ভিনিসিয়ুস সাদায় ‘জেকিল’, হলুদে ‘হাইড’
‘ভিনিসিয়ুস শুধু নামের জোরে (জাতীয় দলে) খেলতে পারে না। নিজেকে আরেকটু নিংড়ে দেওয়ার সময়টা এখনই। শুধু বাঁ প্রান্তে না থেকে (মাঠের) অন্য দিকেও যেতে হবে।’
কথাটা কাইয়ো রিবেইরোর। ৪৯ বছর বয়সী এই ভদ্রলোক ব্রাজিলের সাবেক ফরোয়ার্ড। ১৯৯৬ সালে ব্রাজিল জাতীয় দলের হয়ে ৪ ম্যাচে ৩ গোল করেছিলেন। জাতীয় দলে ক্যারিয়ার ওই এক বছরের হলেও ক্লাব ফুটবলে খেলেছেন ২০০৫ পর্যন্ত। ফুটবল ছাড়ার পর নেমে পড়েন খেলার বিশ্লেষণে। এখন তিনি ফুটবল–পণ্ডিত এবং ধারাভাষ্যকারও। গতকাল বিশ্বকাপ বাছাইয়ে প্যারাগুয়ের কাছে ব্রাজিলের ১–০ গোলে হারের পর ভিনিসিয়ুসের সমালোচনা করে কথাটি বলেছেন রিবেইরো।
হলুদ জার্সির ভিনিসিয়ুসকে নিয়ে এমন অভিযোগ নতুন না। কারণটাও নিশ্চয়ই জানা। এবার ব্যালন ডি’অর জয়ের দৌড়ে এগিয়ে থাকা ভিনিসিয়ুস ব্রাজিলের হয়ে খেলছেন পাঁচ বছর হয়ে গেল। এ সময়ের মধ্যে হলুদ জার্সিতে তাঁর মনে রাখার মতো পারফরম্যান্স কি আছে? প্রশ্নটি তোলার কারণ একটি বৈপরীত্য।
জাতীয় দলের হয়ে এই পাঁচ বছরে ভিনিসিয়ুসের গোলসংখ্যা রিবেইরোর চেয়ে ২টি বেশি। ঠিকই ধরেছেন, ৫ গোল। সে জন্য ভিনিসিয়ুসকে রিবেইরোর চেয়ে আরও ৩১টি ম্যাচ বেশি খেলতে হয়েছে—৩৫ ম্যাচ। সৌজন্যের খাতিরে ব্যাপারটাকে দুজনের মধ্যে তুলনা করা হচ্ছে না বললেও আসলে তো সেটাই। কারণও আছে। রিবেইরো ডাকাবুকো কোনো ফুটবলার ছিলেন না। ১৯৯৫ সালে ফিফা ইয়ুথ চ্যাম্পিয়নশিপে গোল্ডেন বল জেতা ছাড়া ব্যক্তিগত উল্লেখযোগ্য তেমন কোনো অর্জন তাঁর নেই। কিন্তু ভিনিসিয়ুস এই গোত্রে পড়েন না। ব্রাজিলিয়ান ফুটবলে তারকাপ্রথার যে পরম্পরা—পেলে, জিকো, সক্রেটিস, রোমারিও, রোনালদো, রোনালদিনিও, নেইমারের পর সময়টা এখন ভিনিসিয়ুস–রদ্রিগোদের।
পূর্বসূরিদের প্রায় সবাই জাতীয় দলে নিজেকে নিংড়ে দিয়েছেন ও সম্ভবত কারোরই জাতীয় দলের হয়ে ক্যারিয়ারের প্রথম ৩০–৩৫ ম্যাচে এত কম গোল ছিল না। সেখানে ভিনিসিয়ুসের গোলসংখ্যা কড়ে গুনে বলে দেওয়া যায়—২০১৯ সালে জাতীয় দলে অভিষেকের তিন বছর পর ২০২২ সালের মার্চে বিশ্বকাপ বাছাইয়ে চিলির বিপক্ষে করেছিলেন প্রথম গোল, সে বছরই বিশ্বকাপ শেষ ষোলোয় দক্ষিণ কোরিয়ার বিপক্ষে পেলেন দ্বিতীয় গোল। তৃতীয় গোলটি পরের বছর গিনির বিপক্ষে প্রীতি ম্যাচে। ঠিক এক বছর পর গত জুনে কোপা আমেরিকায় প্যারাগুয়ের বিপক্ষে পেয়েছেন জোড়া গোল এবং ব্রাজিলের জার্সিতে সেটাই ভিনির শেষবারের মতো গোল উদ্যাপন।
অর্থাৎ ২০২২ সালে ২টি, ২০২৩ সালে ১টি এবং এ বছর এখন পর্যন্ত ২টি—রসিকতা করে কেউ কেউ বলতেই পারেন, বছরপ্রতি একটি–দুটি করে গোল, এ তো পর্বতের মূষিক প্রসব!
অথচ ভিনিসিয়ুসকে যাঁদের সঙ্গে তুলনা করা হয় কিংবা বৈশ্বিক ফুটবলে যেসব বড় তারকার উত্তরসূরি হিসেবে বিবেচনা করা হয়, তাঁরা কিন্তু জাতীয় দল ও ক্লাবের হয়ে সমানতালেই খেলে গেছেন কিংবা যাচ্ছেন। উদাহরণ? ওপরে যাঁদের নাম বলা হলো তাঁদের ক্যারিয়ার দেখলেই ব্যাপারটি পরিস্কার। হাল আমলে লিওনেল মেসি কিংবা ক্রিস্টিয়ানো রোনালদোর ক্যারিয়ারেও তাকাতে পারেন। ভিনি সেই পথে চলছেন ‘অর্ধেক’ ঘাটতি রেখে—অর্থাৎ এখন পর্যন্ত শুধু ক্লাবের জার্সিতেই উজ্জ্বল। জাতীয় দলে বিবর্ণ।
রিয়াল মাদ্রিদে ২০১৮ সালে অভিষেকের পর এই ৬ বছরে ২৬৯ ম্যাচে ৮৪ গোল ভিনির। রিয়াল ও ব্রাজিলের জার্সিতে একই পজিশনে (বাঁ প্রান্তের উইঙ্গার) খেলেন। কিন্তু একেক জার্সিতে একেক রকম ভিনিকে দেখা যায়। রিয়ালের সাদা জার্সিতে যদি হন আগুনের হল্কা, ব্রাজিলের হলুদ জার্সিতে তবে শীতের হলদেটে হয়ে যাওয়া পাতার মতোই বিবর্ণ। অন্যভাবেও বলা যায়, ব্রাজিলের জার্সিতে ভিনির বিবর্ণ পারফরম্যান্স সম্ভবত আরও বেশি করে চোখে বেঁধে রিয়ালে ঠিক উল্টো রূপের জন্য। এমন বিপরীতমুখী পারফরম্যান্স দেখে রবার্ট লুই স্টিভেনসনের সেই বিখ্যাত বইটির দুটি চরিত্র মনে পড়তে পারে ব্রাজিলের সমর্থকদের। বইটি ‘স্ট্রেঞ্জ কেস অব ডক্টর জেকিল অ্যান্ড মিস্টার হাইড’—যেখানে চিকিৎসক জেকিল এমন এক ওষুধ আবিষ্কার করলেন, যার প্রভাবে একই মানুষের মধ্যে ভালো-মন্দ দুই ধরনের চরিত্র ফুটে ওঠে। ওষুধের প্রভাবে হয়ে ওঠেন নেতিবাচক চরিত্রের হাইড, আবার প্রয়োজনমতো অন্য ওষুধ নিয়ে শান্ত মেজাজের জেকিল হয়ে ফিরে আসেন।
ভিনি অবশ্যই মন্দ চরিত্রের কেউ নন। তবে রূপকভাবে ব্রাজিলের হয়ে তাঁর বিবর্ণ পারফরম্যান্সকে যদি ‘হাইড’ ধরা হয়, তবে রিয়ালে তিনি অবশ্যই ‘জেকিল’।
রিয়ালের সেই ‘জেকিল’কে আরেকটু কাটাছেঁড়া করা যাক। ইউরোপিয়ান ক্লাব ফুটবলে গত মৌসুমের পারফরম্যান্স ভিনিকে ব্যালন ডি’অর জয়ের দৌড়ে এগিয়ে রেখেছে। ২৪টি গোল করার পাশাপাশি ৯টি গোলও বানিয়েছেন। রিয়ালও জিতেছে চ্যাম্পিয়নস লিগ ও লা লিগা। কিন্তু এই একই মানুষ যখন গত জুনে কোপা আমেরিকায় তিন ম্যাচে ২ গোল (একটি ম্যাচেই) করেন এবং গ্রুপ পর্বে অপ্রয়োজনে হলুদ কার্ড দেখার খেসারত দিয়ে কোয়ার্টার ফাইনালে খেলতে পারেন না এবং ব্রাজিলও হেরে বিদায় নেয়—তখন তাঁকে ‘মিস্টার হাইড’ মনে হয় বৈকি! মূলত সর্বশেষ কোপায় বাজে খেলার পর থেকেই ভিনিসিয়ুস শুধু রিয়ালের, ব্রাজিলের নয়—এমন গুঞ্জন বেশি করে শোনা যাচ্ছে।
সেই গুঞ্জনের পেছনে যুক্তিও আছে। গত মৌসুমে রিয়ালের লা লিগা জয়ে ভিনিসিয়ুস গোলপ্রতি (২৬ ম্যাচে ১৫ গোল) গড়ে ১.৬টি করে শট নিয়েছেন। আর ২০২৬ বিশ্বকাপ বাছাইয়ে ব্রাজিলের হয়ে এ পর্যন্ত ৫ ম্যাচ খেলে গোল পাননি। গোল বানিয়েছেন একটি। আর শট নিয়েছেন ০.৬ হারে। দুটি আলাদা দলের হয়ে শুধু পারফরম্যান্স নয়, ভালো খেলার চেষ্টায়ও ফারাক পরিষ্কার বোঝা যায়। গোল পেতে শট নিতেই হবে। সেই চেষ্টাতেই তো ফারাকটা অনেক। আরও একটি বিষয়। এবার বিশ্বকাপ বাছাইয়ে ৫ ম্যাচেই একাদশের হয়ে নেমে গড়ে ৭৪ মিনিট করে মাঠে ছিলেন ভিনিসিয়ুস। এ সময় একটি গোল বানালেও লা লিগায় রিয়ালের হয়ে চলতি মৌসুমে ৫ ম্যাচেই বানিয়েছেন ২টি গোল।
ভিনিসিয়ুসের ড্রিবলিংয়ের হারেও বেশ বড় ফারাক আছে। এবার বাছাইপর্বে ভিনির ড্রিবলিংয়ে সফলতার হার মাত্র ২৫ শতাংশ। অথচ লা লিগার গত মৌসুমে ২৬ ম্যাচ খেললেও তাঁর সফল ড্রিবলিংয়ের হার ছিল ৪২ শতাংশ।
রিবেইরোয় ফেরত যাওয়া যাক। ব্রাজিলিয়ান এই ধারাভাষ্যকার সম্ভবত বোঝাতে চেয়েছেন, রিয়ালে ভিনিসিয়ুসের যে নামডাক, শুধু সেটি কাজে লাগিয়ে তিনি দিনের পর দিন পারফরম্যান্স ছাড়াই ব্রাজিল জাতীয় দলে খেলতে পারেন না। উইঙ্গার ভিনির খেলার জায়গা মাঠের বাঁ প্রান্ত, রিবেইরোর যুক্তি শুধু ওখানে পড়ে না থেকে ভিনি আক্রমণভাগে নিজেকে ছড়িয়ে দিক। তাহলে গোলের পাশাপাশি ভালো পারফরম্যান্সও সম্ভব, কারণ ভিনির ড্রিবলিং ক্ষুরধার। ছন্দে থাকলে ডিফেন্স চিরে ফেলতে পারেন। এই কথা মাথায় রেখে প্যারাগুয়ে ম্যাচটা মনে করলে কিন্তু রিবেইরোর কথায় যুক্তি খুঁজে পাওয়া যায়।
গতকালের ম্যাচে বাঁ প্রান্তে ভিনিকে ‘এতিম’ বানিয়ে রেখেছিল প্যারাগুয়ে রক্ষণ। মানে, ব্রাজিলের বাকি খেলোয়াড়দের চেয়ে ভিনিকে আলাদা করে ফেলেছিল প্যারাগুয়ে। কড়া মার্কিংয়ে রাখায় তেমন একটা পাস পাননি সতীর্থদের কাছ থেকে। সমস্যা হলো, পাস বা খেলার জায়গা না পাওয়ার পরও ভিনি জায়গা বদলানোর চেষ্টা করেননি।
প্যারাগুয়ের কাছে হারের পর ব্রাজিলের সমর্থকেদের কাছে ক্ষমা চেয়েছেন ভিনি। ২৪ বছর বয়সী এই উইঙ্গার ব্রাজিল ও রিয়ালের জার্সিতে খেলার পার্থক্যটাও তুলে ধরেছেন। বলেছেন, দক্ষিণ আমেরিকার তুলনায় ইউরোপের খেলা বেশি গতিসম্পন্ন। মাঠের কারণে বলও নাকি ইউরোপে দ্রুত পায়ে আসে। সন্দেহ নেই ব্যাপারগুলো সত্য এবং এর পরিপ্রেক্ষিতে বলাই যায়, ভিনি ইউরোপের ময়দানে খেলতে বেশি স্বচ্ছন্দ। কিন্তু এই বিচারে ভিনি ঠিক কত বড় মাপের খেলোয়াড় হয়ে উঠতে পারবেন, সেটি প্রশ্নসাপেক্ষ। কারণ? ভিনির ব্রাজিলিয়ান পূর্বসূরি কিংবা মেসি–রোনালদোদের দেখুন, মাঠ যেমনই হোক, জার্সির রং যেটাই হোক, প্রত্যাশা পূরণে তাঁরা পিছিয়ে ছিলেন কবে!
তবে রিয়াল যদি ‘জেকিল’ ভিনিকে নিয়ে এ মৌসুমের শুরুতেই স্বস্তিতে থাকে, সেটি ভুল হবে। চলতি মৌসুমে রিয়ালের হয়ে ৫ ম্যাচ খেলে ভিনির গোল ১টি, সেটাও পেনাল্টি থেকে। এর আগে পোস্টে শট রাখার হারও বেশ ভালো ছিল ভিনির—২৫ শতাংশ। অর্থাৎ প্রতি চারটি শটের একটি থেকেছে পোস্টে। কিন্তু এবার একটি রাখতে গড়ে মারতে হচ্ছে ১০টি শট (৯ শতাংশ)। এই ভিনি ত্রাসজাগানিয়া নয়, সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হলো, ভিনি মাঠে আছেন টের পাওয়া যাচ্ছে খুব কমই।