জীবন ও মৃত্যুর মাঝেই তো ক্লাসিকো
শুধুই কি খেলা? এই প্রশ্নবোধক বাক্যের আগে যদি রিয়াল মাদ্রিদ ও বার্সেলোনার নাম দুটি জুড়ে দেওয়া হয়, উত্তরটা বোধ হয় আর আলাদা করে না দিলেও চলে। রিয়াল-বার্সার ম্যাচে ফুটবল যেন হয়ে ওঠে দূরবর্তী কোনো বিষয়! যেন অনেক দূরে মুখ গোমড়া করে বসে থাকা কোনো উঠতি কিশোর। আড়ালে দাঁড়িয়ে যে দেখছে রাজনীতি, তিফো, উত্তপ্ত স্লোগান, দুয়ো, খেলোয়াড় নিয়ে কাড়াকাড়ি এমনকি শূকরের মাথা পর্যন্ত। ফলে কখনো কখনো ‘এল ক্লাসিকো’ আর ক্লাসিকো থাকে না, হয়ে ওঠে ‘হেল ক্লাসিকো’ অর্থাৎ নারকীয় দ্বৈরথ।
আর এসব ডামাডোলে অনেক সময় গৌণ হয়ে পড়ে ফুটবল। অবশ্য ফুটবলের মোড়কে একটা খেলা যখন বহুরূপী হয়ে হাজির হয়, তখন খেলা কি আর শুধুই খেলা থাকে! বিখ্যাত ফুটবল লেখক সিড লো তাঁর ‘ফিয়ার অ্যান্ড লোদিং ইন লা লিগা’ বইয়ে এল ক্লাসিকো নিয়ে যেমনটা লিখেছিলেন, ‘জীবন এবং মৃত্যু আর তার মাঝেই ফুটবল।’ খানিকটা ভিন্ন অর্থে বললেও রিয়াল–বার্সার দ্বৈরথ তেমনই অপার্থিব অনুভূতি নিয়ে ধরা দেয়।
এল ক্লাসিকোয় এমন অসংখ্য দ্বৈরথ আছে, যেগুলো সত্যি সত্যি আপনাকে জীবন-মৃত্যুর অনুভূতি দিয়েছে। অনেক দূরে টেলিভিশনের সামনে বসে আপনি ভাবেন, আরে এ–ও হয় নাকি? ফুটবল তো নিছক একটা খেলাই, কিন্তু এখানে এসব কী হচ্ছে! নাহ, ফুটবল কোনো অর্থেই নিছক কোনো খেলা নয়। লিভারপুল কিংবদন্তি বিল শ্যাংকলি যেমনটা বলেছিলেন, ‘অনেকে মনে করে ফুটবল জীবন আর মৃত্যুর সমান। আমি তা মনে করি না। আমি মনে করি ফুটবল এর চেয়েও বড়।’ কথাটা প্রতীকী অর্থে বলা হলেও সেই কথার কাছাকাছি বাস্তবিক উদাহরণ হতে পারে এল ক্লাসিকো। রিয়াল–বার্সার এমন কিছু ম্যাচ আছে, যা ইতিহাসে চিরস্থায়ী।
এমনিতে দেখলে এল ক্লাসিকো একটি সাধারণ ফুটবল ম্যাচই তো। অন্য সব ম্যাচের মতোই দুটি দলে এগারোজন করে খেলে। যাদের মধ্যে অনেকেই আবার নন-স্প্যানিশ। এমনকি এবার তো দুই দলের প্রধান কোচও নন–স্প্যানিশ। বার্সা কোচ হান্সি ফ্লিক জার্মান এবং রিয়াল কোচ কার্লো আনচেলত্তি ইতালিয়ান। কিন্তু এরপরও এই লড়াইয়ে কেন এত আগুন? কেন এই যুদ্ধের দামামা? এই দ্বৈরথকে অনেকভাবে পাঠ করা হয়। ধনীর বিরুদ্ধে গরিবের যুদ্ধ, রাজা বনাম প্রজার লড়াই কিংবা স্বাধীনতাকামী কাতালানদের সঙ্গে কর্তৃত্ববাদী মাদ্রিদের লড়াই, এ রকম বহুভাবে ব্যাখ্যা করা যায় এই ক্লাসিকোকে।
শুরু থেকে এই দুই দলের লড়াইয়ে এমন ঝাঁজ থাকলেও ১৯৭৫ সালে জেনারেল ফ্রান্সিসকো ফ্রাঙ্কোর মৃত্যুর পর এই ম্যাচ পূর্ণ মাত্রায় রাজনৈতিক হয়ে ওঠে। একপর্যায়ে এটি হয়ে ওঠে মর্যাদা রক্ষার স্মারক। বার্সেলোনার সাবেক কোচ লুইস ফন গাল বলেছিলেন, ‘কাতালোনিয়াবাসীরা নিজেদের গর্বিত মানুষ ভাবে। আর তারা মাদ্রিদ থেকে ভালো হতে চায়।’ বিপরীতে রিয়ালের লড়াইটা আভিজাত্য রক্ষার। তাদের কাছে এই ম্যাচ শেষ পর্যন্ত রাজদণ্ড পাওয়ার বা সিংহাসন জেতার মতোই। যদিও এসব কথা সরাসরি কেউই উচ্চারণ করে না। তবে ভেতরে ভেতরে তুষের আগুন যে সারাক্ষণ জ্বলতে থাকে, সে কথা তো সবারই জানা।
দুই দলের এই বিপরীতমুখী অহম কিংবা অহংকারই বছরের পর বছর ধরে বাঁচিয়ে রেখেছে এল ক্লাসিকোর অন্তরাত্মাকে। এমনকি যখন এল ক্লাসিকোর আমেজ সবচেয়ে কম থাকে, তখনো মর্যাদার প্রশ্নে আপসের কোনো সুযোগ থাকে না। আপনি সব হেরে আসতে পারেন, বাজিতে সব উজাড় করে দিতে পারেন, কিন্তু এই ম্যাচে হারতে পারবেন না। আর এই প্রক্রিয়ার ভেতর দিয়েই দ্বৈরথটি চিরন্তন হয়ে উঠেছে।
ফুটবল–মঞ্চে এল ক্লাসিকো যাত্রা শুরু করেছিল ১৯০২ সালে। এরপর গত প্রায় ১২২ বছরে নাটকীয় সব উত্থান–পতনের ভেতর দিয়ে ‘কাল্ট’ মর্যাদা পেয়েছে এই লড়াই। তবে এই শতাব্দীর প্রথম দশকের শেষ থেকে দ্বিতীয় দশকের শেষ পর্যন্ত দ্বৈরথটি তার শীর্ষবিন্দু স্পর্শ করে দুজন ফুটবলারের কারণে। সে সময় যার কেন্দ্রে ছিলেন লিওনেল মেসি ও ক্রিস্টিয়ানো রোনালদো। নিজেদের ব্যক্তিগত অবস্থান ও অমিত প্রতিভার কারণে এল ক্লাসিকোর সমার্থক হয়ে ওঠেন তাঁরা। শুধু ফুটবলীয় লড়াইয়েই নয়, তার বাইরেও এই ম্যাচ আগুনে রূপ নিয়ে সামনে এসেছিল। আর এই উত্তাপের ধারা অব্যাহত ছিল প্রায় এক দশক পর্যন্ত।
মেসি–রোনালদোর কারণে ক্লাসিকো আকর্ষণের কেন্দ্রে থাকলেও এতে অন্য চরিত্রগুলোর ভূমিকাও কম ছিল না। দুই স্প্যানিশ সেন্টারব্যাক সের্হিও রামোস বনাম জেরার্দ পিকের যুদ্ধ নিয়ে তো আলাদা করে মহাকাব্য লেখা যায়। কিংবা রিয়ালের ডাগআউটে জোসে মরিনিওর আগমনও ম্যাচে অন্য রকম একটা আবহ নিয়ে এসেছিল। মরিনিও সম্পর্কে একবার বার্সার কিংবদন্তি মিডফিল্ডার আন্দ্রেস ইনিয়েস্তা বলেছিলেন, ‘মরিনিও ভালোর চেয়ে খারাপই বেশি করেছে। সে স্প্যানিশ ফুটবলের ক্ষতি করেছে।’ উত্তরে মরিনিও বলেছিলেন, ‘আমি ফুটবলের ক্ষতি করেছি, কারণ আমি বার্সেলোনার আধিপত্য শেষ করে দিয়েছি।’
ক্লাসিকোর উত্তাপ কমে যাওয়ার পেছনে যে বিষয়গুলোকে দায়ী করা হয়, সেগুলো হলো মেসি রোনালদোর প্রস্থান, দুই দলে একের পর এক তারকাপতন, একপেশে ফল এবং সমর্থকের ভাটা।
কথার লড়াইয়ে এমন উদাহরণ চাইলে অনেক দেওয়া যায়। তবে বাস্তবতা হচ্ছে উত্তপ্ত এই দিনও একসময় শেষ হয়। বিশেষ করে ২০১৮ সালে রোনালদো রিয়াল ছাড়ার পর ক্লাসিকোর উত্তাপের পারদও ধীরে ধীরে নিচে নামতে থাকে এবং গত কয়েক মৌসুমে একেবারে তলানিতে ঠেকে।
মোটাদাগে ক্লাসিকোর উত্তাপ কমে যাওয়ার পেছনে যে বিষয়গুলোকে দায়ী করা হয়, সেগুলো হলো মেসি রোনালদোর প্রস্থান, দুই দলে একের পর এক তারকাপতন, একপেশে ফল এবং সমর্থকের ভাটা। ব্লেচার রিপোর্টের একটি প্রতিবেদন জানিয়েছিল, রোনালদোর শেষ মৌসুমে সান্তিয়াগো বার্নাব্যুয়ে গড়ে দর্শক উপস্থিতি ছিল ৬৫ হাজার ৮২৪ জন। রোনালদোকে ছাড়া প্রথম মৌসুমে যা নেমে আসে ৬২ হাজার ৫০০ জনে। মাঠের দর্শকের মতো বিশ্বজুড়ে দুই দলে সমর্থকের সংখ্যাও একই ধারায় কমেছে বলে অনুমান করাই যায়।
খারাপের পরই অবশ্য ভালো সময় আসে। আর সেই ভালো সময় শুরুর ইঙ্গিত পাওয়া যাচ্ছে এবার। আজ রাতে এল ক্লাসিকোতে রিয়াল–বার্সার লড়াইটিকে ঘিরে তাই তৈরি হয়েছে তুমুল উত্তেজনা। দুই দলের সাম্প্রতিক ফর্ম, লা লিগায় অবস্থান এবং তারকা দ্যুতির কারণেই ফিরতে শুরু করেছে ক্লাসিকোর চিরায়ত ‘হেভি মেটাল’ সুর। এমনকি ক্লাসিকোর টিকিট নিয়েও প্রায় এক সপ্তাহ আগে থেকে শুরু হয়েছে কাড়াকাড়ি। এ ছাড়া যে দাপটের সঙ্গে রিয়াল–বার্সা নিজেদের প্রস্তুতি সেরেছে, সেটা ফুটবলপ্রেমীদের আকর্ষণ আরও বাড়িয়ে দিয়েছে।
খারাপের পরই অবশ্য ভালো সময় আসে। আর সেই ভালো সময় শুরুর ইঙ্গিত পাওয়া যাচ্ছে এবার।
লা লিগায় নিজেদের শেষ ম্যাচে সেল্তা ভিগোর বিপক্ষে রিয়াল জিতেছে ২–১ গোলে। আর বার্সা সেভিয়াকে উড়িয়ে দেয় ৫–১ গোলে। এরপর চ্যাম্পিয়নস লিগে বরুসিয়া ডর্টমুন্ডের বিপক্ষে ২–০ গোলে পিছিয়ে পড়েও ঘুরে দাঁড়িয়ে রিয়াল জেতে ৫–২ গোলে। এই ম্যাচে হ্যাটট্রিক করেন ব্রাজিলিয়ান উইঙ্গার ভিনিসিয়ুস জুনিয়র। বিপরীতে আরেক জার্মান দল বায়ার্ন মিউনিখকে ৪–১ গোলে জিতে নিজেদের প্রস্তুতি সেরেছে বার্সা। সে ম্যাচে হ্যাটট্রিক করেন আরেক ব্রাজিলিয়ান তারকা রাফিনিয়া। ক্লাসিকোর আগে দুই দলের কাছ থেকে এমন আগুনে পারফরম্যান্সই তো দেখতে চেয়েছিলেন সমর্থকেরা। যার ধারাবাহিকতা আজ সান্তিয়াগো বার্নাব্যুর উত্তাল দর্শকদের সমুদ্রেও দেখার প্রত্যাশা থাকবে সবার।
শুধু পারফরম্যান্সই নয়, তারকা উপস্থিতির দিক থেকেও এবারের ক্লাসিকো অন্য রকম। এ মৌসুমে কিলিয়ান এমবাপ্পেকে কিনে নিজেদের ‘গ্যালাকটিকোস’কে পূর্ণ করেছে রিয়াল। তাঁর সঙ্গে আছেন ভিনিসিয়ুস জুনিয়র, বেলিংহাম এবং লুকা মদরিচের মতো শীর্ষ তারকারা। এই ম্যাচে যদি আলাদা করে চোখ রাখার কথা বলা হয়, তবে ভিনিসিয়ুসের নামই সবার আগে আসবে। এ মুহূর্তে ‘পয়েন্ট অব নো রিটার্ন’ থেকেও একাই যদি কেউ ম্যাচ ঘোরাতে পারেন তো তাঁর নাম ভিনি। উইং ধরে রক্ষণ ছারখার করা গতি কিংবা ধনুকের মতো বাঁকানো ‘অ্যাসিস্ট’ অথবা ছায়াশরীর দেখিয়ে প্রতিপক্ষকে বোকা বানিয়ে গোল করা—সবা জায়গাতেই ভিনি এখন অনন্য।
বিপরীতে বার্সেলোনা গত মৌসুম থেকে ফুটবলকে উপহার দিয়েছেন লামিনে ইয়ামাল নামে অনবদ্য এক তারকা। ১৭ পেরোনোর আগেই ফুটবল–মঞ্চে নিজের শ্রেষ্ঠত্ব প্রতিষ্ঠা করেছেন এই স্প্যানিয়ার্ড। তাঁর পা যেন মাখনের ওপর ছুরি চালানোর মতো বল নিয়ে এগিয়ে যেতে থাকে। পলকা শরীরে মুহূর্তের মধ্যে প্রতিপক্ষকে বিবশ করে ফেলার গুণ যেন এখনো মাঠে মেসিকে দেখার সুযোগ করে দিচ্ছে। দুর্দান্ত ইয়ামালের সঙ্গে রাফিনিয়া কিংবা রবার্ট লেভানডফস্কিরাও আছেন নিজেদের সেরা ছন্দে। দুই দলের এই তারকা দ্যুতিই এই ম্যাচকে ভিন্ন এক মাত্রা দিচ্ছে।
একইভাবে বলতে হয় দুই কোচের কথাও। রিয়াল কোচ ‘বুড়ো’ আনচেলত্তি তো বহু বছরের পুরোনো ওয়াইনের মতো। যতই সময় গড়াচ্ছে, ততই যেন তাঁর কৌশল নতুন নতুন বাঁক নিয়ে হাজির হচ্ছে। আক্ষরিক অর্থেই ডাগআউটে দাঁড়িয়ে গাম মুখে নিয়ে চোয়াল নাচাতে নাচাতে যিনি মুহূর্তের মধ্যে বদলে দিতে পারেন গোটা ম্যাচের দৃশ্যপট। আর এ কাজটি করার সময় তাঁর দৃষ্টি থাকে স্থির, অবয়ব থাকে অভিব্যক্তিহীন এবং ভ্রু থাকে কুঁচকানো। যেন তিনি কোচ নন, জাদুকর। ফলে ম্যাচ শেষ হওয়ার আগ পর্যন্তও আনচেলত্তির ওপর আস্থা হারানোর সুযোগ থাকে না।
অন্যদিকে বার্সার কোচ হওয়ার আগে ফ্লিককে নিয়ে আপত্তির শেষ ছিল না। অনেকের ধারণা ছিল, তিনি বার্সার খেলার ধরনের সঙ্গে বেমানান। কেউ কেউ দুই মাসের মধ্যে তাঁর বিদায়ও দেখে ফেলেছিলেন। কিন্তু মৌসুম শুরু হতে ভোজবাজির মতো সব বদলে গেছে। লা লিগা এবং চ্যাম্পিয়নস লিগ মিলিয়ে দুই ম্যাচ হারলেও বাকি ম্যাচগুলোর আধিপত্য সেসব আড়াল করে দিয়েছে।
জার্মানদের চিরায়ত প্রেসিংয়ের সঙ্গে স্পেনের ক্লাসিকাল ফুটবলের দারুণ ফিউশন নিয়ে এসেছেন ফ্লিক। যে কারণে তাঁর কৌশলে গতি ও পাসিংয়ের নন্দন দুটিই একসঙ্গে ডানা মেলছে। যার ফলে বার্সার ম্যাচগুলোয় গোল হচ্ছে প্রচুর। যেমন লা লিগায় বার্সা ১০ ম্যাচে গোল করেছে ৩৩টি। ২০০৮–০৯ মৌসুমের পর প্রথম ১০ ম্যাচে এত গোল আর করেনি কাতালানরা। এখন এল ক্লাসিকোতে জার্মান ও স্প্যানিশ যুগলবন্দীতে ফ্লিক নতুন কী চমক উপহার দেন, সেটাই দেখার অপেক্ষা।
সব মিলিয়ে আজ বার্নাব্যুতে আনচেলত্তি বা ফ্লিকের শ্রেষ্ঠত্ব প্রতিষ্ঠার মধ্য দিয়ে লা লিগায় ভবিষ্যতে রাজত্বের নতুন রূপরেখাও সামনে চলে আসবে। এমনকি এই ম্যাচ মৌসুমের শুরুতেই হয়ে উঠতে পারে লিগ নির্ধারকও। বিশেষ করে বার্সা যদি বার্নাব্যুতে কাতালানদের জয়ের পতাকা উড়িয়ে ফিরতে পারে, সেটিকে রাজপাট দখলের আগাম সংকেত হিসেবেও পড়া যেতে পারে। একটু থামুন, প্রতিপক্ষ দলটা তো রিয়াল মাদ্রিদই নাকি! বার্সার সব আকাঙ্ক্ষার ওপর পানি ঢেলে দিতে নামটাই কি যথেষ্ট নয়?