ফাইনালটা ফ্রান্স আর আর্জেন্টিনার মধ্যেই হচ্ছে তো! কখনো কখনো যে এমনও মনে হচ্ছে, আর্জেন্টিনা শুধু নামেই, ফ্রান্সের প্রতিপক্ষ আসলে বাকি বিশ্ব! ফ্রান্স ছাড়া বাকি বিশ্বই যেন চাইছে, বিশ্বকাপটা আর্জেন্টিনা জিতুক। কারণটা মনে হয় আপনিও জানেন।
দিদিয়ের দেশম একটা সংশোধনী দিলেন। ফ্রান্সেরও অনেকে নাকি মেসিকেই আজ জয়ী দেখতে চাইবেন। খেলোয়াড়ি জীবনেই চুলের রং ছিল রুপালি। এখন তা পুরোপুরিই সাদা। ফ্রান্সের কোচের চেহারায় যা একটা আভিজাত্যই এনে দিয়েছে। সংবাদ সম্মেলনে সেই দেশমকে প্রশ্ন করা হলো, মেসির জন্য সবাই যে চাইছেন, আর্জেন্টিনাই জিতুক—এতে কি একটু নিঃসঙ্গ মনে হচ্ছে?
দেশম প্রশ্নটাকে ফুটবল কোচের জীবনের সঙ্গে মিলিয়ে নিয়ে প্রথমে বলে নিলেন, ‘এই অনুভূতি তো আমার প্রায়ই হয়। এতে কিছু যায়–আসে না।’ ফ্রান্স বনাম বাকি বিশ্ব প্রসঙ্গে এলেন এরপর, ‘আমি জানি, সবাই হয়তো আর্জেন্টিনাকে জয়ী দেখতে চায়। এমনকি ফ্রান্সেরও অনেকে হয়তো চাইবে, মেসি জিতুক। কিচ্ছু আসে–যায় না। আমরাও জিততে চাই।’
ফাইনালে ওঠার পর কোন দল তা না চাইবে! তার ওপর এমন একটা ইতিহাসের হাতছানি থাকলে জয়ের ইচ্ছা আরও সুতীব্র হওয়ারই কথা। বিশ্বকাপ ফুটবল কোনো দলকে সর্বশেষ শিরোপা ধরে রাখতে দেখেছে ৬০ বছর আগে। আজ জিতলেই ব্রাজিলের সেই কীর্তির পুনরাবৃত্তি করে ফেলবে ফ্রান্স। দেশমের জন্য ব্যক্তিগত অর্জনও থাকবে। খেলোয়াড় ও কোচ দুই ভূমিকাতেই বিশ্বকাপ জিতেছেন। যে কীর্তিতে তাঁর সঙ্গী আরও দুজন।
আজ জিতলে কোচ হিসেবে দুই জয়ে মারিও জাগালো ও ফ্রাঞ্জ বেকেনবাওয়ারকে তো ছাড়িয়ে যাবেনই, ছুঁয়ে ফেলবেন ভিত্তরিও পোজ্জোকেও। কোচ হিসেবে দুটি বিশ্বকাপ জিতেছেন শুধুই এই ইতালিয়ান। টানা দুটি বিশ্বকাপ জয়ের প্রথম উদাহরণটাও পোজ্জোর ইতালিরই। তা সেই ১৯৩৪ ও ১৯৩৮ সালে, দ্বিতীয় ও তৃতীয় বিশ্বকাপে।
ফ্রান্সের জন্য যা শিরোপা ধরে রেখে এত সব ইতিহাস ফিরিয়ে আনার মিশন, আর্জেন্টিনার জন্য তা বিশ্বকাপের জন্য তিন যুগের হাহাকার ঘোচানোর। ম্যারাডোনার নামাঙ্কিত সেই ১৯৮৬ বিশ্বকাপ জয়ের পর আরও দুবার ফাইনালে উঠেও পুড়তে হয়েছে স্বপ্নভঙ্গের বেদনায়। সর্বশেষটি মাত্র এক বিশ্বকাপ আগেই। ২০১৪ বিশ্বকাপে মারাকানার সেই দুঃখ মুছে দেওয়ার সুযোগ এত তাড়াতাড়ি পেয়ে যাওয়ার পর তা কি আর হেলায় হারাতে চাইবে আর্জেন্টিনা!
আর্জেন্টাইন ফুটবল ইতিহাসে মারাকানার একটা নতুন পরিচয়ও হয়েছে পরে। গত বছর এই মারাকানাতেই কোপা আমেরিকা জিতে ২৮ বছরের শিরোপা-খরা ঘুচেছে আর্জেন্টিনার। আর্জেন্টাইন ফুটবলের পুনর্জন্মও যেন সেখানেই। আর্জেন্টিনা দলের ‘লা স্কালোনেটা’ হয়ে ওঠারও।
‘লা স্কালোনেটা’ মানে স্কালোনির দল। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের একটা মিম থেকে যে কথাটার জন্মও ওই কোপা জয়ের পরই। সেই মিমটাতে স্কালোনি একটা ভ্যানের চালকের আসনে বসে; পাশে মেসি, পেছনে আর্জেন্টিনার বাকি সব খেলোয়াড়। জাতীয় দলের পতাকার রঙে রাঙানো ভ্যানের গায়ে লেখা ওই কথাটা।
আর্জেন্টিনার মাঠের নায়ক যদি লিওনেল মেসি হন, আর্জেন্টিনাকে বদলে দেওয়ার নেপথ্য নায়ক এই অন্য লিওনেল। দলকে বিশ্বকাপ ফাইনালে তোলার পর আর্জেন্টিনায় যাঁর জনপ্রিয়তা এখন আকাশ ছুঁয়েছে। তা ফাইনালের আগে দলকে কী বলবেন লিওনেল স্কালোনি?
চেহারাছবির মতো কথাবার্তাতেও স্কালোনি ভদ্রতার প্রতিচ্ছবি। বিতর্কিত কিছুর ধারেকাছেও নেই। ফাইনালে দলকে উদ্দীপ্ত করতে কী বলবেন, তা আদৌ প্রকাশ্যে বলেন কি না, এ নিয়ে তাই কৌতূহল ছিল। স্কালোনি বললেন। ‘ওই যে একটা কথা আছে না, ফাইনাল খেলার জন্য নয়, জেতার জন্য।’
কথাটা প্রথম কে বলেছিলেন, ঠিক জানা যায় না। নেটে সার্চ দিলে কোনো দিন বিশ্বকাপ না খেলা আর্জেন্টাইন গ্রেট আলফ্রেডো ডি স্টেফানোর নাম আসে। সাম্প্রতিক অতীতে কথাটাকে আরও বিখ্যাত করেছেন জোসে মরিনিও। মর্মার্থ তো পরিষ্কার, ফাইনালে জয়টাই একমাত্র সত্যি, কীভাবে তা এল, তা নিয়ে মাথা ঘামানোর দরকার নেই। দুই দলের জার্সিতেই দুটি করে তারা, সেখানে তৃতীয় তারাটা যোগ করতে আজও হয়তো হিসাবি ফুটবলই দেখা যাবে।
এমনিতে আজকের ফাইনালে একাধিক সাব প্লট আছে। যার মধ্যে সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য দুটি—ইউরোপ বনাম লাতিন আমেরিকা এবং মেসি বনাম এমবাপ্পে। বিশ্বকাপ সাফল্যে একসময় সমানে সমান থাকলেও গত চারটি বিশ্বকাপ জিতে অনেক এগিয়ে গেছে ইউরোপ। এর মধ্যে তিনটি ফাইনাল তো হয়েছে অল-ইউরোপিয়ান। আর্জেন্টিনার হাতে আজ লাতিন আমেরিকারও পতাকা।
আর্জেন্টিনা-ফ্রান্স ফাইনাল নিশ্চিত হওয়ার পর থেকেই মেসি বনাম এমবাপ্পে রব উঠে গেছে। বেশি চর্চিত বলেই হয়তো দুই দলের সংবাদ সম্মেলনেই এটিকে সাইড লাইনে সরিয়ে রাখার চেষ্টা হলো। ফ্রান্স অধিনায়ক উগো লরিসের মতো স্কালোনিও মনে করিয়ে দিলেন, ফাইনালটা মোটেই মেসি বনাম এমবাপ্পে নয়, বরং ফ্রান্স বনাম আর্জেন্টিনা। যেন কেউ তা জানে না!
মাঠের খেলায় কোন দল এগিয়ে, এ নিয়ে তর্ক থাকতে পারে। তবে মাঠের বাইরে কোনো প্রতিদ্বন্দ্বিতাই নেই। সেখানে আর্জেন্টিনা ২০-০ গোলে জয়ী! হাজারে হাজার আর্জেন্টিনার সমর্থক যেন দোহার দখল নিয়ে নিয়েছেন। সৌদি আরবের কাছে প্রথম ম্যাচেই হেরে বসার পর সমর্থকেরাই যেন দলটাকে আবেগের রথে চড়িয়ে এত দূর নিয়ে এসেছে।
এমিলিয়ানো মার্তিনেজ এদিনও বলে গেলেন, প্রতিটা ম্যাচেই তাঁর মনে হয়েছে, তিনি আর্জেন্টিনায় খেলছেন।
আজ হয়তো আরও বেশি মনে হবে। লুসাইল আইকনিক স্টেডিয়ামে ঢোকার বিনিময়ে যেকোনো কিছু করতে রাজি, আর্জেন্টিনার এমন সমর্থকে যে গিজগিজ করছে দোহা। টিকিট ছাড়াই যাঁরা চলে এসেছেন এবং টিকিট পাচ্ছেন না।
বিশ্বকাপ ফাইনাল, তার ওপর আর্জেন্টিনার জার্সি গায়ে লিওনেল মেসির শেষ ম্যাচ—আজ লুসাইল আইকনিক স্টেডিয়ামে থাকতে পারা মানে তো বাকি জীবনে গল্প করার রসদ পেয়ে যাওয়া।