলের নিরাপত্তা নিশ্চিতের আশ্বাসও দেন উইদোদো। রাষ্ট্রীয় পর্যায়ে কূটনৈতিক সম্পর্ক না থাকলেও গত এক দশকের মধ্যে ইসরায়েলের একাধিক খেলোয়াড় ইন্দোনেশিয়ার মাটিতে খেলে গেছেন। ২০১৫ সালে জাকার্তায় ব্যাডমিন্টন ওয়ার্ল্ড চ্যাম্পিয়নশিপে একজন, গত বছর রক ক্লাইম্বে একজন এবং এ বছরের ফেব্রুয়ারিতে ইউসিআই ট্র্যাক নেশনসে একজন ইসরায়েলি সাইক্লিস্ট অংশ নিয়েছিলেন। তবে এর আগের পরিস্থিতি ছিল ভিন্ন। ইসরায়েলের সঙ্গে খেলতে হবে বলে ১৯৫৮ বিশ্বকাপের বাছাইপর্বে যায়নি ইন্দোনেশিয়া। ১৯৬২ এশিয়ান কাপের আয়োজক ছিল ইন্দোনেশিয়া। সেবার ইন্দোনেশিয়ার প্রতিষ্ঠাতা প্রেসিডেন্ট সুকর্ণের সরকার ইসরায়েলের খেলোয়াড়দের ভিসা দিতে অস্বীকৃতি জানালে নাম প্রত্যাহার করতে বাধ্য হয় ইসরায়েল। সর্বশেষ ২০০৬ সালে তেল আবিবে অনুষ্ঠিত ফেড কাপ টেনিস টুর্নামেন্ট থেকে নাম প্রত্যাহার করে ইন্দোনেশিয়া।
ফিফার হলুদ কার্ডে খুশি কর্তৃপক্ষ
ঘরোয়া লিগে সরকারি হস্তক্ষেপের দায়ে ২০১৫ সালে ইন্দোনেশিয়া ফুটবল অ্যাসোসিয়েশনকে নিষিদ্ধ করে ফিফা। এবার অনূর্ধ্ব-২০ বিশ্বকাপ সরিয়ে নেওয়ার পর আরেকবার নিষেধাজ্ঞা আসার শঙ্কায় ছিলেন কর্মকর্তারা। বৃহস্পতিবার প্যারিসে ফিফা সভাপতি জিয়ান্নি ইনফান্তিনোর সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন পিএসএসআই প্রেসিডেন্ট এরিক থোহিরি। ফিফা কর্তৃক ফুটবল কার্যক্রমের ওপর নিষেধাজ্ঞার তুলনায় আর্থিক নিষেধাজ্ঞায় তিনি স্বস্তিই প্রকাশ করেছেন।
পিএসএসআইয়ের ওয়েবসাইটে প্রকাশিত বিবৃতিতে থোহিরি বলেন, ‘আমি শুধু এটুকু বলতে পারি, স্রষ্টার দয়ায় ও ইন্দোনেশিয়ান ফুটবল সমর্থকদের প্রার্থনায় বিশ্ব ফুটবল থেকে নির্বাসনে যাওয়া এড়াতে পেরেছে ইন্দোনেশিয়া।’ ফিফার সিদ্ধান্তে খুশির কথা প্রকাশ করতে গিয়ে তিনি আরও বলেন, ‘এটা অনেকটা হলুদ কার্ডের মতো, লাল কার্ড নয়।’