মেসিকে ঠেকাতে প্রস্তুত ‘আকাশচুম্বী’ গোলকিপার
‘আমি ছোট মানুষ। তবু স্বপ্ন দেখেছি। কিন্তু আমার ক্যারিয়ার দেখলে বুঝবেন, সেই স্বপ্ন আগেই শেষ হয়ে গিয়েছিল। তারপরও এটা যখন সত্যি হলো, সেই মুহূর্তটা ছিল বিশেষ কিছু। আমার গল্পটা এমন, যেখান থেকে শিশুরা শিখতে পারে—অসম্ভব বলে কিছু নেই।’
কথাটা আন্দ্রিস নোপের্টের। তাঁর গল্প শোনার আগে ভুলটা শুধরে নিন। নোপের্ট নিজেকে ‘ছোট মানুষ’ বলেছেন বিনয় থেকে। নেদারল্যান্ডসের এই গোলকিপার কাতার বিশ্বকাপে সবচেয়ে লম্বা খেলোয়াড়, উচ্চতা ৬ ফুট ৮ ইঞ্চি। কাল কাতার ন্যাশনাল বিশ্ববিদ্যালয়ে কয়েক মিটার দূরত্বে পাশাপাশি মাঠে অনুশীলন করেছে নেদারল্যান্ডস ও আর্জেন্টিনা। লিওনেল মেসি নিশ্চয়ই নোপের্টকে দেখেছেন? নোপের্টও নিশ্চয়ই চোখের ফিতায় মাপজোখ করে নিয়েছেন মেসিকে।
আজ রাতে আর্জেন্টিনা-নেদারল্যান্ডস কোয়ার্টার ফাইনাল লড়াইয়ের মোড়কে ‘খণ্ডযুদ্ধ’ হবে এই দুজনের। ম্যাচ টাইব্রেকারে গড়ালে হয়ে উঠবে মূল লড়াই। নোপের্ট সে জন্য প্রস্তুত, ‘আমি সব সময় প্রস্তুত। সে-ও (মেসি) মিস করে। এটা বিশ্বকাপের শুরুতেই দেখেছি। সে আর দশজন রক্তমাংসের মানুষের মতোই। সব সময় একই পায়ে কিক নেয়। আমিও তার পেনাল্টি ঠেকাতে পারি।’
২৮ বছর বয়সী নোপের্ট এমন আত্মবিশ্বাস পেয়েছেন নিজের জীবন থেকে। সে এমন এক জীবন, যেখানে দুই সপ্তাহ আগেও তাঁর ডাচ দলের প্রথম একাদশে জায়গা নিশ্চিত ছিল না। দুই মাস আগে ডাচ দলেই কেউ তাঁকে দেখেননি। আর দুই বছর আগে ফুটবলে তাঁর কোনো ভবিষ্যৎ ছিল না। গোলকিপিংয়ের গ্লাভস ফেলে পুলিশে ঢোকার কথাও ভেবেছেন।
বিশ্বকাপে সেনেগালের বিপক্ষে ডাচদের প্রথম ম্যাচে আন্তর্জাতিক অভিষেক হয় নোপের্টের। পেশাদার ক্যারিয়ারে সেটি তাঁর ৫১তম ম্যাচ। এর মধ্যে গত দেড় বছরেই খেলেছেন ৩৪টি। অথচ ক্লাব ক্যারিয়ার শুরু ৯ বছর আগে। ২০১৩ সালে স্থানীয় দল হেরেনভেনে যোগ দেওয়ার পর ৮ বছর যাযাবর জীবন কেটেছে নোপের্টের। শুধু হাঁটুর চোটেই মাঠের বাইরে ছিলেন এক বছর। হেরেনভেনের হয়ে কোনো ম্যাচ খেলার সুযোগ পাননি। ২০১৪ সালে যোগ দেন ডাচ দল ব্রেদায়। পরের চার বছরে এই দলের ব্যাকআপ গোলকিপার হিসেবে মাত্র তিনটি লিগ ম্যাচ খেলেছেন।
হতাশ নোপের্ট দেশ ছেড়ে যোগ দিলেন ইতালিয়ান সিরি ‘বি’র দল ফোজ্জায়। সেখানে ক্যারিয়ার গড়া তো দূরের কথা, নেদারল্যান্ডস থেকে যে গাড়ি চালিয়ে তিনি ফোজ্জায় পৌঁছালেন, সেই গাড়িও ধরে রাখতে পারেননি। ফোজ্জিয়ান মাফিয়ারা চুরি করেছিল। ইতালিয়ান ফুটবলে ‘স্কাইস্ক্র্যাপার (আকাশচুম্বী)’ তকমা পাওয়া নোপের্টও থিতু হতে পারেননি।
মাত্র আট ম্যাচ খেলার পর অবনমন ঘটে ক্লাবটির। ভাগ্য সুপ্রসন্ন না হওয়ায় দেশে ফিরে ডাচ দ্বিতীয় বিভাগের ডোরড্রেখটে যোগ দেন। তখন পরিবারের চাপাচাপিতে একবার পুলিশে যোগ দেওয়ার কথা ভেবেছিলেন। শেষ পর্যন্ত ফুটবলপ্রেমেরই জয় হয়। তবে সেই জয়ের আগে আছে হতাশার গল্পও।
চোটে পড়ায় ডোরড্রেখটের হয়ে মাত্র দুই ম্যাচ খেলতে পারেন। ক্লাবটি তাঁকে ছেড়ে দেওয়ার পর ২০২০ সালের জুন থেকে ২০২১ সাল পর্যন্ত ক্লাবহীন বেকার বসে ছিলেন নোপের্ট। তখন লকডাউনের মধ্যে চোট ও ক্লাবহীন থাকায় ক্যারিয়ারের শেষ দেখতে পাচ্ছিলেন। কিন্তু নোপের্ট হাল ছাড়েননি। ডাচ শীর্ষ লিগের দল গো অ্যাহেড ইগলসের তখন জরুরি ভিত্তিতে গোলকিপার প্রয়োজন।
কপাল খুলে যায় নোপের্টের। সেখানে ছয় মাসের চুক্তিতে ভালো খেলার পুরস্কার হিসেবে আবারও ডাক পান হেরেনভেনে। ক্লাবটি তত দিনে ডাচদের শীর্ষ লিগে উঠেছে। নোপের্ট সেখানেও ভালো পারফরম্যান্স করে চোখে পড়েন নেদারল্যান্ডস কোচ লুই ফন গালের।
গত সেপ্টেম্বরে তাঁকে জাতীয় দলে ডাকলেও মাঠে নামাননি ফন গাল। নভেম্বরে বিশ্বকাপ দলে সুযোগ পাওয়ার পর নোপের্টের কেমন লেগেছিল, তাঁর মুখেই শুনুন, ‘বিশ্বকাপ দলে সুযোগ পাওয়ার কথা কখনোই ভাবিনি। নেদারল্যান্ডসে গোলকিপারের অভাব নেই। পরে দেখি আমাকে টিভিতে দেখাচ্ছে। তার আগে মেইলে সুযোগ পাওয়ার কথা জেনেছি। এরপরও বাদ পড়ার সম্ভাবনা ছিল এবং সেটা হলে জানিয়েও দেওয়া হয়। তাই তখনো অতটা নিশ্চিত ছিলাম না। পরে টিভিতে নিজের নাম দেখে নিশ্চিত হই।’
নোপের্টের জীবনের গল্প বহু আগেই তাঁর উচ্চতাকে ছাপিয়ে গেছে। এখন মেসিকেও ছাপিয়ে যাওয়ার পালা!