লিওনেল মেসির বিদায়ের পর ২০২১–২২ মৌসুম বার্সেলোনার জন্য ভুলে যাওয়ার মতোই ছিল। নিজেদের সাম্প্রতিক ইতিহাসে আর কখনো এতটা বিপর্যয়ে পড়েনি বার্সা। লা লিগায় একপর্যায়ে টেবিলের নিচে নেমে গিয়েছিল কাতালান ক্লাবটি।
চ্যাম্পিয়নস লিগের প্রথম রাউন্ড থেকে বিদায় নেওয়া বার্সার ঠাঁই হয় ইউরোপা লিগে। ইউরোপের দ্বিতীয় সারির শ্রেষ্ঠত্বের দৌড়েও বার্সার অবস্থা তথৈবচ। এমনকি পরের মৌসুমে চ্যাম্পিয়নস লিগে খেলাও পড়েছিল শঙ্কায়।
এমন পরিস্থিতিতে ঘুরে দাঁড়ানোর জন্য ‘অলৌকিক’ কিছুর সন্ধানে ছিলেন বার্সা সমর্থকেরা। সেই অলৌকিক কিছু আসলেই ঘটেছে কি না, তা সময়ই বলবে, তবে সেই ধাক্কাটা সামলে আবার লড়াই ফেরার ইঙ্গিত দিয়ে রেখেছে জাভি হার্নান্দেজের দল।
গত মৌসুমের হতাশা ও যন্ত্রণাদায়ক পরিস্থিতি থেকে উদ্ধারে বার্সা তখন শরণাপন্ন হয় ক্লাব কিংবদন্তি জাভির। ডাচ কোচ রোনাল্ড কোমানকে সরিয়ে জাভিকে উড়িয়ে আনা হয় কাতারি ক্লাব আল সাদ থেকে। এর আগে বার্সার দাপুটে দল হয়ে ওঠার অন্যতম বড় সাক্ষী ছিলেন এই জাভিই।
সেই জাভিতেই মৌসুমের শেষ ভাগে গিয়ে কিছুটা সামলে নেয় বার্সা। দুই নম্বরে থেকে শেষ করে লিগ মৌসুম। আর নতুন মৌসুমে লা লিগা তো বটেই, চ্যাম্পিয়নস লিগেও শিরোপার অন্যতম দাবিদার এখন বার্সেলোনা।
বার্সেলোনায় জাভির শুরুটাও ছিল অম্ল–মধুর। লা লিগায় ঘুরে দাঁড়ালেও ইউরোপায় বেশ সংগ্রাম করতে হয়। শেষ আটে এইনট্রাখট ফ্রাঙ্কফুর্টের কাছে দুই লেগ মিলিয়ে ৪–৩ ব্যবধানে হেরে বিদায় নিতে হয় বার্সাকে। তবে সেই ব্যর্থতা ভুলে নতুন মৌসুমে দল গোছানোয় মনোযোগ দেন জাভি।
কদিন আগে শেষ হওয়া দলবদলেও দারুণ চমক দেখায় ন্যু ক্যাম্পের দলটি। গত বছর মার্চে যে দলটি ১.৩৫ বিলিয়ন ইউরোর ঋণের বোঝায় চাপা পড়েছিল, তারাই এবারের দলবদলে সবাইকে হতভম্ভ করে দিয়েছে। এমনকি বার্সার দলবদল নিয়ে প্রতিদ্বন্দ্বীগুলোও প্রকাশ্যে বিস্ময় প্রকাশ করে।
দলবদলে কৌশলী অবস্থান গ্রহণ করে একের পর এক হাই–প্রোফাইল খেলোয়াড় দলে ভেড়ায় বার্সেলোনা। বায়ার্ন মিউনিখ নিয়ে আসে সময়ের অন্যতম সেরা স্ট্রাইকার রবার্ট লেভানডফস্কিকে। এরপর বার্সার আগ্রাসী দলবদলে ওলটপালট হয়ে যায় ইংলিশ জায়ান্ট চেলসির সব কৌশল।
একসময় দলবদলে খেলোয়াড় ‘ছিনতাই’য়ের জন্য বিখ্যাত চেলসি বার্সার সামনে অসহায় আত্মসমর্পণে একরকম বাধ্যই হয়। চেলসির নাকের নিচ থেকে নিয়ে আসে জুলস কুন্দে ও রাফিনিয়াকে। সঙ্গে ফ্রি ট্রান্সফার হিসেবে ফ্রাঙ্ক কেসি, আন্দ্রেস ক্রিস্টেনসেন এবং হেক্টর বেয়েরিনকেও নিয়ে আসা হয়। খেলোয়াড় নিবন্ধনের শুরুতে বিপদে পড়লেও পরে চতুর্থ ‘অর্থনৈতিক লিভার’ কার্যকরের মধ্য দিয়ে সে বাধাও উতরে যায় বার্সা। তবে ক্লাব কর্তৃপক্ষের নেওয়া এই ঝুঁকি তখনই সাফল্যের মুখ দেখবে, যখন খেলোয়াড়েরা মাঠে খেলায় সাফল্য নিয়ে আসতে পারবেন, যার অন্যতম ধাপটি শুরু হচ্ছে আজ রাতেই।
চ্যাম্পিয়নস লিগে শিরোপা পুনরুদ্ধারের পথটা যে সহজ হবে না, তা গ্রুপ পর্বের ড্রয়ের পরই একরকম স্পষ্ট হয়েছে। গ্রুপ ‘সি’তে বার্সাকে লড়তে হবে বায়ার্ন মিউনিখ, ইন্টার মিলান ও ভিক্টোরিয়া প্লোজেনের সঙ্গে। ‘মরণকূপ’ খ্যাত এই গ্রুপ থেকে অন্তত একটি সাবেক চ্যাম্পিয়ন প্রথম পর্ব থেকেই বিদায় নিতে যাচ্ছে। আর এমন পরিস্থিতিতে প্লোজেন যতই অখ্যাত দল হোক হালকাভাবে নেওয়ার কোনো সুযোগই নয়। এই গ্রুপে প্রতিটি পয়েন্ট তো বটেই প্রতিটি গোলও দিন শেষে ভাগ্য নির্ধারকের ভূমিকা নিতে পারে।
তবে চূড়ান্ত সাফল্য পেতে হলে যে এই কঠিন পথটাই পাড়ি দিতে হবে, তা অজানা নয় বার্সা কোচ জাভির। স্বপ্ন পূরণে নিজেদের সেরাটা দিতে প্রত্যয়ী জাভি ম্যাচ–পূর্ব সংবাদ সম্মেলনে বলেছেন, ‘আমরা লড়াই করব এবং বড় স্বপ্ন দেখছি। নইলে আমরা ঘরেই থাকতাম। আমরা কেন এই প্রতিযোগিতা জিততে পারব না? আমি জিততে পছন্দ করি। আমি জেতা ছাড়া লড়াইয়ের কথা ভাবতেই পারি না।’
জেতার ব্যাপারে প্রত্যয়ী হলেও পথটা মোটেই সহজ নয়। বিশেষ করে চ্যাম্পিয়নস লিগের মঞ্চে প্রতিটি ম্যাচই এখন বাঁচামরার। একটি ভুলে সব পরিকল্পনা ও স্বপ্ন নিমেষেই ধুলায় মিশতে পারে। তাই নিজেরা ফেবারিট কি না, তা নিয়ে না ভেবে ম্যাচ ধরে এগোতে চান জাভি। বার্সা কোচ বলেন, ‘ফেবারিট হওয়ার বিষয়টা ভিন্ন। আপনাকে বিনয়ী হতে হবে। প্রতিটি ম্যাচই হবে যুদ্ধের মতো। আমরা ২০১৫ সালের পর আর চ্যাম্পিয়নস লিগ জিততে পারিনি।’
চ্যাম্পিয়নস লিগে এখনো শুরুর অপেক্ষায় থাকলেও লিগ থেকে অনুপ্রাণিত হওয়ার মতো অনেক কিছুই পাচ্ছে বার্সা। বিশেষ করে লেভানডফস্কির ফর্ম জাভির আত্মবিশ্বাসের পালে বাড়তি হাওয়া দেবে। ইতিমধ্যে বার্সার হয়ে টানা ৩ ম্যাচে ৫ গোল পেয়েছেন লেভা। যার মাঝে টানা দুই ম্যাচে করেছেন জোড়া গোল করে। চ্যাম্পিয়নস লিগে অবশ্য লেভার জন্যও চ্যালেঞ্জ ভিন্ন। প্রথম রাউন্ডেই সাবেক দল বায়ার্নের মুখোমুখি হবেন। এই বায়ার্নের হয়েই একবার বার্সাকে ৮–২ গোলে বিধ্বস্ত করেছিলেন লেভা। এবার পোলিশ স্ট্রাইকারের সামনে সুযোগ এসেছে নতুন দলের পুরোনো ক্ষতে প্রলেপ দেওয়ার।
এ ছাড়া বার্সাকে উজ্জীবিত করছে লেফট উইংয়ে রাফিনহার উপস্থিতি এবং লম্বা টানাহেঁচড়ার পর উসমান দেম্বেলের ছন্দে ফেরা। একইভাবে আনসু ফাতিও চোট কাটিয়ে নিজেকে মেলে ধরার অপেক্ষায় আছেন।
এই ইতিবাচক মনোভাবটা অব্যাহত রাখতে চান জাভিও, ‘আমি প্রতিদিন ভক্তদের লক্ষ করি। জার্সি সব বিক্রি হয়ে গেছে, ভক্তরা আমাদের আটকে দিয়ে রাস্তায় উদ্যাপন করছে। আমাদের এটা ধরে রাখতে হবে। এটা ইতিবাচক অনুভূতি। আমরা চাপকেও স্বাগত জানাচ্ছি। আপনি যখন বার্সেলোনার হয়ে খেলবেন এখানে প্রতিদিন চাপ থাকবেই। আমরা চাপের মুখেই ৫টি চ্যাম্পিয়ন লিগ জিতেছি। আরেকটি জেতার স্বপ্ন দেখা বাড়তি কোনো চাপ যুক্ত করবে না।’
বড় স্বপ্ন দেখা জাভি অবশ্য প্রথম ম্যাচের প্রতিপক্ষ প্লজেনকে নিয়েও সতর্ক। বার্সা কোচ আরও যোগ করে বলেন, ‘আমি জানি সবাই আমাদের ফেবারিট মনে করে। তবে প্লজেন শারীরিকভাবে বেশ শক্তিশালী। খুবই পরিশ্রমী দল। এই মুহূর্তে তাই আমাদের নিজেদের লক্ষ্যে মনোযোগী হতে হবে, যা হচ্ছে নকআউট পর্বে জায়গা করে নেওয়া। আমাদের মূল উদ্দেশ্য শিরোপা জেতা। তবে তার আগে নিজেদের প্রথম ম্যাচে জিততে হবে।’