আতালান্তার ইউরোপা জয়: আপসহীন এক কোচের প্রথম শিরোপা জয়ের গল্পও
গালে ধাতব জিনিসের আঘাত পেয়েছিলেন ডিয়েগো ম্যারাডোনা। কিন্তু জিনিসটা কী ছিল বুঝতে পারেননি। ভেবেছিলেন গালটা বুঝি কেটেছে! রক্ত ঝরছে কি না, মুখে হাত দিয়ে একবার দেখেও নিলেন। টাচ লাইনের বাইরে গিয়ে চিকিৎসা নিচ্ছিলেন। ইতালিয়ান সম্প্রচারক চ্যানেল ‘আরএআই’–এর প্রতিবেদক জিয়ামপিয়েরো গালেয়াজ্জিও দেরি করেননি। তৎক্ষণাৎ দর্শকদের জানিয়ে দেন, নাপোলি প্লেমেকার ‘দাঁতের চিকিৎসকের কাছে যাচ্ছেন।’
কিন্তু দাঁতে তেমন কিছু হয়নি। কেটেছিল ঠোঁট। নাপোলির চিকিৎসক এমিলিও আকাম্পোরা সুই–সুতা নিয়ে তৎক্ষণাৎ কাজে লেগে যান। খণ্ডিত ঠোঁটটা জোড়া লাগাতে হবে। ঘটনাটি ১৯৮৯ সিরি’আ–তে নাপোলি–পেসকারা গোলশূন্য ড্র ম্যাচে। ম্যারাডোনাকে আটকানোর দায়িত্ব ছিল যাঁর, তিনি কনুই মেরেছিলেন। সেই কাজটি করতে গিয়ে আঙুলে থাকা বিয়ের আংটির আঘাতও লেগেছিল। ম্যাচ শেষে এক প্রতিবেদক এ নিয়ে জিজ্ঞাসা করলে তিনি বলেছিলেন, ‘নেয়াপলিতানরা (নেপলসবাসী) কি আমাকে ওই ঘটনায় মাইক টাইসন ভেবেছে? আমি ঠিক তা মনে করি না।’
পেসকারার সাবেক সেই মিডফিল্ডার তাহলে নিজেকে কী ভাবেন? শুধু–ই ফুটবল কোচ? সে তো আরও অনেকেই আছেন। কিংবদন্তি থেকে সাধারণ। কিন্তু জিয়ান পিয়েরো গাসপেরিনিকে ঠিক কিংবদন্তি কিংবা সাধারণ কোনোকিছুতেই ব্র্যাকেটবন্দী করে স্বস্তি মেলে না। এই ইতালিয়ানের ব্যাপ্তি আরও বড়। খেলার ভাষায় তা একবার ব্যাখ্যা করেছিলেন ম্যানচেস্টার সিটি কোচ পেপ গার্দিওলা। সেটি ২০২০ সালের ডিসেম্বরের কথা, ‘দাঁতের চিকিৎসকের কাছে যাওয়া আর আতালান্তার বিপক্ষে খেলা একই কথা।’
গার্দিওলার কথাটা ব্যাখ্যার দাবি রাখে। দাঁতের চিকিৎসকের কাছে গিয়ে চেয়ারে বসার সময় একটু ভয় তো লাগেই। হাত–পা কেমন সিঁটিয়ে রক্তশূন্য হয়ে আসে। চিকিৎসকের হাতে ড্রিল মেশিনটা যখন জাগ্রত, কারও কারও কপালে বিন্দু বিন্দু ঘামও জমে। কেমন একটা অস্বস্তিকর ব্যাপার। গাসপেরিনির আতালান্তার বিপক্ষে খেললে ঠিক তেমনই লাগে। বিশ্বাস না হয় জিজ্ঞাসা করতে পারেন বায়ার লেভারকুসেনের কোচ জাবি আলোনসো আর দলটির খেলোয়াড়দের কাছে। এবারের মৌসুমে ৫১ ম্যাচ অপরাজিত থাকার পর ডাবলিনে পরশু রাতে ইউরোপা লিগ ফাইনালে আতালান্তার কাছে ৩ গোল খেয়েছে জার্মান ক্লাবটি। কীভাবে?
ওই তো, দন্তচিকিৎসকের কাছে গিয়ে রোগীর যে অবস্থা হয়, সেভাবে! জাবি আলোনসোর দল বল পায়ে রেখে দাপট ছড়াতে চায়। ম্যাচ শেষে লেভারকুসেনের ৬৬.৯ শতাংশ সময় বল দখলে রাখা দেখে সেটা মনে হওয়াই স্বাভাবিক। কিন্তু ম্যাচটি দেখে থাকলে আপনি জানেন, আতালান্তা ম্যাচে প্রথমার্ধেই লেভারকুসেনের খেলা নষ্ট করেছে। প্রতিটি খেলোয়াড় মার্ক করে হাই প্রেসিং ফুটবলে স্বাভাবিক খেলাটা খেলতে দেয়নি লেভারকুসেনকে। এর মধ্যে অস্বস্তির বীজ বুনেছে দুটি গোল।
দ্বিতীয়ার্ধে নিজের খেলাটা শিষ্যদের দিয়ে খেলিয়েছেন গাসপেরিনি। অনেকটাই দাঁত তুলে কার্যসিদ্ধির পর চিকিৎসক যেভাবে ওষুধ, গজ–ব্যান্ডেজ দিয়ে জায়গাটা ঠিক করেন সেভাবে। লেভারকুসেনের একজন নায়ক প্রয়োজন হলেও সেটি তাঁদের ছিল না। আতালান্তায় ছিল, মাঠে আদেমোলা লুকমান, মাঠের বাইরে গাসপেরিনি। এককথায় ‘পাপেট শো’—মাঠের ১১ জন পাপেট একদম অক্ষরে অক্ষরে মেনেছেন গাসপেরিনির কৌশল। অনেকটাই কোয়ার্টার ফাইনালের মতো। লিভারপুলে ইয়ুর্গেন ক্লপের মতো কুশলী কোচও থামাতে পারেননি গাসপেরিনির ‘দন্তচিকিৎসা একই ছকের খেলায় হার মেনে বিদায় নিতে হয়। লেভারকুসেনের ক্ষেত্রে অবশ্য একটা মজার ‘সুবিধা’ ছিল। এই একুশ শতকে এর আগে চারটি ফাইনাল খেলেই হেরেছে লেভারকুসেন। পঞ্চম ফাইনালেও তা–ই হলো।
গার্দিওলা আতালান্তার খেলার সঙ্গে দন্তচিকিৎসার মিল পেলেও সেটি আসলে সমালোচনা নয়। এটিও একধরনের আর্ট। নিখুঁত, তীক্ষ্মধী ও পরিষ্কার হতে হয়। আর কে না জানে, শিল্পকলায় কৌশলের প্রচুর লেনাদেনাও হয়। চাইলে আপনি দোয়েল পাখির উদাহরণ টানতে পারেন। অন্য পাখির বাসা দেখে আকৃষ্ট হয়ে সেখান থেকে খড়কুটো নিয়ে নিজের বাসা বানায় দোয়েল। গাসপেরিনি কিন্তু দোয়েল নন। তাঁর কৌশল, ফুটবল নিয়ে চিন্তাভাবনা একদমই নিজস্ব।
তুরিনের পিদমন্তের গ্রুলিয়াস্কোয় জন্ম গাসপেরিনির। মা আন্তোনিয়েত্তার ছিল মাছ বিক্রির দোকান। বাবা জিনো গাড়ি প্রস্তুতকারক প্রতিষ্ঠান ফিয়াটসংশ্লিষ্ট একটি কারখানায় কাজ করতেন। জুভেন্টাসের ভক্ত ছিলেন জিনো। ৯ বছর বয়সী গাসপেরিনিকে নিয়ে গিয়েছিলেন জুভেন্টাসের ট্রায়ালে। স্কাউটদের মন জয় করায় সুযোগ পেয়ে যান ‘তুরিনের বুড়ি’দের একাডেমিতে। বাসা থেকে ৪০ মিনিটের বাসযাত্রার পথ। শুরুতে গাসপেরিনিকে তাঁর বোন দুই–এক দিন নিয়ে গিয়েছেন। ১০ বছর বয়স থেকে আর কাউকে প্রয়োজন পড়েনি। তখন থেকে গাসপেরিনির ভরসা তিনি নিজেই।
১৯৭৬ থেকে ১৯৯৩ পর্যন্ত মোট সাতটি ক্লাবে (আটটি—ধারে খেলেছেন রেজিয়ানায়) খেলেছেন গাসপেরিনি। কখনো শিরোপা জিততে পারেননি। ১৯৭৯ সালে পালের্মোর হয়ে কোপা ইতালিয়ার ফাইনালে উঠে হেরেছিলেন জুভেন্টাসের কাছে। খেলা ছাড়ার পর ১৯৯৪ সালে দায়িত্ব নেন জুভেন্টাসের বয়সভিত্তিক দলের কোচের। তত দিনে ইতালিয়ান ফুটবলের কোচিংয়ে নতুন ধারা চলছিল। সে সময় জুভেন্টাসের প্রতিটি বয়সভিত্তিক দলেরই কোচিং করিয়েছেন গাসপেরিনি। ক্লাব তাঁকে ইউরোপ ঘুরতে পাঠাল নতুন প্রতিভা অন্বেষণে। সেই চেষ্টায় আয়াক্সে লুই ফন গালের অনুশীলন সেশনে গিয়ে আসক্ত হয়ে পড়লেন ‘অ্যাটাকিং ব্যাক থ্রি’ ছকের প্রতি।
২০০৩ সালে গাসপেরিনি ঠিকানা পাল্টালেন। এবার ক্রোটনের কোচ। সেখানে গাসপেরিনি পিথাগোরাসের চেয়েও বেশি অ্যাঙ্গেলের জন্ম দিলেন খেলায়। ক্রোটনকে তুলেছিলেন দ্বিতীয় বিভাগে। তবে অল্পের জন্য প্লে–অফটা জিততে না পারায় শীর্ষ লিগে ওঠা হয়নি। যাযাবর গাসপেরিনির মন আর সেখানে বসেনি। ২০০৬ সালে কোচ হলেন ইতালির সবচেয়ে পুরোনো ক্লাব জেনোয়ার। এরপরই শুরু হলো ‘গাসপারসন’ কাল্ট!
সেটা অনেকটাই ম্যানচেস্টার ইউনাইটেডে স্যার অ্যালেক্স ফার্গুসনের মতো—ব্রিটিশ স্টাইল আরকি, ক্লাবের সবকিছু নিয়ন্ত্রণ করবেন। সেই ধারায় দীর্ঘ এক যুগের অপেক্ষা ঘুচিয়ে জেনোয়াকে তুলেছিলেন সিরি’আ–তে। সে সময় ইন্টার মিলান কোচ হিসেবে জোসে মরিনিওর প্রথম মৌসুমে সিরি’আ–তে সবচেয়ে চিত্তাকর্ষক ফুটবল খেলেছে গাসপেরিনির জেনোয়া। মরিনিও একবার বলেছিলেন, গাসপেরিনির বিপক্ষে আসলে দাবা খেলতে হয়, ‘আমি কোনো পরিবর্তন করলাম। সে প্রতি–আক্রমণ করল। আমি আবার পরিবর্তন করলাম। সে আবারও প্রতি–আক্রমণ করল!’
জেনোয়া ছেড়ে ২০১১ সালে ইন্টার কোচের দায়িত্ব নেন গাসপেরিনি। তাঁর ৩০ বছরের কোচিং ক্যারিয়ারে এটাই একমাত্র বড় ক্লাব। গাসপেরিনি জানতেন মার্সেলো বিয়েলসা ছিল ইন্টারের প্রথম পছন্দ। তবু কেন তখন দায়িত্বটি নিয়েছিলেন, সেটি বড় প্রশ্ন। ইন্টার তাঁর পছন্দ অনুযায়ী খেলোয়াড় কেনেনি। তাঁর খেলার ছকের সঙ্গেও আপস করেনি। টানা পাঁচ ম্যাচ জয়শূন্য থাকতে হয় (চারটি হার)—ফলাফল জানাই ছিল। ছাঁটাই।
গাসপেরিনি এরপর নিজের সাবেক ক্লাবে ফিরলেন। পালের্মো। সেখানে তখন ক্রীড়া পরিচালক ছিলেন মরিসিও জাম্পারিনি। ‘কোচ–ইটার’—নামে বদনাম ছিল তাঁর। ফুটবলের সঙ্গে ৩২ বছরের সংশ্লিষ্টতায় তত দিনে ৫১ জন কোচকে ছাঁটাই করেছেন। গাসপেরিনিকে তিনিই পালের্মোয় নিয়ে এসেছিলেন। কিন্তু কিছুদিনের মধ্যেই মা–বাবাকে (মৃত্যু) হারিয়ে ফুটবলে আর মনোযোগ ধরে রাখতে পারেননি গাসপেরিনি। জাম্পারিনি সে সময় সেটাই করলেন, যেটা তিনি সবচেয়ে ভালো পারেন—গাসপেরিনিকে একবার ছাঁটাই করলেন। তারপর ফিরিয়ে আনলেন। তারপর আবারও ছাঁটাই করলেন। সেটি ২০১৩ সালের মার্চের ঘটনা। সে বছরই সেপ্টেম্বরে গাসপেরিনি ফিরলেন জেনোয়ায়। তিন বছর সেখানে থেকে ক্লাবটিকে তুলেছিলেন ইউরোপিয়ান প্রতিযোগিতায়। কিন্তু আর্থিক গড়মিলের অভিযোগে উয়েফা তাদের খেলার ছাড়পত্র দেয়নি। ইতালিয়ান ফুটবল ফেডারেশন ইউরোপে খেলার অনুমতি দেয় জেনোয়ারই প্রতিদ্বন্দ্বী ক্লাব সাম্পদোরিয়াকে।
২০১৬ সালের জুনে আতালান্তার দায়িত্ব নিয়ে এই ক্লাবকেও পাল্টে ফেলেন গাসপেরিনি। যে আতালান্তা একসময় সিরি বি থেকে অবনমন এড়ানোর লড়াই করত, সেই দলটাই গাসপেরিনির অধীন সিরি’আ–তে আধিপত্য প্রতিষ্ঠার লড়াই করতে শুরু করে। নিয়মিত খেলা শুরু করে ইউরোপেও। বাকিটা আপনার জানা।
তবে এই তথ্য অজানা থাকতেও পারে—গাসপেরিনির এই ৮ বছরে আতালান্তা আয়–ব্যয়েও লাভ করেছে ১৫ কোটি ইউরোর বেশি। এই দলের বেতনকাঠামো ইংলিশ প্রিমিয়ার লিগে ২০টি দলের মধ্যে তুলনা করলে ১৮তম। প্রতি মৌসুমেই তারকা খেলোয়াড়দের বিক্রি করে নতুন প্রতিভা হাজির করে আতালান্তা। বিশ্বের অন্যতম সেরা একাডেমিও তাদেরই। অর্থাৎ এই ক্লাবে নিজের মনের মতো করে সবকিছু পেয়েছেন গাসপেরিনি। বড় দল নয়, ছোট ছোট দলগুলোকে আরও ওপরে তোলায় যাঁর জুড়ি মেলা ভার। যিনি নিজের কোচিং–দর্শন নিয়ে কারও সঙ্গে কখনো আপস করেননি। আতালান্তা তাঁকে তাঁর মতো করেই চলতে দিয়েই ২০১৮ ইউরোপা লিগ খেলেছে, পরের বছর চ্যাম্পিয়নস লিগে খেলেছে নিজেদের ইতিহাসে প্রথমবারের মতো। এবার তো ইউরোপা লিগটাই জিতে নিল!
গাসপেরিনির কাছে সেই জয়ের স্বরূপটা কী?
একটি লোক খেলোয়াড়ি ক্যারিয়ারে কোনো শিরোপা জিততে পারেননি। কোচিংয়ে নেমে নিজের দর্শন নিয়ে আপস করেননি। ইতালিয়ান ফুটবলেরর কর্তা–ব্যক্তিদের সঙ্গে বিরোধ লেগেই থাকত। জুভেন্টাসের একাডেমি বাদ দিলেও কোচিংয়ের অভিজ্ঞতা নেমে আসে দুই দশকে (২১ বছর)। এত বছর অপেক্ষার পর গতকাল রাতেই গাসপেরিনি জিতেছেন প্রথম শিরোপা। সেই জয়ে তাঁর অনূভূতি শুনলেই গাসপেরিনির ভেতরকার সত্তাকে ধরা যায়, ‘ট্রফি দিয়ে বিচারের এই ব্যাপার আমি বুঝি না। এর মানে এই নয় যে আজ (গতকাল) বিকালে যেমন ছিলাম, জেতার পর তার চেয়ে ভালো হয়ে গেছি।’
গার্দিওলা গাসপেরিনির আতালান্তার খেলার ধরনের সঙ্গে দাঁতের চিকিৎসার তুলনা টেনেছিলেন। স্প্যানিশ কোচ হয়তো বলতে ভুলে গিয়েছিলেন, তুলনাটার কেন্দ্রবিন্দুতে দাঁত তোলার ব্যথা নেই। সেটি আসলে গাসপেরিনির ছেলেদের মুখের হাসি। নিজের ফুটবলীয় কৌশল দিয়ে দিনের পর দিন ঘষামাজা করে খেলোয়াড়দের মুখে হাসি ফুটিয়েছেন গাসপেরিনি। শিরোপা জয়ের পর সমর্থকদের মধ্যেও সংক্রমিত সেই হাসি। শুধু জাবির মুখে হাসি নেই।
গাসপেরিনির হাসিটা যে তাঁর দিকে তাকিয়েই!